Monday 5 April 2021

শিল্পী খালিদ আহসান - আমাদের খালিদ ভাই

 



শিল্পী খালিদ আহসান – আমাদের প্রিয় খালিদ ভাইকে নিয়ে এভাবে লিখতে বসবো কখনোই ভাবিনি। ‘খালিদ ভাই’ হিসেবে চেনার অনেক বছর আগে থেকেই শিল্পী খালিদ আহসানের শিল্পকর্মের সাথে আমার পরিচয়। ইউনিভার্সিটিতে পড়ার সময় চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমিতে প্রায়ই যেতাম নাটক দেখার জন্য। একটা গ্রুপ থিয়েটারের সাথে জড়িত ছিলাম। যখন নাটক থাকতো না- তখনো যেতাম। আর্ট কলেজের অনেকেই তখন বিভিন্ন গ্রুপের সাথে যুক্ত, শিল্প নির্দেশনা, সেট ইত্যাদি কত কিছু নিয়ে মুখর থাকতো শিল্পকলা একাডেমির সবুজ-ধুসর-রঙিন বিকেল-সন্ধ্যেগুলি। আর্ট কলেজের এক বন্ধু আমাকে প্রথম দেখিয়েছিলো শিল্পী খালিদ আহসানকে। আমাদের গ্রুপের সালাহউদ্দিন ভাই ছিলেন সবচেয়ে পাতলা মানুষ। দেখলাম শিল্পী খালিদ আহসান সালাউদ্দিন ভাইয়ের চেয়েও পাতলা।

 

ডিসেম্বর-জানুয়ারিতে একটা পাতলা চাদর থাকতো তাঁর গায়ে। এলোমেলো চুল আর স্বল্পদৈর্ঘ্যের দাড়ি, আর চোখের কোণে রহস্যময় হাসি নিয়ে অদ্ভুতভাবে তাকাতেন। যখন নাট্যোৎসব চলতো, নাটকের আগে মুক্তমঞ্চে অনেক অনুষ্ঠান হতো। একদিন সোল্‌স-এর অনুষ্ঠানের আগে দেখলাম শিল্পী তপন চৌধুরি খালিদ আহসানকে দুই-হাত নেড়ে নেড়ে হাসিমুখে কিছু যেন বোঝাচ্ছেন। তারপর জানতে পারলাম খালিদ আহসান সোল্‌স-এর জনপ্রিয় গানের গীতিকার।  কবিতা উৎসবে দেখলাম কবি হেলাল হাফিজের সাথে। হেলাল হাফিজের “এখন যৌবন যার, মিছিলে যাবার তার শ্রেষ্ঠ সময়” – তখন আমাদের মুখস্থ। স্বৈরাচারী এরশাদ সরকারের বিরুদ্ধে যত প্রতিবাদ-উৎসব হচ্ছে সবখানেই তখন এই কবিতা। হেলাল হাফিজের তখনো মাত্র একটিই কাব্যগ্রন্থ “যে জ্বলে আগুন জ্বলে”। এর প্রচ্ছদ আর অলংকরণ করেছেন খালিদ আহসান। বইটির উৎসর্গপত্রে যেখানে লেখা আছে “আপনাকে, তোমাকে ও তোকে” – তার নিচে একটি রহস্যময় চোখ। এই চোখের দৃষ্টিতে ভালোবাসা, বিস্ময় কিংবা বিশাদ – যে কোনোটাই হতে পারে। কবিতার সাথে সাথে ধুসর তুলিতে মোটা দাগে আঁকা এই চোখটাও কেন যেন ভালো লেগে গেল। শিল্পী খালিদ আহসানের চোখেও আমি তাঁর নিজের তুলিতে আঁকা চোখের প্রতিফলন দেখেছিলাম।

 







খালিদ আহসান সম্ভবত মিতভাষী ছিলেন। সম্ভবত বললাম,  কারণ তাঁকে উচ্চস্বরে কথা বলতে কখনো শুনিনি। অবশ্য তিনি অন্য শিল্পীবন্ধুদের সাথে যখন আড্ডা দিতেন, আমি একটা দূরত্ব বজায় রাখতাম। এই দূরত্ব শ্রদ্ধার। সৃষ্টিশীল শিল্পীদের জন্য আমার হৃদয়ে খুবই আলাদা একটা জায়গা আছে। যে জায়গা ভালোবাসা, শ্রদ্ধা আর অদ্ভুত অপার্থিব এক ভালোলাগায় ভরা। শিল্পী খালিদ আহসান ওখানেই আছেন। এই জায়গায় যাঁরা থাকেন, তাঁদের ব্যক্তিসত্ত্বার চেয়ে শিল্পীসত্ত্বাই প্রাধান্য পায় বেশি। ফলে ব্যক্তিমানুষটা অনেক সময় দূরে রয়ে যান। সেটা আমারই সীমাবদ্ধতা। প্রিয় শিল্পী যখন মানুষের দূরত্বে চলে আসেন, তখনও বলা হয় না – তাঁর কাজ আমার কতটুকু ভালো লেগেছে। শিল্পী খালিদ আহসানকে কখনোই বলা হয়নি তাঁর কতটা গুণমুগ্ধ ছিলাম আমি।

 

শাহীন কলেজে আইভি আপার জুনিয়র সহকর্মী হিসেবে আমি কাজ করেছি সাড়ে চার বছর। হরতালের সময়ও আমাদের কলেজে যেতে হতো নিজের নিরাপত্তার তোয়াক্কা না করে। খুব ভোরে হরতাল শুরু হবার আগেই আমরা রওনা দিতাম – রিকশায়, অনেক সময় পায়ে হেঁটেও। অনেক বার আমি চকবাজার থেকে এসে সিরাজদৌল্লা রোডে আইভি আপার বাসায় গিয়েছি তাঁর সাথে কলেজে যাবার জন্য। প্রথমবার সেখানে শিল্পী খালিদ আহসানের সাথে দেখা। সেদিন থেকে জানলাম তিনি আমাদের আইভি আপার জীবনসঙ্গী। শিল্পী খালিদ আহসান হলেন আমাদের ‘খালিদ ভাই’। শাহীন কলেজে থাকার সময় আইভি আপার সাথে শিল্পকলা সম্পর্কে কোন ধরনের আলোচনা করার সুযোগই হয়নি। আইভি আপার কাজও আমাকে মুগ্ধ করে। তাঁর অলংকরণ, পোশাক ডিজাইন সবকিছুতেই তাঁর আলাদা একটা আভিজাত্যের ছাপ থাকে। কিন্তু  কোনদিন তাঁকেও বলা হয়নি - তাঁর কাজ আমার কী যে ভালো লাগে। আইভি আপাকে কোনদিনও বলা হয়নি – শিল্পী খালিদ আহসানকে আমি কত আগে থেকেই চিনি। সাধারণ মানুষের জীবনাবসান হয়। কিন্তু শিল্পীরা মৃত্যঞ্জয়। তাঁদের সৃষ্টির মধ্যেই তাঁরা বেঁচে থাকেন। শিল্পী খালিদ আহসানও আছেন, থাকবেন। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

ডাইনোসরের কাহিনি

  বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে বড় প্রাণি কী? এই প্রশ্নের উত্তরে আমরা বলবো নীল তিমি – যারা দৈর্ঘ্যে প্রায় তিরিশ মিটার, আর ওজনে প্রায় ১৯০ টন পর্যন্ত...

Popular Posts