Tuesday 24 October 2023

মিশন আর্টেমিস: আবার চাঁদে

 




“গগনের থালে, রবি চন্দ্র দীপক জ্বলে” – রবীন্দ্রনাথের কথাগুলি খুবই সত্যি, সুন্দর। পৃথিবীর আকাশে উজ্জ্বলতম সূর্যের পরেই উজ্জ্বলতর বস্তু আমাদের চাঁদ। যদিও তার নিজের আলো নেই, সূর্যের আলোর প্রতিফলনেই সে এতটা জোছনাময়ী – সেই আমাদের পৃথিবীর একমাত্র প্রাকৃতিক উপগ্রহ। মহাকাশে আমাদের নিকটতম প্রাকৃতিক প্রতিবেশী সে, পৃথিবী থেকে মাত্র তিন লক্ষ চুরাশি হাজার কিলোমিটার দূরত্বে পৃথিবীর চারপাশে ঘুরছে। এই দূরত্ব খুব একটা বেশি নয়। ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম যাঁরা গাড়ি নিয়ে নিয়মিত যাতায়াত করেন – দুবছর যাতায়াত করলেই তাঁরা এই দূরত্ব পেরিয়ে যান। কিন্তু পৃথিবীর পরিবেশে দূরত্ব পাড়ি দেয়া যতটা সহজ, পৃথিবী থেকে মহাকাশ পাড়ি দিয়ে চাঁদে পৌঁছানো ততটা সহজ নয়। কিন্তু মানুষ এই কঠিন কাজটি করে ফেলেছে আজ থেকে পঞ্চাশ বছর আগে – যখন মহাকাশ প্রযুক্তি আজকের তুলনায় অনেকটাই সীমিত ছিল। 


১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই চাঁদের বুকে প্রথম পা রেখেছিল পৃথিবীর মানুষ। সেদিন চাঁদে নামার আগের মুহূর্তে লুনার মডিউলের সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে নীল আর্মস্ট্রং বলেছিলেন, “I am going to step off the LM now. That’s one small step for a man, one giant leap for mankind.” সেদিন একজন মানুষের একটি ছোট্ট পদক্ষেপ ছিল সমগ্র মানবজাতির একটি বিশাল উল্লম্ফন। চাঁদের বুকে এই ‘ছোট্ট পদক্ষেপ’ দেয়ার জন্য দীর্ঘ পরিশ্রম করতে হয়েছে মহাকাশবিজ্ঞানী, প্রযুক্তিবিদসহ অসংখ্য মানুষকে বছরের পর বছর। ধরতে গেলে সেই সময় মানুষের চাঁদে যাওয়ার ব্যাপারটি ছিল মূলত আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যে প্রতিযোগিতার ফসল। সেই প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার পর পর। ১৯৪৬ সালে আমেরিকা চাঁদের উদ্দেশ্যে প্রথম বেতারতরঙ্গ পাঠায়। চাঁদের উদ্দেশ্যে প্রথম স্যাটেলাইট ‘স্পুটনিক’ পাঠায় সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৫৭ সালে। এরপর তারা ১৯৫৯ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত মোট চব্বিশটি ‘লুনা মিশন’ পরিচালনা করে চাঁদের উদ্দেশ্যে। তাদের বেশ কয়েকটি মিশন ব্যর্থ হলেও অনেকগুলি মিশন সফল হয়। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন চাঁদে মানুষ পাঠানোর পরিকল্পনা করেনি। এদিকে আমেরিকা ১৯৫৮ থেকে ১৯৬৫ পর্যন্ত পাইওনিয়ার ও র‍্যাঞ্জার প্রকল্পের আওতায় চাঁদের উদ্দেশ্যে আঠারোটি মিশন চালিয়ে মাত্র তিনটিতে আংশিক সফল হয়। এরপর ১৯৬৬ থেকে ১৯৬৮’র মধ্যে চাঁদের বুকে রোবট পাঠিয়ে ছবি ও ভূতাত্ত্বিক তথ্য সংগ্রহের জন্য সাতটি সার্ভেয়ার মিশন পরিচালনা করে। সাতটির মধ্যে পাঁচটি মিশন সফল হয়। ১৯৬৬-৬৭ সালে লুনার অরবিটার প্রোগ্রামের পাঁচটি মিশন চালানো হয় সফলভাবে। এরপর আসে মানুষের চাঁদে যাওয়ার অ্যাপোলো প্রোগ্রাম। কিন্তু প্রথম মিশন অ্যাপোলো-১ উৎক্ষেপণের সময়েই আগুন লেগে পুড়ে মারা যান তিনজন নভোচারী গাস গ্রিসম, এড হোয়াইট এবং রজার শ্যাফি। চাঁদে যাওয়ার জন্য মানুষের অভিযাত্রা তাতেও দমে যায়নি। এরপর অ্যাপোলো প্রকল্পের আওতায় আরো অ্যাপোলো-২ থেকে অ্যাপোলো-১৭ পর্যন্ত মিশন পরিচালনা করা হয়েছে। অ্যাপোলো-১১ সর্বপ্রথম চাঁদে নামে ১৯৬৯ সালের ২০ জুলাই। নীল আর্মস্ট্রং এবং এডউইন অলড্রিন চাঁদে নামেন। মানুষের চন্দ্রবিজয় সেখানেই থেমে থাকেনি। সেবছরই নভেম্বর মাসে চাঁদে পৌঁছায় অ্যাপোলো-১২। চাঁদে নামেন চার্লস কনরাড ও অ্যালেন বিন। ১৯৭০ সালে অ্যাপোলো-১৩ চাঁদের উদ্দেশ্যে রওনা হলেও যান্ত্রিক গোলযোগের জন্য চাঁদে পৌঁছাতে পারেনি। ১৯৭১ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি চাঁদে পৌঁছায় অ্যাপোলো-১৪। চাঁদে নামেন অ্যালেন শেপার্ড ও এডগার মিশেল। এর পাঁচ মাস পর জুলাই মাসে চাঁদে পৌঁছায় অ্যাপোলো-১৫। চাঁদে নামেন ডেভিড স্কট ও জেমস ইরউইন। ১৯৭২ সালের এপ্রিলে চাঁদে পৌঁছায় অ্যাপোলো-১৬।  চাঁদে নামেন জন ইয়ং এবং চার্লস ডিউক। অ্যাপোলো-১৭ ছিল মানুষের চাঁদে যাবার সর্বশেষ মিশন। ১৯৭২ সালের ১১ নভেম্বর চাঁদে নামেন ইউজিন কারনান ও হ্যারিসন স্মিট। তিন দিন দুই ঘন্টা ৫৯ মিনিট তাঁরা চাঁদের বুকে ছিলেন সেবার। এরপর দীর্ঘ পঞ্চাশ বছর কেটে গেছে – মানুষ আর চাঁদে যায়নি। 


অ্যাপোলো-১৭ মিশনের কমান্ডার নভোচারী ইউজিন কারনান হলেন সর্বশেষ মানুষ যিনি চাঁদের মাটিতে হেঁটেছেন। তিনি একটি বই লিখেছেন ‘দ্য লাস্ট ম্যান অন দ্য মুন’ নামে (The Last Man on the Moon, St. Matin’s Griffin, New York, 2009) । অ্যাপোলো মিশনের কমান্ডার হিসেবে তিনিই ছিলেন চাঁদের বুকে সর্বশেষ মানুষ। কিন্তু তাঁর এই তকমা বদলে যাবে আগামী কয়েক বছরের মধ্যেই। চাঁদে যাওয়ার নতুন মিশন শুরু হয়ে গেছে। এখন চলছে চাঁদে মানুষের দ্বিতীয় অভিযান – মিশন আর্টেমিস। 


মানুষের উদ্ভবের আগে থেকেই চাঁদ-সূর্য-গ্রহ-নক্ষত্রগুলি মহাবিশ্বে আলো ছড়াচ্ছে। তাই মানুষের কাল্পনিক লোককাহিনিতে চন্দ্র-সূর্যের নানারকমের অলৌকিক অবস্থান ও পরিচিতি। লোকসংস্কৃতির সম্মানে মানুষের চাঁদে যাবার প্রথম অভিযানের নাম দেয়া হয়েছিল গ্রিক দেবতা অ্যাপোলোর নামে। এবার দ্বিতীয় পর্যায়ের চন্দ্রাভিযানের নাম রাখা হয়েছে গ্রিক দেবী আর্টেমিসের নামে। লোককাহিনির অ্যাপোলো আর আর্টেমিস জমজ ভাইবোন হলেও - মিশন অ্যাপোলোর কার্বনকপি নয় মিশন আর্টেমিস। অ্যাপোলোর চেয়ে অনেক বেশি উন্নত এবং ব্যাপ্ত মিশন আর্টেমিস। 


১৯৬৯ সালে মানুষ যখন প্রথমবার চাঁদে যায় তখন কম্পিউটার প্রযুক্তি ছিল অত্যন্ত সীমিত। এখনকার মতো মানুষের হাতে হাতে আধুনিক কম্পিউটার থাকা তো দূরের কথা – কম্পিউটারের নামও তখন সাধারণ মানুষ শোনেনি। যে লুনার মডিউল ‘ঈগল’ প্রথম চাঁদে নামে তার কম্পিউটারের মেমোরি ছিল মাত্র ৭৪ কিলোবাইট। এখনকার শিশুদের খেলনা ইলেকট্রনিক্সেও এর চেয়ে বেশি মেমোরি থাকে। তাই ১৯৬৯-৭২ সালের চন্দ্রাভিযানের চেয়ে ২০২২-২৫ সালের চন্দ্রাভিযান অনেক বেশি উন্নত হবে সেটাই স্বাভাবিক। তাই  এবারের চন্দ্রমিশনের ব্যাপ্তিও বেড়েছে অনেক। মিশন আর্টেমিস – শুধু চাঁদে যাওয়া নয় – চাঁদে বসবাস করারও একটি সুদূরপ্রসারী মিশন। চাঁদের কক্ষপথে এবং চাঁদের মাটিতে স্থায়ী মহাকাশ স্টেশন স্থাপন করার উদ্দেশ্যও আছে এই আর্টেমিস মিশনের সাথে। 


আর্টেমিস মিশনের উদ্দেশ্যগুলিকে - সমতা, প্রযুক্তি, অংশীদারিত্ব, স্থায়ীত্ব, জ্ঞান এবং সম্পদ – এই ছয়টি প্রধান ভাগে ভাগ করা যায়। 

(১) সমতা: ১৯৬৯ থেকে ১৯৭২ পর্যন্ত যে ছয়টি মিশনে বারো জন নভোচারী চাঁদের বুকে পা রেখেছেন – তাঁদের প্রত্যেকেই শ্বেতাঙ্গ পুরুষ। এবারের চন্দ্রাভিযানে নাসা উদ্যোগ নিয়েছে নভোচারীদের মধ্যে লিঙ্গ এবং বর্ণবৈষম্য দূর করার। তাই এই আর্টেমিস মিশনে প্রথমবার একজন নারী এবং একজন অশ্বেতাঙ্গ পুরুষ নভোচারী চাঁদে যাবেন বলে ঠিক করা হয়েছে। ইতোমধ্যে নাসা চাঁদে যাবার প্রথম নভোচারীদল নির্বাচন করে ফেলেছে। আর্টেমিস-২ ও আর্টেমিস-৩ মিশনে যে চারজন নভোচারী চাঁদে যাবেন তাঁরা হলেন – কমান্ডার রেইড ওয়াইজম্যান, পাইলট ভিক্টর গ্লোভার, মিশন স্পেশালিস্ট-১ ক্রিস্টিনা হ্যামক কোচ, এবং মিশন স্পেশালিস্ট-২ জেরেমি হ্যানসেন। ভিক্টর গ্লোভার হবেন প্রথম অশ্বেতাঙ্গ নভোচারী যিনি চাঁদে যাবেন। আর ক্রিস্টিনা কোচ হবেন প্রথম নারী নভোচারী যিনি চন্দ্রবিজয় করবেন। 


 

কমান্ডার রেইড ওয়াইজম্যান, পাইলট ভিক্টর গ্লোভার, মিশন স্পেশালিস্ট-১ ক্রিস্টিনা হ্যামক কোচ, এবং মিশন স্পেশালিস্ট-২ জেরেমি হ্যানসেন।


(২) প্রযুক্তি: আর্টেমিস মিশনের জন্য সর্বাধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে রকেট থেকে স্পেসস্যুট পর্যন্ত সবকিছু তৈরি করা হয়েছে – যা ভবিষ্যতে আরো দূরের মহাকাশযাত্রায় কাজে লাগবে। আর্টেমিস মিশনে জ্ঞান-বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির আধুনিকতম সংস্করণ ব্যবহার করা হচ্ছে এবং আরো নতুন নতুন প্রযুক্তির উদ্ভাবন হচ্ছে। 

(৩) অংশীদারিত্ব: আমেরিকান মহাকাশ সংস্থা নাসা এবার অন্যান্য দেশের মহাকাশ সংস্থার পাশাপাশি অন্যান্য বেসরকারি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান – যেমন স্পেস-এক্স, বোয়িং ইত্যাদির সাথে যৌথ অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এই মিশন পরিচালনা করছে। প্রথম চারজন নভোচারীর মধ্যে একজন (জেরেমি হ্যানসেন) কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সির নভোচারী। 

(৪) স্থায়ীত্ব: অ্যাপোলো মিশনের চেয়ে দীর্ঘস্থায়ী হবে আর্টেমিস মিশনের সময়কাল। অ্যাপোলো-১৭’র নভোচারীরা সর্বাধিক তিন দিন অবস্থান করেছিলেন চাঁদের পিঠে। আর্টেমিসের নভোচারীদের চাঁদের পিঠে সপ্তাহেরও বেশি সময় থাকার পরিকল্পনা করা হয়েছে। ভবিষ্যতের মিশনে লুনার গেটওয়ে স্টেশনের মাধ্যমে তিন মাস পর্যন্ত নভোচারীদের চাঁদে থাকার পরিকল্পনা করা হয়েছে।

(৫) নতুন জ্ঞান: অ্যাপোলো মিশনের পরবর্তী পঞ্চাশ বছরে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতি হয়েছে অনেক। এই উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে আর্টেমিস মিশনের নভোচারীরা চাঁদের অনেক অজানা তথ্য আবিষ্কার করতে পারবেন যা এতদিন জানা সম্ভব হয়নি। এই মিশন শুধুমাত্র চাঁদে সীমাবদ্ধ থাকবে না। ভবিষ্যতের আর্টেমিস মিশন চাঁদ থেকে মঙ্গল পর্যন্ত বিস্তৃত হবে। 

(৬) চাঁদের সম্পদ: চাঁদে পানি এবং অন্যান্য দুষ্প্রাপ্য খনিজ সম্পদ পাওয়ার সম্ভাবনা আছে। এই মিশন সেই সম্ভাবনার সাথে বাস্তবের সমন্বয় করতে সক্ষম হবে। এই সম্পদকে কাজে লাগিয়ে চাঁদে স্থায়ী মহাকাশ স্টেশন তৈরি করে সেখান থেকে ভবিষ্যতের মহাকাশ মিশন চালানোর সম্ভাবনা বাড়বে। 


নাসার এযাবৎকালের মধ্যে সবচেয়ে সুদূরপ্রসারী মিশন আর্টেমিস। এই মিশনে চারজন নভোচারী চাঁদে যাবেন এবং চাঁদ পেরিয়ে মহাকাশের আরো চৌছট্টি হাজার কিলোমিটার গভীরে পৌঁছে যাবেন যেখানে এপর্যন্ত আর কোনো নভোচারী যাননি। যে নভোযানে চড়ে নভোচারীরা যাবেন তার নাম অরিয়ন। সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে তৈরি এই নভোযান এপর্যন্ত পৃথিবীতে একমাত্র নভোযান যা নভোচারীদের মহাকাশের গভীরে নিয়ে গিয়ে আবার নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরিয়ে নিয়ে আসতে পারবে। এই আধুনিকতম নভোযান মহাকাশে পাঠানোর জন্য তৈরি করা হয়েছে সবচেয়ে শক্তিশালী রকেটসমৃদ্ধ স্পেস লঞ্চিং সিস্টেম। এই প্রজেক্টে প্রাথমিকভাবে খরচ হচ্ছে প্রায় একশ বিলিয়ন ডলার বা দশ লক্ষ কোটি টাকা। 


প্রাথমিকভাবে আর্টেমিস-১, আর্টেমিস-২, এবং আর্টেমিস-৩ এর বিস্তারিত কর্মসূচি এবং কর্মপরিকল্পনা ঘোষিত হয়েছে। তিনটি মিশন-ই চাঁদে যাওয়ার মিশন। আর্টেমিস-১ মিশন হলো চাঁদে যাবার প্রাথমিক মিশন যেখানে নভোযান উৎক্ষেপণ থেকে শুরু করে চাঁদের চারপাশে ঘুরে আসা পর্যন্ত চন্দ্রাভিযানের সবগুলি ধাপ পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে নভোচারীদের ছাড়াই। ইতোমধ্যে ১৬ নভেম্বর ২০২২ থেকে ১১ ডিসেম্বর ২০২২ পর্যন্ত  আর্টেমিস-১ মিশন সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। এখন সেই মিশনের ফলাফল বিশ্লেষণ এবং পর্যালোচনা চলছে। এই মিশনের বিস্তারিত আমরা একটু পরে আলোচনা করছি। আর্টেমিস-২ মিশনে নভোচারীরা মহাকাশে গিয়ে চাঁদের চারপাশে ঘুরে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, এবং আর্টেমিস-৩ মিশনে নভোচারীরা চাঁদে অবতরণ করবেন এবং সপ্তাহখানেক সেখানে থেকে নিরাপদে পৃথিবীতে ফিরে আসবেন। আশা করা হচ্ছে ২০২৪ সালে আর্টেমিস-২ এবং ২০২৫ সালে আর্টেমিস-৩ মিশন কার্যকর হবে। 


আর্টেমিস মিশনের যান্ত্রিক গঠনের চারটি প্রধান অংশ: (১) নভোযান – অরিয়ন, (২) লুনার গেটওয়ে, (৩) হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম (এইচ এল এস), এবং (৪) স্পেস লঞ্চ সিস্টেম (এস এল এস) ।


আর্টেমিস মিশনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশ হলো এর নভোযান – অরিয়ন। পৃথিবীবিখ্যাত নভোযান প্রস্তুতকারি সংস্থা লকহিড মার্টিন তৈরি করেছে এই অত্যাধুনিক নভোযান অরিয়ন। এখনো পর্যন্ত অরিয়ন হলো পৃথিবীর সবচেয়ে আধুনিক নভোযান। এই নভোযান চন্দ্রাভিযানের নভোচারীদের প্রচন্ড বেগে নিয়ে যাবে গভীর মহাকাশে, আবার নিরাপদে ফিরিয়ে নিয়ে আসবে পৃথিবীতে। মহাকাশের তেজস্ক্রিয় থেকে রক্ষা করবে নভোচারীদের। আবার পৃথিবীতে ফেরার সময় পৃথিবীর বায়ুমন্ডলের সাথে প্রচন্ড সংঘর্ষে যে অসহ্য তাপ উৎপন্ন হবে – রক্ষা করবে সেই তাপ থেকেও। অরিয়ন নভোযান অনেকবার ব্যবহার করা যাবে। আর্টেমিস-১ মিশনে অরিয়ন ইতোমধ্যে চাঁদের পাশ থেকে ঘুরে এসেছে। আবার অরিয়ন-২ ও ৩ মিশনে নভোচারীদের নিয়ে যাবে চাঁদে।  

অরিয়নের তিনটি প্রধান অংশ – লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম, ক্রু মডিউল, এবং সার্ভিস মডিউল। তিনটি অংশের দৈর্ঘ্য ৬৭ ফুট। স্পেস লঞ্চ সিস্টেম রকেটের উপর লাগানো অবস্থায় এর উচ্চতা ৩২২ ফুট। চারজন নভোচারী নিয়ে এই নভোযান মহাকাশে একুশ দিন পর্যন্ত থাকতে পারবে। ৭৭,১৫০ ধরনের ৩,৫৫,০৫৬টি যন্ত্রাংশের সমন্বয়ে তৈরি হয়েছে অরিয়ন। 


 



মহাকাশে নভোচারীদের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিখুঁত হওয়াটা সবচেয়ে জরুরি। প্রথমবার চন্দ্রাভিযানের সময় অ্যাপোলো-১ এর তিনজন নভোচারীর মর্মান্তিক মৃত্যু ঘটেছিল। সেরকম দুর্ঘটনা যেন আর না ঘটে সেজন্য নিশ্চিদ্র ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে অরিয়নে। এই ব্যবস্থার নাম লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম। স্পেস লঞ্চ সিস্টেমের রকেটের সাহায্যে উৎক্ষেপণের সময় অরিয়নের ক্রু মডিউলের সামনে পঞ্চাশ ফুট দৈর্ঘ্যের এই লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম লাগানো থাকে। এই সিস্টেমের দুইটি অংশ – ফেয়ারিং অ্যাসেম্বলি এবং লঞ্চ অ্যাবর্ট টাওয়ার। ফেয়ারিং অ্যাসেম্বলি হালকা যৌগিক ধাতুর তৈরি প্রকোষ্ঠ যেটা উৎক্ষেপণের সময় উৎপন্ন তাপ, বাতাস এবং শব্দ থেকে অরিয়নকে রক্ষা করে। লঞ্চ অ্যাবর্ট টাওয়ারে লাগানো থাকে তিনটি অত্যন্ত শক্তিশালী যান্ত্রিক মোটর যেগুলি প্রায় চার লক্ষ পাউন্ড ধাক্কা তৈরি করতে পারে। উৎক্ষেপণের সময় যদি কোন যান্ত্রিক ত্রুটি বা অন্য কোন কারণে যদি নভোচারীদের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হবার সম্ভাবনা দেখা দেয় – লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেমের মোটরগুলি চালু হয়ে অরিয়নের ক্রু মডিউলে অবস্থানরত নভোচারীদের নিয়ে ক্রু মডিউলটিকে অরিয়ন থেকে বিচ্ছিন্ন করে সেকেন্ডের ভগ্নাংশের মধ্যে নিরাপদ জায়গায় উড়ে যায়। লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেমের বেগ শূন্য থেকে ঘন্টায় ৮০০ কিলোমিটার উঠে যেতে পারে দুই সেকেন্ডের মধ্যে। অথচ একটি বোয়িং-৭৪৭ প্লেনের গতিবেগ ঘন্টায় শূন্য থেকে ৩৬০ কিলোমিটারে উঠতে কমপক্ষে দশ সেকেন্ড সময় লাগে। যদি কোন দুর্ঘটনা না ঘটে এবং সবকিছু ঠিকঠাকমতো উৎক্ষেপণ হয়, তখন অরিয়নের লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেমের আর কোন কাজ থাকে না। সেক্ষেত্রে শুধু শুধু এই পঞ্চাশ মিটার লম্বা যন্ত্রাংশ নিয়ে মহাকাশে ঢোকার কোন মানে থাকে না। যখন আর কোন বিপদের সম্ভাবনা থাকে না তখন অরিয়ন থেকে এই লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম আলাদা হয়ে যায়। তখন অরিয়নের ক্রু মডিউল আর সার্ভিস মডিউল নিয়ে চাঁদের পানে চলতে থাকে স্পেস লঞ্চিং সিস্টেমের রকেট। 


অরিয়নের ক্রু মডিউল হলো মিশন চলাকালীন নভোচারীদের আবাসস্থল। এগারো ফুট উচ্চতা এবং সাড়ে ষোল ফুট ব্যাসের এই চোঙাকৃতি জায়গায় চারজন নভোচারীর থাকার ব্যবস্থা। উৎক্ষেপণের সময় থেকে শুরু করে পৃথিবী থেকে চাঁদে পৌঁছে আবার পৃথিবীতে ফিরে আসা পর্যন্ত সর্বোচ্চ একুশদিন পর্যন্ত এখানে স্বচ্ছন্দে থাকতে এবং প্রয়োজনীয় কাজ করতে পারবেন চারজন নভোচারী। পৃথিবী থেকে চাঁদে যাবার সময় ক্রু মডিউল এবং সার্ভিস মডিউল একসাথে গেলেও পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় শুধুমাত্র এই ক্রু মডিউলটাই ফিরে আসবে নভোচারীদের নিয়ে। ক্রু মডিউলের ভেতর নভোচারীদের বাসোপযোগী পরিবেশ তৈরি করা হয়েছে। তাপমাত্রা, বায়ুচাপ, আর্দ্রতা, অক্সিজেনের মাত্রা, কার্বন-ডাই-অক্সাইডের মাত্রা প্রভৃতি স্বাস্থ্যকর পর্যায়ে রাখা হয়। স্বচ্ছ শক্ত কাচের জানালাযুক্ত ককপিট থেকে নভোচারীরা অরিয়নের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন। ক্রু মডিউলের দেয়াল এমনভাবে তৈরি যেন মহাকাশের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মডিউলের ভেতর প্রবেশ না করতে পারে। মিশন চলাকালীন এই মডিউলই হবে নভোচারীদের ঘরবাড়ি। এখানেই তাদের খাওয়া-পরার ব্যবস্থা, এখানেই ওজনহীন পরিবেশে তাদের টয়লেট করার ব্যবস্থা। নভোচারীদের সুস্থ থাকার জন্য নিয়মিত ব্যায়াম করতে হয়। এই মডিউলে তার ব্যবস্থাও আছে। 


ক্রু মডিউলের নিচে লাগানো থাকে সার্ভিস মডিউল। ইওরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি এই মডিউলের সব ব্যবস্থা করেছে বলে অরিয়নের এই মডিউলের নাম ইওরোপিয়ান সার্ভিস মডিউল। সার্ভিস মডিউল হলো নভোযানের পাওয়ার হাউজ। এখানেই সৌরপ্যানেল থেকে বিদ্যুৎ উৎপন্ন হয়, এখানেই ইঞ্জিন এবং থ্রাস্টার। অরিয়নের সার্ভিস মডিউলের দৈর্ঘ্য ১৫.৭ ফুট এবং ব্যাস ১৬.৫ ফুট। আর্টেমিস-১ মিশনে এর ভর ৩৩,৭০০ পাউন্ড, আর্টেমিস-২ মিশনে এর ভর হবে ৩৪,৪০০ পাউন্ড। ছয় হাজার পাউন্ড ধাক্কা তৈরি করার ক্ষমতাসম্পন্ন একটি ইঞ্জিন আছে যেটা দিয়ে অরিয়নকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়। এই প্রধান ইঞ্জিনকে সাহায্য করার জন্য রয়েছে আটটি সাহায্যকারী ইঞ্জিন – যেগুলির প্রত্যেকে ১১০ পাউন্ড ধাক্কা তৈরি করতে পারে। গতি-প্রতিক্রিয়া সামলানোর জন্য রয়েছে আরো চব্বিশটি ছোট ইঞ্জিন – যেগুলি প্রত্যেকে ৫০ পাউন্ড ধাক্কা তৈরি করতে পারে। সৌরবিদ্যুৎ তৈরি করার জন্য রয়েছে পনের হাজার সৌরকোষ সমন্বিত চারটি সৌরপ্যানেল যেগুলি খুললে ৬২ ফুট লম্বা হয়। এগারো কিলোওয়াট বিদ্যুৎশক্তি তৈরি করতে পারে এই প্যানেলগুলি। 


আর্টেমিস মিশনে যতগুলি যন্ত্রপাতি ব্যবহার করা হবে তাদের সবগুলিই একাধিকবার আলাদা আলাদাভাবে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে আর্টেমিস-১ মিশন শুরু হবার আগে। আর্টেমিস-১ মিশনে পুরো সিস্টেমকে একসাথে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। স্পেস লঞ্চিং সিস্টেম থেকে শুরু করে অরিয়ন নভোযান। নভোচারীদের বদলে ডামি নভোচারী (মুনকিন) পাঠানো হয়েছিল এই মিশনে। 

পরপর চারবার উড্ডয়ন বাতিল হবার পর অবশেষে ১৬ নভেম্বর ২০২২ কেনেডি স্পেস সেন্টারের লঞ্চপ্যাড ৩৯বি থেকে আকাশে পাড়ি দেয় আর্টেমিস-১ মিশনের নভোযান অরিয়ন। উৎক্ষেপণের ৯০ সেকেন্ডের মধ্যেই অরিয়নকে নিয়ে রকেট পৌঁছে যায় সর্বোচ্চ বায়ুমন্ডলীয় শক্তির পর্যায়ে। দুই মিনিট পরে রকেট বুস্টার আলাদা হয়ে যায়। এর আট মিনিট পরে চারটি রকেট ইঞ্জিন অরিয়নকে আরো সামনের দিকে এগিয়ে দিয়ে রকেট এবং লঞ্চ অ্যাবর্ট সিস্টেম আলাদা হয়ে যায়। ক্রু মডিউল এবং সার্ভিস মডিউলসহ অরিয়ন তখন ইনট্রিম ক্রায়োজনিক প্রপালসান স্টেজের (আইসিপিএস) সাথে যুক্ত হয়ে চাঁদের দিকে এগিয়ে যেতে থাকে। পৃথিবীর চারপাশে একবার প্রদক্ষিণ করার পর সার্ভিস মডিউলের সোলার প্যানেল খুলে যায় এবং সৌরবিদ্যুৎ উৎপন্ন হতে শুরু করে। আইসিপিএস তখন অরিয়নকে একটি বড় ধাক্কা দিয়ে পৃথিবীর কক্ষপথে থেকে সরিয়ে চাঁদের দিকে ঠেলে দেয় এবং আইসিপিএস আলাদা হয়ে যায়। পঞ্চম দিনে (২০ নভেম্বর) নভোযান অরিয়ন চাঁদের প্রভাববলয়ে প্রবেশ করে। পৃথিবীর মহাকর্ষ বলের চেয়ে চাঁদের মহাকর্ষ বল এখানে বেশি। ষষ্ঠ দিবসে (২১ নভেম্বর) অরিয়ন চাঁদের পিঠের ১৩০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে যায়। চাঁদের পাশ দিয়ে উড়ে যায় অরিয়ন। অষ্টম দিবসে চাঁদের প্রভাববলয় থেকে বের হয়ে আসে অরিয়ন। আস্তে আস্তে চাঁদ থেকে দূরে সরে আসতে থাকে অরিয়ন। দশম দিবসে অরিয়ন নভোযান জ্বালানি পুড়িয়ে ‘ডিসট্যান্ট রেট্রোগ্রেড লুনার অরবিট’এ প্রবেশ করে। চাঁদের পিঠ থেকে অনেক দূরে উড়ছিল বলে এটা ডিসট্যান্ট। আর রেট্রোগ্রেড – কারণ এটা চাঁদ যেদিকে ঘুরছিল – তার বিপরীত দিকে ঘুরছিলো। একাদশ দিবসে (২৬ নভেম্বর) অরিয়ন মহাকাশে ইতিহাস তৈরি করে। নভোচারীদের বহন করার জন্য তৈরি নভোযান এর আগে মহাকাশের এত গভীরে আর প্রবেশ করেনি। এর আগে অ্যাপোলো-১৩ পৃথিবী থেকে ৪,০০,১৭১ কিলোমিটার দূরে উড়েছিল। অরিয়ন তেরোতম দিবসে ৪,৩২,২১০ কিলোমিটার দূরত্বে উড়েছিল। ১৬তম দিবসে (১ ডিসেম্বর) আরেকবার জ্বালানি পুড়িয়ে অরিয়ন ডিসট্যান্ট রেট্রোগ্রেড লুনার অরবিট থেকে বের হয়ে পৃথিবীর দিকে রওনা দেয়। ২০তম দিবসে (ডিসেম্বর ৫) অরিয়ন চাঁদের পিঠের আরো কাছাকাছি ১২৮ কিলোমিটারের মধ্যে উড়ে যায়। চাঁদের মাধ্যাকর্ষণ ব্যবহার করে অরিয়ন পৃথিবীর মাধ্যাকর্ষণের ভেতর চলে আসে। ডিসেম্বরের ১১ তারিখে সান দিয়েগোর তীরে প্রশান্ত মহাসাগরে অবতরণ করে অরিয়ন। আর্টেমিস-১ মিশনে পঁচিশ দিন ১০ ঘন্টা ৫৩ মিনিটে প্রায় তেইশ লক্ষ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়েছে অরিয়ন। 

 

আর্টেমিস-১ মিশন পৃথিবী থেকে চাঁদ প্রদক্ষিণ করে সফলভাবে পৃথিবীতে ফিরে এসেছে। অরিয়নের ক্রু মডিউলে নভোচারীদের সিটে তিনটি ডামি নভোচারী বসানো হয়েছিল। কমান্ডার মুনিকিনের (প্রধান ডামি) সিটের পেছনে এবং মাথার পেছনে দুটো সেন্সর বসানো হয়েছিল – মিশন চলাকালীন ত্বরণ ও কম্পনের মাত্রা রেকর্ড করার জন্য। ডামি নভোচারীর পোশাকের সাথে আরো পাঁচটি ত্বরণমাপক যন্ত্র বসানো হয়েছিল ত্বরণ রেকর্ড করার জন্য। হেলগা এবং জোহর নামে আরো দুটো ডামি নভোচারী পাঠানো হয়েছিল। তাদের শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ৫৬০০ পরোক্ষ বিকিরণমাপক যন্ত্র এবং ৩৪টি প্রত্যক্ষ বিকিরণমাপক যন্ত্র বসানো হয়েছিল মহাকাশের তেজস্ক্রিয় বিকিরণ মেপে দেখার জন্য। এই ডাটা থেকে দেখা যাবে আর্টেমিস-২ ও আর্টেমিস-৩ এর সময় নভোচারীরা বিকিরণ থেকে নিরাপদ থাকবেন কি না। 


আর্টেমিস-১ এর সাফল্যের পর এখন প্রস্তুতি চলছে আর্টেমিস-২ মিশনের। আর্টেমিস-২ মিশনে চারজন নভোচারীকে চাঁদে পাঠানো হবে দশ দিনের জন্য। চাঁদের উল্টোপিঠে অরিয়ন থেকে পরিক্রমা করবেন তাঁরা। এই মিশনে অরিয়নের উৎক্ষেপণ হবে আর্টেমিস-১ এর অনুরূপ। অরিয়ন এবং আইসিপিএস পৃথিবীকে দুবার প্রদক্ষিণ করে নিশ্চিত করবে যে সবগুলি সিস্টেম ঠিকমতো কাজ করছে। প্রথমবার পৃথিবীর কাছাকাছি উপবৃত্তাকার কক্ষপথে – (১৮৫ থেকে ২৯০০ কিলোমিটার উচ্চতায়), এবং দ্বিতীয়বার পৃথিবী থেকে দূরে উপবৃত্তাকার পথে – (৩৮০ কিলোমিটার থেকে ১ লক্ষ ১০ হাজার কিলোমিটার উচ্চতায়) ঘুরবে অরিয়ন। এরপর চলে যাবে চাঁদের মাধ্যাকর্ষণের দিকে। চাঁদের কাছাকাছি পৌঁছে চাঁদের যে পিঠ পৃথিবী থেকে দেখা যায় না, সেই পিঠে চৌষট্টি হাজার কিলোমিটার উড়ে উড়ে দেখবে। ফিরে আসার সময় পৃথিবীর মহাকর্ষ কাজে লাগিয়ে মুক্তভাবে পৃথিবীতে ফিরে আসবে যেভাবে এসেছে আর্টেমিস-১ মিশনে। 


আর্টেমিস-৩ মিশন হবে মানুষের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাঁদে নামার মিশন। এই মিশনে চারজন নভোচারী চাঁদে যাবেন। তাঁদের মধ্যে দু’জন নভোচারী হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেমের মাধ্যমে চাঁদের বুকে নামবেন। তাই এই মিশনের আগে একটি সার্ভিস মিশনের মাধ্যমে হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম এবং অরিয়ন ডকিং সিস্টেম চাঁদে স্থাপন করা হবে। চাঁদের কক্ষপথে একটি মহাকাশ স্টেশন - লুনার গেটওয়ে স্থাপনের প্রক্রিয়াও শুরু হয়েছে যার সম্পর্কে একটু পরে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। চাঁদের ঠিক কোন্‌ জায়গায় হিউম্যান ল্যান্ডিং সিস্টেম স্থাপন করা হবে এবং ঠিক কোথায় নভোচারীরা চাঁদে নামবেন তা এখনো নির্দিষ্টভাবে ঠিক করা হয়নি। চাঁদের চারপাশ থেকে প্রতিনিয়ত ছবি তুলে পাঠাচ্ছে লুনার রিকনিসেন্স অরবিটার স্যাটেলাইট। বছরের প্রতিদিন চাঁদের কোথায় কী পরিবর্তন হচ্ছে তা বোঝা যায় সেই ছবিগুলি থেকে। বিজ্ঞানীরা কাজ করছেন চাঁদের পিঠে এমন একটি জায়গা খুঁজে বের করতে যেখানে প্রচুর সূর্যালোক থাকবে যেন তাপমাত্রার পার্থক্য খুব কম হয়, যেখানে ল্যান্ডিং সহজ হবে এবং যোগাযোগ ব্যবস্থায় কোন বিচ্যুতি ঘটবে না। আর্টেমিস-৩ এর নভোচারীরা চাঁদের পিঠ থেকে প্রায় চল্লিশ কিলোগ্রাম নমুনা সংগ্রহ করে পৃথিবীতে নিয়ে আসবেন। 


আর্টেমিস মিশনের আরেকটি সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা হলো লুনার গেটওয়ে – স্পেস স্টেশন স্থাপন করা। চাঁদের চারপাশে ঘুরবে এই বিশেষ মহাকাশ স্টেশন – লুনার গেটওয়ে। এই স্টেশনে নভোচারীরা এক থেকে তিন মাস পর্যন্ত অবস্থান করে চাঁদের চারপাশে ঘুরতে ঘুরতে অনেকগুলি পরীক্ষা নিরীক্ষা করতে পারবেন। পৃথিবী থেকে তিন লক্ষ ৮৫ হাজার কিলোমিটার দূরে থেকে মহাকাশের ভবিষ্যৎ মিশনগুলির কারিগরি সহায়তা দেয়া হবে এই স্টেশন থেকে। আর্টেমিস-৩ এ নভোচারীরা যখন চাঁদে অবতরণ করবেন, তখন এই স্টেশন অনেক কাজে আসবে। 


নাসা অনেক বছর থেকেই চেষ্টা করছে চাঁদের পাশে স্টেশন তৈরি করার। ২০১২ সালে নাসা চাঁদের উল্টোপিঠে [যে পিঠ পৃথিবী থেকে দেখা যায় না] লুনার স্টেশন তৈরি করার পরিকল্পনা পর্যালোচনা করে। ২০১৭ সালে নাসা সিদ্ধান্ত নিয়েছিল চাঁদের পাশে ‘ডিপ স্পেস গেটওয়ে’ মহাকাশ স্টেশন তৈরি করবে। ২০১৮ সালে স্পেস স্টেশনের নাম ঠিক করা হয় – লুনার অরবিটাল প্লাটফরম-গেটওয়ে। এখন স্পেস স্টেশনটি গেটওয়ে নামেই পরিচিত। 


আমেরিকার সবচেয়ে বড় বহুজাতিক মহাকাশ ও প্রতিরক্ষা সরঞ্জাম প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান নরথ্রপ গ্রুম্যান করপোরেশন লুনার গেটওয়ের হ্যাবিটেশন ও লিজিস্টিক আউটপোস্ট – হ্যালো (HALO) নির্মাণ করেছে। এর আগে নরথ্রপ গ্রুম্যান কোম্পানি জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের বিভিন্ন অংশ তৈরি করেছে। হ্যালো মডিউলটি তৈরি হয়েছে আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে যন্ত্রপাতি এবং নভোচারীদের জন্য রসদ পাঠানোর জন্য ব্যবহৃত কার্গো মহাকাশযান সিগনাসের অনুকরণে। গেটওয়ের আয়তন সীমিত রাখা হয়েছে যেন তাকে মহাকাশে পাঠাতে কোন বেগ পেতে না হয়। বর্তমানে যেসব রকেটের মাধ্যমে সিগনাস পাঠানো হয় – সেই রকেটেই গেটওয়ে পাঠানো যায় মহাকাশে। গেটওয়ের হ্যালো মডিউল তৈরিতে খরচ হচ্ছে প্রায় ১১২২ মিলিয়ন ডলার (১১,২২০ কোটি টাকা)। গেটওয়ের হ্যালোতে চারজন নভোচারী তিরিশ দিন পর্যন্ত চাঁদের কাছাকাছি গিয়ে থাকতে পারবে এবং আবার ফিরেও আসতে পারবে। ২০২৪ সালে স্পেস-এক্স ফ্যালকন হ্যাভি রকেটের সাহায্যে গেটওয়ে পাঠানো হবে মহাকাশে। 


মহাকাশ স্টেশনের পাওয়ার অ্যান্ড প্রপালশান মডিউল তৈরি করছে আমেরিকার বিখ্যাত স্যাটেলাইট প্রস্তুতকারি প্রতিষ্ঠান ম্যাক্সার টেকনোলজিস। সৌরবিদ্যুৎ তৈরি করে সেই বিদ্যুতের মাধ্যমে চলবে এই মডিউল। চাঁদের চারপাশে এটা ঘুরবে, এবং ভবিষ্যতে এই স্টেশনকে যখন মঙ্গলে অভিযাত্রার কাজে লাগানো হবে, তখন প্রয়োজনীয় কারিগরি পরিবর্তন করা সম্ভব হবে। ২০২৪ সালে স্পেস-এক্স ফ্যালকন হ্যাভি রকেটের সাহায্যে এই মডিউল মহাকাশে পাঠানো হবে। 


লুনার স্পেস স্টেশন গেটওয়েতে নভোচারীরা সবসময় থাকবেন না। সর্বোচ্চ তিরিশ দিন থাকার পর তাঁরা যখন পৃথিবীতে ফিরে আসবেন, পরবর্তী মিশনে আরেকদল নভোচারী যাওয়ার আগপর্যন্ত সেই স্টেশন খালি থাকবে। তখন তাকে স্বয়ংক্রিয়ভাবে রক্ষণাবেক্ষণ ও প্রয়োজনীয় মেরামতি কাজ করার জন্য অত্যাধুনিক রোবটিক হাতের ব্যবস্থা করছে কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সি। এই রোবটিক হাতের নাম কানাডার্ম-৩। স্পেস শাটল এবং ইন্টারন্যাশনাল স্পেস স্টেশনেও তাদের কানাডার্ম- ১ ও ২ কাজ করছে। কানাডার্ম -৩ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন বলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অনেক দরকারি কাজ নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে করে ফেলতে পারে। আগামী চব্বিশ বছরে কানাডা এ বাবদ দুই বিলিয়ন ডলারের বেশি (বাংলাদেশ টাকায় প্রায় বিশ হাজার কোটি টাকা) খরচ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছে।  


স্পেস-এক্স কোম্পানি গেটওয়ের কার্গো সার্ভিসের দায়িত্ব নিয়েছে। তাদের কার্গোযানের নাম দেয়া হয়েছে ড্রাগন। আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশনে ড্রাগন নিয়মিত পণ্য সরবরাহ করে। গেটওয়ের কার্গোর নাম ড্রাগন এক্স-এল। এই ড্রাগন আগের ড্রাগনের চেয়ে সাড়ে পাঁচ টন বেশি মালামাল বহন করতে পারবে। কার্গোর জন্য নাসার খরচ হচ্ছে প্রায় সাত শ কোটি ডলার (প্রায় সত্তর হাজার কোটি টাকা)। নভোচারীরা গেটওয়েতে যাবেন অরিয়ন নভোযানে চড়ে। 


গেটওয়ের জন্য একটি নতুন কক্ষপথ নির্ধারণ করা হয়েছে। এই কক্ষপথে আগে কোন নভোযান চাঁদের চারপাশে ঘোরেনি। এই কক্ষপথের নাম ‘নিয়ার রেকটিলিনিয়ার হ্যালো অরবিট (NRHO)’। এই কক্ষপথ থেকে চাঁদের দক্ষিণ মেরু একদম কাছে, কিন্তু অন্যান্য দিকে কিছুটা দূরে। এই কক্ষপথটি চাঁদের ভূমি থেকে তিন হাজার থেকে সত্তর হাজার কিলোমিটার পর্যন্ত বিস্তৃত। এই কক্ষপথে চাঁদের চারপাশে একবার ঘুরে আসতে সাত দিন সময় লাগবে। 


আন্তর্জাতিক মহাকাশ স্টেশন পৃথিবী থেকে মাত্র ৪০৮ কিলোমিটার দূরে লোয়ার আর্থ অরবিটে ঘুরছে। সে তুলনায় গেটওয়ে পৃথিবী থেকে প্রায় তিন লক্ষ কিলোমিটার দূরে চাঁদের চারপাশে ঘুরবে। পৃথিবী থেকে এই স্টেশনে নভোচারী এবং অন্যান্য সামগ্রী পাঠানো অনেক বেশি ব্যয়বহুল এবং জটিল। তাই গেটওয়েতে সবসময় নভোচারীরা থাকবেন এমন নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে স্বয়ংক্রিয়ভাবে এই স্টেশন চলবে। এমনকি অন্যান্য মহাকাশ মিশনের নভোচারীরাও এই স্টেশন ব্যবহার করতে পারবে ভবিষ্যতে। গেটওয়ে স্টেশন স্থাপনের প্রধান উদ্দেশ্য হলো চাঁদে অবতরণ এবং চাঁদ থেকে পৃথিবীতে ফিরে আসার সময় নভোচারী এবং নভোযানগুলি এই স্টেশন ব্যবহার করবে। নাসা ভবিষ্যতে চাঁদের বুকে একটি স্থায়ী স্টেশন ‘আর্টেমিস বেইজ ক্যাম্প’ স্থাপন করার পরিকল্পনাও গ্রহণ করেছে। 


গেটওয়ে থেকে লুনার টেলিরোবটিক্স পরীক্ষা করে দেখা হবে – পৃথিবী থেকে কমান্ড পাঠালে আর গেটওয়ে থেকে কমান্ড পাঠালে তাদের কর্মদক্ষতায় কোন পার্থক্য দেখা যায় কি না তা পরীক্ষা করে দেখা হবে। পৃথিবী থেকে কমান্ড পাঠালে তা চাঁদে পৌঁছাতে দুই সেকেন্ড সময় লাগে। গেটওয়ে থেকে কমান্ড পাঠাতে কোন সময়ই লাগবে না। সময়ের পার্থক্য কি কোন পরিবর্তন আনে তা পরীক্ষা করে দেখা যাবে। সুদূর ভবিষ্যতে চাঁদ থেকে মঙ্গলে পাড়ি দেয়ার সময় গেটওয়ে স্টেশন ভীষণ দরকারি হয়ে উঠবে। 

আর্টেমিস মিশনের মাধ্যমে মানুষের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাঁদে যাওয়ার প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেছে। অচিরেই আমাদের চাঁদ হয়ে উঠবে মহাকাশের স্থায়ী স্টেশন। 


তথ্যসূত্র:

১। www.nasa.gov

২। www.space.com

৩। প্রদীপ দেব, চাঁদের নাম লুনা, মীরা প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৭। 

৪। ডগলাস ব্রিংকলি, আমেরিকান মুনশট, হারপার পেরেনিয়াল, নিউইয়র্ক,২০১৯। 

____________
বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২৩ সংখ্যায় প্রকাশিত










No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts