Saturday, 19 October 2019

অর্ক ও সূর্যমামা: সূর্যের বিজ্ঞান - পর্ব ৯



সূর্যের আবহাওয়া

সূর্যের আবহাওয়া পৃথিবীর আবহাওয়ার চেয়ে ভিন্ন। বাতাস নেই, ঘনত্ব অনেক কম এবং অনেক বেশি উত্তপ্ত। সূর্যের আবহাওয়ামন্ডলের দুটো অংশ। ক্রোমোস্ফিয়ার এবং কোরোনা বা কিরীট। কোরোনা মহাশূন্য পর্যন্ত বিস্তৃত। সূর্যের গঠন আলোচনা করতে গিয়ে আমরা ক্রোমোস্ফিয়ার এবং কোরোনা সম্পর্কে জেনেছি।  


সূর্যের পিঠে ফুটন্ত আগুন
সূর্যের উপরিতল কখনোই মসৃণ সমতল নয়। সারাক্ষণই উত্তপ্ত গ্যাসের ঢেউ উঠানামা করছে। দেখতে এগুলোকে টগবগে ফুটন্ত আগুনের দানার মত লাগে। পৃথিবী থেকে আগুনের দানাগুলোকে দেখতে ছোট মনে হতে পারে, কিন্তু ওগুলোর এক একটার আকার প্রায় এক হাজার কিলোমিটার। এত বড় দানাগুলো খুব বেশিক্ষণ থাকে না। আট মিনিটেই তা শেষ হয়ে যায়। তারপর আরেকটি তৈরি হয়। যে কোন সময় সূর্যের পৃষ্ঠে প্রায় চল্লিশ লাখ আগুনের দানা ফুটতে থাকে। বিশেষ টেলিস্কোপ দিয়ে দেখলে দেখা যাবে সূর্যের উপরিতল ঘন কমলা হলুদ রঙের ফুটন্ত কড়াইয়ের মত সেখানে মাঝে মাঝে কিছু কালো দাগ এসে আবার মিলিয়ে যাচ্ছে। এই কালো দাগগুলোকে সৌরকলঙ্ক বা সোলার স্পট বলা হয়।


সৌরকলঙ্ক
 সূর্যের ফটোস্ফিয়ার বা আলোকমন্ডলে কিছু কালো দাগ দেখা যায়। এগুলোকে সৌরকলঙ্ক বলা হয়। সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের দরুণ এই সোলার স্পট তৈরি হয়। চৌম্বকক্ষেত্র মাঝে মাঝে প্লাজমার প্রবাহে বাধা দেয়। কিছু সময়ের জন্য তাপমাত্রার প্রবাহ কোন কোন স্থানে ধীর হয়ে পড়ে। ফলে ঐ স্থান পার্শ্ববর্তী স্থানের চেয়ে কিছুটা ঠান্ডা থাকে। তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণে ঠান্ডা জায়গাটুকুকে কালো দেখায়।



চিত্র: সৌরকলঙ্ক

কালো জায়গাগুলোতে চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রাবল্য অত্যন্ত বেশি। পৃথিবীর চৌম্বকক্ষেত্রের প্রায় দশ হাজার গুণ বেশি। আর সুর্যের অন্য অংশের যে চৌম্বক প্রাবল্য তার প্রায় তিন হাজার গুণ বেশি।


 চিত্র সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্র। ১৯৯৩ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি তোলা হয় এ ছবি। কালো অংশ হলো ধনাত্মক চৌম্বক ক্ষেত্র আর সাদা অংশ হলো ঋণাত্মক চৌম্বকক্ষেত্র।


এই সৌর কলঙ্কের আকার এক হাজার কিলোমিটার থেকে শুরু করে এক লাখ কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে। এগুলো এক ঘন্টা থেকে শুরু করে কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত থাকতে পারে সূর্যের গায়ে। ১৫১৩ সালে গ্যালিলিও সর্বপ্রথম এই সৌরকলঙ্ক পর্যবেক্ষণ করেন। নিজের তৈরি দূরবীণ দিয়েই তিনি তা দেখেছিলেন।
            সৌরকলঙ্ক সব সময় জোড়ায় জোড়ায় দেখা যায়। তাদের তাপমাত্রা প্রায় পাঁচ হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। আলোকমন্ডলের গড় তাপমাত্রা এগারো হাজার ডিগ্রি সেলসিয়াস। সে হিসেবে সৌরকলঙ্কের তাপমাত্রা প্রায় ছয় হাজার ডিগ্রি কম। এগুলো আকারে পৃথিবীর চেয়েও বড় হতে পারে। কিন্তু এগুলো যে চৌম্বকক্ষেত্রের কারণে হয় তা জানা ছিল না ১৯০৮ সাল পর্যন্ত। বিজ্ঞানী জর্জ হেইল এই ব্যাপারটা আবিষ্কার করেন।



চিত্র: সৌরকলঙ্কের চার পাশে সূর্যের উপরিতল এরকম এবড়োখেবড়ো হয়ে যায়। প্রচুর শক্তির উত্থান ও নির্গমনের ফলে এরকম হয়।


প্রতি ১১ বছর পরপর সৌরকলঙ্ক দেখা যায়। ২০০১ সালের পর ২০১২ সালে আবার দেখা গেছে তাদের। কেন ১১ বছর পর পর এটা হয় তার কারণ এখনো ঠিকমতো জানা যায়নি। সৌরকলঙ্ক একেক বছর একেক রকমের হতে পারে। কোন বছর ১০০টাও হতে পারে, কোন বছর ১০টারও কম হতে পারে। যখন বেশি কলঙ্ক হয় তখন পৃথিবীর তাপমাত্রাও কিছুটা বেড়ে যেতে পারে। গড়ে প্রতি ১১ বছরে সৌরকলঙ্ক খুব বেড়ে যায়। আবার আস্তে আস্তে খুব কমে যায়।
            যখন সৌরকলঙ্ক ঘটে তখন সূর্যের উজ্জ্বলতা অনেক বেড়ে যায়। কারণ চৌম্বক প্রাবল্যের আধিক্যের কারণে যে তাপমাত্রা কমে যায় তাকে মিটিয়ে দেয়ার জন্য আরো অনেক উজ্জ্বল রশ্মি সৌরকলঙ্ককে ঘিরে রাখে।


সৌরঝড়
 সূর্যের আবহাওয়া মোটেও শান্ত নয়। সৌরঝড় ওঠে সূর্যপৃষ্ঠে। পৃথিবীর ঝড়ের মতো নয় এই ঝড়। সৌরঝড় তড়িৎ ও চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রবাহের ফলে সৃষ্টি হয়। ক্রোমোস্ফিয়ার থেকে বিশাল বিশাল গ্যাসের ঢেউ উঠে উপচে পড়ে কোরোনা অবধি। সূর্যের চৌম্বক ক্ষেত্রের প্রভাবে যখন সৌরকলঙ্ক দেখা যায় তখন এই ঢেউগুলো দেখা যায়। কয়েক হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত হতে পারে একেকটি ঢেউ। কয়েক সপ্তাহ ধরে থাকতে পারে এই ঢেউ।



চিত্র: সৌরঝড়

সৌরঝড়ের সময় মাঝে মাঝে বড় বড় গ্যাসের স্তম্ভ তীরের ন্যায় বেরিয়ে আসে সূর্যের ক্রোমোস্ফিয়ার বা বর্ণমণ্ডল থেকে। মাঝে মাঝে হঠাৎ বিশাল পরিমাণ শক্তি বেরিয়ে আসে আগুনের বন্যার মতো। এই শক্তিগুলোকে ধরে রাখার কোন ব্যবস্থা থাকলে একটা নির্গমনের শক্তিতেই আমাদের পৃথিবীর দশ লক্ষ বছর চলে যেতো।


চিত্র: সৌরঝড়

নিচের ছবিতে সূর্যের জ্বলে ওঠা শিখা (ফ্লেয়ার) দেখা যাচ্ছে। নাসার স্কাইল্যাব স্পেস স্টেশন থেকে এই ছবি তোলা হয়েছিল ১৯৭৩ সালের ১৯ ডিসেম্বর।



চিত্র: সৌরশিখা


এরকম সৌরশিখা খুব কমই রেকর্ড করা হয়েছে। সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের প্রভাবে এই শিখার সৃষ্টি। সূর্যপৃষ্ঠে এই শিখার বিস্তার প্রায় ছয় লক্ষ কিলোমিটার।
            নিচের ছবিটা সূর্যের একটা অত্যাশ্চর্য ছবি। সূর্যের বাইরের আবহাওয়ামন্ডলের ১৫ লাখ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রার গ্যাসের এই ছবি রেকর্ড করা হয় ১৯৯৬ সালের ১৩ মার্চ এক্সট্রিম আলট্রাভায়োলেট ইমেজিং টেলিস্কোপের সাহায্যে। টেলিস্কোপটি ছিল সোলার ও হেলিওস্ফেরিক অবজারভেটরি (SOHO) স্পেসক্রাফ্‌টে। অতি উচ্চক্ষমতাসম্পন্ন যন্ত্রপাতির সাহায্যে সূর্যের চৌম্বকক্ষেত্রের অনেক খুঁটিনাটি দেখা গেছে এই ছবিতে যা আগে কখনো দেখা সম্ভব হয়নি।



চিত্র: সূর্যের আবহাওয়ামণ্ডল


পরের পৃষ্ঠার ছবিটি দেখো। সূর্যের এক্স-রে ইমেজটি নেয়া হয়েছে ১৯৯৪ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি। উজ্জ্বল অংশটুকু থেকে অতিরিক্ত এক্স-রে বের হচ্ছে।

চিত্র: সূর্যের এক্স-রে ছবি


সূর্যের আবহাওয়ার প্রভাব পৃথিবীর ওপরও এসে পড়তে পারে। সৌরঝড় উঠলে মহাশূন্যে তার প্রভাব পড়ে। আমাদের পৃথিবীর আবহাওয়ামন্ডলেও তার প্রভাব দেখা যায়। পৃথিবীর ঘন আবহাওয়ামণ্ডল সৌরঝড়ের প্রভাব থেকে আমাদের রক্ষা করে। তবে ঐ সময় পৃথিবীর টেলিকমিউনিকেশানে ব্যাপক বাধা পড়ে। মহাশূন্যে স্থাপিত যোগাযোগের উপগ্রহগুলোর কাজে বাধা পড়ে সৌরঝড়ের কারণে।


সূর্যের ঘূর্ণন

সূর্যকে কেন্দ্র করে গ্রহগুলো ঘুরে। কিন্তু সূর্য নিজে স্থির নয়। সে নিজেও নিজের অক্ষের ওপর ঘুরে। প্রায় এক মাস সময় লাগে তার নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরে আসতে। যেহেতু থলথলে গ্যাস দিয়ে তৈরি তাই সূর্যের সব অংশ সমান বেগে ঘুরতে পারে না। কোন অংশ আস্তে, আবার কোন অংশ দ্রুত ঘুরে। মধ্যবর্তী স্থান একবার ঘুরে আসতে ২৫ দিনের মতো লাগে। বাইরের দিকে ক্রমশ সময় বেশি লাগে। একেবারে বাইরে উপরে ও নিচের গ্যাসসহ ঘুরতে ৩৫ দিনের মতো সময় লাগে। নিচের ছবিতে সূর্যের নিজের অক্ষের ওপর একবার ঘুরে আসতে কত সময় লাগে তার একটা চিত্র দেয়া হলো।



চিত্র: সূর্যের ঘূর্ণন


নিজের অক্ষের ওপর ঘুরতে ঘুরতে সূর্য আবার ছায়াপথ বা মিল্কিওয়ের চারপাশেও ঘুরে। মিল্কিওয়ের চারপাশে সূর্য সেকেন্ডে প্রায় ২৪০ কিলোমিটার বেগে ঘুরছে। (ঢাকা থেকে চট্টগ্রামের দূরত্ব এক সেকেন্ডে অতিক্রম করে)। এই গতিতে ঘুরলেও সূর্যের প্রায় ২২ কোটি বছর লেগে যায় মিল্কিওয়ের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে। (হিসেব করে দেখতে পারো মিল্কিওয়ের আকার কত বড়।) মিল্কিওয়ের মহাকর্ষ বল সূর্যকে তার কক্ষপথে ধরে রাখে। সূর্য মিল্কিওয়ের অরিয়ন বাহুতে অবস্থিত যা মিল্কিওয়ের কেন্দ্র থেকে প্রায় অর্ধেক দূরত্বে অবস্থিত।

__________________

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts