Saturday 21 March 2020

পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ১




শৈশব-কৈশোর ও স্কুল-কলেজ

তখনকার ব্রিটিশ ভারতের পাঞ্জাব প্রদেশের একটি মফঃস্বল শহর ঝাং। আলাদা কোন বিশেষত্ব নেই এই শহরের কেবল হির-রান্‌ঝার প্রেম-কাহিনিটা ছাড়া। ঝাং-এর বাসিন্দারা মনে করেন হির-রান্‌ঝার ঘটনা সত্যিই ঘটেছিল এবং তাদের এলাকাতেই ঘটেছিল। এলাকার বেশির ভাগ মানুষ কৃষক, লেখাপড়া বিশেষ কেউ করেননি। পৃথিবীর কোথায় কী হচ্ছে তা নিয়ে কেউ মাথা ঘামান না সেখানে। মাঝে মধ্যে শহর থেকে কেউ এলে সাথে হয়তো সংবাদপত্র আসে। যারা সামান্য পড়তে জানেন তারা সেই পুরনো সংবাদপত্রই পড়ে শোনান অন্যদের।
            গ্রামের সামান্য যে কটা পরিবারে শিক্ষার আলো প্রবেশ করেছিল- চৌধুরি পরিবার তাদের অন্যতম। সচ্ছলতা তাদের খুব একটা ছিল না, তবে লেখাপড়ার প্রতি উৎসাহ ছিল খুব।
            কথিত আছে চৌধুরিদের পূর্ব-পুরুষ সৈয়দ বুধান ছিলেন রাজপুতনার হিন্দু। ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করে তিনি চলে এসেছিলেন পাঞ্জাবে। তারপর কেটে গেছে কয়েক শতাব্দী। বর্তমান চৌধুরি গুল মুহাম্মদ গ্রাম্য ডাক্তার। ভেষজ চিকিৎসক হিসেবে তাঁর নাম-ডাক আছে।
            তাঁর বড় ছেলে চৌধুরি গোলাম হোসেইন ১৮৯৯ সালে খ্রিস্টান কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করে প্রাদেশিক সরকারের জেলা স্কুল পরিদর্শক হয়েছেন।
            ছোট ছেলে চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন গোলাম হোসেইনের চেয়ে চৌদ্দ বছরের ছোট। মোহাম্মদ হোসেইন স্কুল পাস করে লাহোরের ইসলামিয়া কলেজে ভর্তি হয়েছিলেন। কিন্তু আর্থিক সঙ্গতির অভাবে লেখাপড়া শেষ না করেই গ্রামে ফিরে আসেন। কাজের সন্ধানে এখানে ওখানে ঘুরে স্থানীয় ঝাং স্কুলে মাসে উনিশ রুপি বেতনে অতিরিক্ত শিক্ষক হিসেবে যোগ দিলেন। দুবছর পর স্কুলে তাঁর চাকরি স্থায়ী হয়। তিনি ইংরেজি ও অংক পড়ান। পাশাপাশি বাবার ডাক্তারি-বিদ্যাও কিছুটা শিখে নিয়েছেন। বাড়িতে ছোট একটা ভেষজ ঔষধালয়ও আছে।
            ১৯২২ সালে বিয়ে করেন চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন। বছর খানেকের মধ্যেই কন্যাসন্তানের বাবা হলেন তিনি। মেয়ের নাম রাখলেন মাসুদা বেগম। কিন্তু মেয়ের জন্মের দেড় মাসের মাথায় তাঁর স্ত্রীর মৃত্যু হলে মহা সমস্যায় পড়লেন চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন। দেড় মাসের শিশুর দেখাশোনা করা, ঘর-সংসার সামলানো, তদুপরি মাত্র একত্রিশ বছরে বিপত্নিক হওয়া। সুতরাং আবার বিয়ে।
            ১৯২৫ সালের মে মাসে চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন বিয়ে করলেন সরকারি ট্যাক্স অফিসার হাফিজ নবী বক্‌শর কন্যা হাজিরা বেগমকে। ঝাং থেকে ষাট মাইল দক্ষিণে শাহিওয়াল জেলার হাফিজ নবী বক্‌শের পরিবারের সবাই খুব ধার্মিক। হাজিরা বেগমের ভাই বিশ বছর ইসলাম ধর্ম প্রচার করেছেন পশ্চিম আফ্রিকায়। ধর্মীয় প্রভাব চৌধুরি পরিবারে আগে থেকেই ছিল। হাজিরা বেগমের সাথে বিয়ের পর সে প্রভাব আরো বাড়লো।
            সামাজিক প্রথা অনুযায়ী প্রথম সন্তানের জন্মের আগে শাহিওয়ালে বাপের বাড়িতে চলে গেলেন হাজিরা বেগম। ১৯২৬ সালের ২৯ জানুয়ারি এখানেই জন্ম হলো চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইনের দ্বিতীয় এবং হাজিরা বেগমের প্রথম সন্তান আবদুস সালামের।
            চল্লিশ দিন পর ছেলেকে নিয়ে ঝাং-এর বাড়িতে ফিরলেন হাজিরা বেগম। মা-বাবার চোখের মণি আবদুস সালাম। দুবছর বয়স হতে না হতেই বাবা মোহাম্মদ হোসেইন ছেলেকে সাইকেলের সামনে বসিয়ে নিজের সাথে নিয়ে যেতে আরম্ভ করলেন।
            ইতোমধ্যে সংসারে আরেকটা সন্তান এসে গেছে- আবদুস সালামের ছোটবোন হামিদা বেগম। পরবর্তী কয়েক বছরের মধ্যেই হাজিরা বেগমের আরো ছয়টি ছেলে-মেয়ের জন্ম হয়। নয়জন ছেলে-মেয়ে ও নিজেদের নিয়ে এগারো জনের বিরাট সংসারে খরচ বেড়েছে অনেক, কিন্তু আয় এখনো মাসে মাত্র উনিশ রুপি।
            পরিবারের বড় ছেলে হবার কারণে হোক- বা লেখাপড়ায় খুব ভাল হবার কারণে হোক- আবদুস সালাম তার অন্য-ভাইবোনদের চেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা পেয়ে আসছে শুরু থেকেই। ছোটবোন হামিদা বেগমের ওপর দায়িত্ব পড়লো আবদুস সালামের যখন যা দরকার তা জোগানোর। জামা-কাপড় ধোয়া, বিছানা-করা থেকে শুরু করে সবকিছু গুছিয়ে রাখা। সন্ধ্যায় পড়তে বসার আগেই আবদুস সালামের হারিকেনের চিমনি পরিষ্কার করে হারিকেন জ্বালিয়ে টেবিলে রেখে দেয় তার ভাই-বোনেরা।
             বাড়ি থেকে মাত্র আধ-কিলোমিটার দূরে ঝাং স্কুলেই আবদুস সালামের প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া শুরু। সাধারণত ছবছর বয়সে ছেলেরা স্কুলে যেতে শুরু করে। (ঝাং অঞ্চলে মেয়েদের লেখাপড়া করার প্রয়োজনীয়তার কথা তখনো ভাবেনি কেউ। আবদুস সালামের বোনেরাও লেখাপড়া করেনি।) কিন্তু আবদুস সালামের বাবা ছেলের তিন বছর বয়স থেকেই বাড়িতে লেখাপড়া শেখানো শুরু করে দিয়েছেন। ফলে ১৯৩২ সালে ছয় বছর বয়সে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হবার বদলে আবদুস সালাম সোজা ক্লাস থ্রিতে গিয়ে ভর্তি হলো।

আবদুস সালামের বাবা চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেন


আবদুস সালামের লেখাপড়ার প্রতি বিশেষ যত্নশীল তার বাবা মোহাম্মদ হোসেইন। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফেরার পর স্কুলে কী কী পড়ালেখা হয়েছে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে জিজ্ঞেস করতেন তিনি। আর দারুন উৎসাহ দিতেন তার মামা যিনি পশ্চিম আফ্রিকায় এক সময় ইসলাম ধর্ম প্রচারক ছিলেন। ইংরেজি আর অংকের পাশাপাশি ইসলামী শিক্ষাও চললো সমান তালে। বাবা-মায়ের কাছ থেকে শুনতে শুনতে ছোটবেলাতেই কোরান পড়তে শিখে গেলেন আবদুস সালাম।


ঝাং- স্কুলের শ্রেণিকক্ষ যেখানে লেখাপড়া করেছেন আবদুস সালাম

স্কুলের সব পরীক্ষায় চমৎকার ফলাফল করে সব শিক্ষকের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠল আবদুস সালাম। কিন্তু তার বাবা জানতেন ঝাং স্কুলে উঁচু ক্লাসে পড়ানোর উপযুক্ত ভালো ইংরেজি শিক্ষক নেই। ভালো ইংরেজি না জানলে জীবনে বেশিদূর যাওয়া সম্ভব নয়। তাই তিনি ঠিক করলেন ক্লাস নাইন থেকে ছেলেকে লাহোরের সেন্ট্রাল মুসলিম মডেল স্কুলে ভর্তি করে দেবেন। ছেলের রেজাল্ট ভালো। সুতরাং ভর্তি হতে কোন সমস্যা হবার কথা নয়।       ১৯৩৮ সালে চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন ছেলেকে নিয়ে গেলেন মডেল স্কুলের হেডমাস্টারের কাছে। হেডমাস্টার ভালো করে তাকিয়ে দেখলেন আবদুস সালামের দিকে। তার মাথায় লাল রুমি টুপি দেখে চিন্তিত হয়ে উঠলেন তিনি। যতই ভালো ছাত্র হোক এরকম অচল পোশাকের 'আনস্মার্ট' ছেলে তাঁর মডার্ন স্কুলে বড়ই বেমানান। মডার্ন স্কুলে ভর্তি হওয়া হলো না আবদুস সালামের।

            চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন ছেলেকে নিয়ে গেলেন ঝাং সরকারি উচ্চ-মাধ্যমিক কলেজের স্কুল শাখায়। এখানে বেশির ভাগ ছাত্র হিন্দু। তিনি বিশ্বাস করতেন যে হিন্দুরা বিজ্ঞান ও গণিতে খুবই দক্ষ। তাঁর ছেলে তাদের সাথে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে পারবে কিনা সে ব্যাপারে কিছুটা চিন্তিত ছিলেন তিনি। কিন্তু আবদুস সালাম খুব সহজেই টপকে গেলো সবাইকে।
            বারো বছর বয়সে ক্লাস নাইনে ভর্তি হলো আবদুস সালাম। ক্লাস নাইন থেকে চার বছর পড়াশোনা সেখানে; ক্লাস নাইন, টেন, ফার্স্ট ইয়ার ও সেকেন্ড ইয়ার।
            ঝাং সরকারি কলেজে অনেক নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষক ছিলেন। সালামের ইংরেজি শিক্ষক ছিলেন শেখ ইজাজ আহমদ। আরবি শিক্ষক সুফি জিয়াউল হক। ফারসি শেখাতেন খাজা মিরাজুদ্দিন। হিন্দু এবং শিখ শিক্ষকেরা পড়াতেন বিজ্ঞান ও গণিত। বিজ্ঞান ও গণিতকে ভারতীয় উপমহাদেশে শিখ ও হিন্দুদের বিষয় বলে মনে করা হতো তখনকার দিনে। লালা বদরি নাথ ও লালা রাম লাল পড়াতেন গণিত। লালা হংসরাজ পড়াতেন পদার্থবিজ্ঞান, লালা নৌবত রায় পড়াতেন রসায়ন।
            নতুন স্কুলের প্রথম পরীক্ষাতেই আবদুস সালাম প্রথম হলো। মোট ৭০০ নম্বরের মধ্যে ৫৯১ নম্বর পেয়ে মাসে ছয় রুপি বৃত্তি ও দুই রুপি বুক-প্রাইজ পেলো। তাদের সংসারে এই ছয় রুপিও অনেক। অচিরেই স্কুলের শিক্ষকদের প্রিয়পাত্র হয়ে উঠলো আবদুস সালাম।
            আবদুস সালামের বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসার শুরু এই স্কুল থেকেই। এখানেই বিজ্ঞানের ক্লাসে বসে আবদুস সালাম প্রথম শোনে মৌলিক বলের কথা। তবে একটু অন্যভাবে।
            তাদের বিজ্ঞান শিক্ষক শুরুতে বললেন মহাকর্ষ বলের কথা। নিউটনের তত্ত্ব ততদিনে ঝাং-এর মত মফস্বল শহরেও ঢুকে পড়েছে। মহাকর্ষ বল ব্যাখ্যা করার পর শিক্ষক বললেন চুম্বকত্ব সম্পর্কে। একটা চুম্বক দেখিয়ে তার লোহাকে আকর্ষণ করার ক্ষমতা দেখালেন, উত্তর-দক্ষিণ মেরুর দিকে তার অবস্থানের কথা বললেন, সমমেরুতে বিকর্ষণ আর বিপরীত মেরুতে আকর্ষণের কথাও বাদ গেলো না।
            বিদ্যুৎ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বললেন, বিদ্যুৎ! আহা!! বিদ্যুৎ এমন একটা বস্তু যা ঝাং শহরে থাকে না। এটা থাকে এই প্রদেশের রাজধানীতে। এখান থেকে একশ মাইল পূর্বে- লাহোরে।
            আসলে বিজ্ঞান শিক্ষক ঠিকই বলেছিলেন। ঝাং শহরে বিদ্যুৎ এসেছিল আরো চার বছর পর, আবদুস সালামের বয়স তখন ষোল।             নিউক্লিয়ার বল সম্পর্কে বলতে গিয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক বলেছিলেন, নিউক্লিয়ার বল এমন এক ধরনের বল যা শুধু ইউরোপে আছে। ইন্ডিয়ায় তা থাকে না। সুতরাং নিউক্লিয়ার বল নিয়ে চিন্তা করার কোন দরকার নেই আমাদের।
            সেদিন যে শিক্ষক নিউক্লিয়ার বল সম্পর্কে ভাবতে মানা করেছিলেন তিনি ভাবতেই পারেননি যে একদিন তাঁরই ছাত্র আবদুস সালাম নিউক্লিয়ার বল সম্পর্কিত অনেক তত্ত্বের মৌলিক ধারণা বদলে দেবেন।
            ১৯৪০ সালে আবদুস সালামের ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা। এ নিয়ে বাবা মোহাম্মদ হোসেইনের চিন্তার শেষ নেই। তখনকার দিনে ম্যাট্রিকুলেশান পরীক্ষা ছিল অনেকটা রেসলিং এর মতো। পাঞ্জাব প্রদেশের সব স্কুলের ছেলেমেয়েদের মধ্যে মেধার রেসলিং। বিভিন্ন স্কুল থেকে রেসলাররা আসে পরীক্ষা দিয়ে যোগ্যতা দেখানোর জন্য। বিশেষ করে হিন্দু 'সনাতন ধরম' এবং আর্য স্কুলগুলোর শিক্ষার্থীরা সবচেয়ে শক্তিশালী রেসলার।
            ছেলে যাতে পরীক্ষায় খুব ভালো রেজাল্ট করতে পারে তার জন্য যথাসাধ্য চেষ্টা করলেন চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন। সালামের হাতের লেখা তেমন সুন্দর নয়- তাই তাকে বাধ্য করলেন দিন রাত লেখা অনুশীলন করতে। ব্যবহারিক বিজ্ঞান ও জ্যামিতিতেও কিছুটা দুর্বল আবদুস সালাম। একজন শিখ শিক্ষক আবদুস সালামকে বিনা পারিশ্রমিকে প্রাইভেট পড়ালেন পরীক্ষার আগে। পরীক্ষা বেশ ভালোই হলো।
            রেজাল্টের দিন বাবার অফিসে বসে অপেক্ষা করছিলো আবদুস সালাম। লাহোর থেকে পরীক্ষার ফলাফলের সংবাদপত্র এলো দুপুরের ট্রেনে। সালামের বাবা তাঁর একজন সহকারীকে স্টেশনে পাঠিয়ে দিয়েছিলেন সংবাদপত্র আসার সাথে সাথে নিয়ে আসার জন্য। কিন্তু তার আগেই অভিনন্দন বার্তা সহ টেলিগ্রাম পৌঁছে গেলো স্কুলে। আবদুস সালাম ফার্স্ট স্ট্যান্ড করেছে- প্রথম হয়েছে সারা লাহোরের মধ্যে।
            তখনকার দিনে যেদিন মেট্রিকুলেশানের রেজাল্ট বের হতো, সারা দেশে অনেকটা জাতীয় উৎসবের মতো হয়ে যেতো। মেধা তালিকায় স্থান পাওয়ার নাম ছিল 'স্ট্যান্ড করা'। কোন স্কুল থেকে কেউ স্ট্যান্ড করলে সেই অঞ্চলে বিজয়-উৎসবের মতো হয়ে যেতো।
            দুপুর দুটোর দিকে সালাম সাইকেল চালিয়ে যখন বাড়ীতে আসছিল - দেখলো তাদের বাড়ির কাছের হিন্দু দোকানদারেরা মিষ্টি আর ফুল নিয়ে অপেক্ষা করছেন তার জন্য। সবাই দাঁড়িয়ে অভিনন্দন জানালো আবদুস সালামকে। আবদুস সালাম ফার্স্ট স্ট্যান্ড করেছে - এটা সবার জন্যই গর্বের বিষয়।
            পরদিন সংবাদপত্রে ছবি বেরোল চৌদ্দ বছর বয়সী কিশোর আবদুস সালামের- চোখে চশমা, মাথায় পাগড়ি। (বহুবছর পর নোবেল পুরষ্কার নেবার সময় এরকম পাগড়ির কথাই মনে হয়েছিল আবদুস সালামের।)

১৯৪০ সালে ১৪ বছর বয়সে আবদুস সালাম

ম্যাট্রিকে প্রথম হয়ে আবদুস সালাম সরকারি বৃত্তি পেলো মাসিক বিশ রুপি। আর আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পেলো মাসিক তিরিশ রুপি বৃত্তি।

 
            ম্যাট্রিকুলেশানের পর আবদুস সালাম গণিত ও বিজ্ঞানের লাইনে যাবে নাকি ভাষা ও সাহিত্যের দিকে যাবে তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলেন তাঁর বাবা মোহাম্মদ হোসেইন। ছেলে তাঁর সব বিষয়েই ভাল। কিছু ভবিষ্যতের কথা তো চিন্তা করতে হবে। ভবিষ্যৎ মানে একটা ভালো চাকরি। কোন্‌ বিষয়ে উচ্চশিক্ষা নিলে ভালো চাকরি পেতে সুবিধা হবে সেটাই বিবেচ্য। অনেকের কাছ থেকে পরামর্শও নিলেন এ ব্যাপারে। ঠিক হলো আবদুস সালাম গণিত ও বিজ্ঞানের লাইনেই এগোবে। 

সংবাদপত্রে সালামের ছবি সহ ফার্স্টস্ট্যান্ড করার খবর
কলেজের প্রথম বর্ষে আবদুস সালাম নতুন নতুন ইংরেজি শব্দ শেখার পর তা না বুঝেই ব্যবহার করতে শুরু করলো। ইংরেজি শিক্ষক শেখ ইজাজ আহমদ মানা করলেন এরকম করতে। কিন্তু আবদুস সালাম নতুন নত্নন ইংরেজি শব্দ অর্থহীনভাবে ব্যবহার করতেই লাগলেন। ইংরেজি শিক্ষক এর শাস্তি স্বরূপ সেমিস্টার শেষে ইংরেজি পরীক্ষায় প্রতিটি ভুল শব্দ প্রয়োগের জন্য পাঁচ নম্বর করে কাটতে শুরু করলেন। ফলে সালামের ইংরেজির রেজাল্ট খুব খারাপ হলো। তাতেও যথেষ্ট শাস্তি হয়েছে মনে করলেন না ইজাজ স্যার। তিনি ক্লাসে খাতাটা নিয়ে গিয়ে সালামের ভুলগুলো ক্লাসের সবার সামনে বলে লজ্জা দিলেন তাকে। তখন ব্যাপারটা ভালোভাবে নেননি সালাম। কিন্তু পরে বুঝতে পেরেছেন এর উপযোগিতা। এরপর আর কোনদিনই ঠিকমতো না জেনে কোন শব্দ ব্যবহার করেননি তিনি।
            ঝাং সরকারি কলেজে আরো দুবছর কাটলো। ১৯৪২ সালের এফ-এ পরীক্ষায় ৬৫০ নম্বরের মধ্যে ৫৫৫ নম্বর পেয়ে সমগ্র পাঞ্জাবের মধ্যে প্রথম হলো আবদুস সালাম। মাসিক বৃত্তির পরিমাণ বেড়ে দাঁড়ালো সরকার থেকে তিরিশ রুপি, আর আহমদিয়া সম্প্রদায়ের কাছ থেকে পয়ঁতাল্লিশ রুপি।
            এসময় মোহাম্মদ হোসেইনের চাকরিতে বিরাট পদোন্নতি হয়। তিনি পাঞ্জাব সরকারের শিক্ষা দপ্তরের প্রশাসনিক কর্মকর্তা নিযুক্ত হন। ঝাং থেকে একশ মাইল দূরে মুলতানে তাঁর নতুন কর্মস্থল। মাসিক বেতন বেড়ে দাঁড়ালো ২৫০ রুপি। আবদুস সালামের মা-বাবা ভাই-বোন সবাই মুলতানে চলে গেলেন।
            আবদুস সালাম ভর্তি হলেন লাহোর সরকারি কলেজে বি-এ ক্লাসে। ঝাং-এর মতো প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে পাঞ্জাবের সবচেয়ে সমৃদ্ধ শহর লাহোরে এসে সালামের মনে হলো পৃথিবী থেকে চাঁদের কাছাকাছি চলে এসেছেন। জীবনে প্রথমবারের মত বাড়ির বাইরে হোস্টেলে থাকতে এসে বুঝলেন যে এতদিন বাড়িতে ছোট ভাই-বোনেরা সব কিছু হাতের কাজে এগিয়ে দিতো- এখন থেকে নিজের কাজ নিজেকেই করতে হবে। তবে কিছুটা স্বাধীনতার স্বাদও পেলেন।
            হোস্টেলে বেশিরভাগ ছেলেই পড়াশোনার বদলে খেলাধূলা পার্টি রাজনীতি ইত্যাদি নিয়ে মত্ত। সালামের মত হাতেগোনা কয়েকজন ক্লাস, লাইব্রেরি, বই আর পড়াশোনায় মগ্ন। পড়ুয়া ছেলেদেরকে নিয়ে অন্যরা উঠতে বসতে হাসি-তামাশা করে। ফার্স্ট-স্ট্যান্ড করা আবদুস সালামকেও ছাড় দেয় না তারা। কোন ধরনের খেলাধূলাই করেন না আবদুস সালাম - এই বদনাম ঘোচানোর জন্য দাবা খেলা শিখে ফেললেন তিনি। হোস্টেলের অন্য ছেলেদের দাবায় হারানোর জন্য দাবার পেছনে অনেক সময় দিতে শুরু করলেন। কথাটা কীভাবে যেন বাবার কানে পৌঁছে গেল। তিনি কড়া ধমক দিয়ে চিঠি লিখলেন- এরকম সময় নষ্ট করে ভবিষ্যৎ নষ্ট করো না।
            লাহোর সরকারি কলেজে গণিতের প্রফেসর সর্বদমন চাওলার সংস্পর্শে এসে গণিতের প্রতি গভীর ভালোবাসা জন্মালো আবদুস সালামের। প্রফেসর চাওলা কেমব্রিজের বিখ্যাত গণিতবিদ প্রফেসর জন লিটলউড ও প্রফেসর গডফ্রে হার্ডির অধীনে পিএইচডি করেছেন। এই প্রফেসর হার্ডি-ই গণিতের কিংবদন্তী রামানুজনকে বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছিলেন।
            প্রফেসর চাওলা গণিতের ক্লাসে রামানুজনের গাণিতিক সমস্যা নিয়ে আলোচনা করতেন। ছাত্রদের উদ্বুদ্ধ করতেন সমস্যার সমাধান নিয়ে ভাবতে। আবদুস সালাম সক্রিয়ভাবে অংশ নিলেন এই গণিত-চক্রে। অনেক নতুন নতুন সমস্যার সমাধান করে গণিতে তাঁর পারদর্শিতার প্রমাণ রাখলেন। ১৯৪৩ সালে মাত্র ষোল বছর বয়সে তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় রামানুজনের গাণিতিক সমস্যার ওপর।
            গণিতের পাশাপাশি উর্দু আর ইংরেজি সাহিত্যের প্রতিও তাঁর ভালবাসা প্রকাশ পেতে থাকে। এসময় সাহিত্য চর্চার দিকেও ঝোঁক গেলো তাঁর। গালিবের উপর তাঁর লেখা প্রবন্ধ প্রকাশিত হলো আব্‌দি দুনিয়ায়। ইংরেজি সাহিত্য অস্কার ওয়াইল্ড, টি ই লরেন্স-ও পড়ছেন।
            সালামের সতেরো বছরের তরুণ হৃদয়ে প্রেমের দোলা লাগলো। কলেজের প্রিন্সিপাল জি. ডি. সন্ধির দুই মেয়ে উর্মিলা আর সনুর রূপে তখন সারা কলেজ মুগ্ধ। আবদুস সালাম উর্মিলার প্রেমে পড়ে গেলেন। অবশ্য এক তরফা। মনে মনে ঠিক করে ফেলেছেন- উর্মিলা ছাড়া আর কাউকেই বিয়ে করবেন না। তারুণ্যের উচ্ছাস যেরকম হয় আর কি।
            কিন্তু কিছুদিনের মধ্যেই দেখা গেলো উর্মিলার প্রেমে হাবুডুবু খাচ্ছেন এমন তরুণের সংখ্যা অনেক। ছাত্রদের পাশাপাশি কিছু তরুণ শিক্ষকও রয়েছেন প্রেমিকের দলে। প্রফেসর সিরাজুদ্দিন এগিয়ে আছেন সেক্ষেত্রে। কাজের অজুহাতে যখন তখন প্রিন্সিপালের বাসায় যাতায়াত করছেন প্রফেসর সিরাজুদ্দিন। আবদুস সালাম দেখলেন উর্মিলার নাগাল পাওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয় কিছুতেই। দীর্ঘশ্বাস ফেলে পড়াশোনায় মন দিলেন তিনি।
            ১৯৪৪ সালের বিএ পরীক্ষার ফলাফলে পাঞ্জাবে নতুন রেকর্ড সৃষ্টি করে প্রথম হলেন আবদুস সালাম। বিএ পরীক্ষার বিষয়গুলোর পাশাপাশি অতিরিক্ত ইংরেজি বিষয়ে অনার্সের পরীক্ষাও দিয়েছিলেন আবদুস সালাম। রেকর্ড মার্ক পেয়ে ইংরেজিতে অনার্স পেলেন তিনি। সরকারি ও আহমদিয়া একাডেমি মিলিয়ে মাসিক বৃত্তির পরিমাণ দাঁড়ালো ১২০ রুপি।
            এবার আবদুস সালাম ইংরেজি বা গণিত যে কোন বিষয়ে মাস্টার্স করতে পারেন। কিন্তু বুঝতে পারছেন না ঠিক কোন্‌ লাইনে যাওয়া উচিত। আবদুস সালামের বাবার প্রচন্ড ইচ্ছে ছেলে আই-সি-এস অফিসার হবে।        ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলন চলছে পুরোদমে। ভারতের স্বাধীনতা এখন সময়ের ব্যাপার মাত্র। অখন্ড স্বাধীন ভারত হোক, কিংবা আলাদা পাকিস্তান রাষ্ট্র হোক, ইংরেজ বিদায় নিলেই প্রশাসন চালানোর জন্য অনেক ভারতীয় বা পাকিস্তানি অফিসার লাগবে। আই-সি-এস পাস করতে পারলে আর পেছনে তাকাতে হবে না। কিন্তু দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলার কারণে আই-সি-এস পরীক্ষা বন্ধ হয়ে আছে অনির্দিষ্ট কালের জন্য।
            আবদুস সালাম ভেবে দেখলেন আই-সি-এস পরীক্ষার জন্য যে সব বিষয় পড়তে হবে তা তিনি পরীক্ষার আগে নিজে নিজে পড়ে নিতে পারবেন। আপাতত গণিত নিয়ে মাস্টার্স পড়া যাক। প্রফেসর চাওলার তত্ত্বাবধানে শুরু হলো তাঁর গণিতে মাস্টার্সের পাঠ।
            ইতোমধ্যে সাংগঠনিক কাজেও দারুণ দক্ষতা অর্জন করে ফেলেছেন আবদুস সালাম। তিনি লাহোর কলেজ ইউনিয়নের সভাপতি নির্বাচিত হলেন। কলেজ ম্যাগাজিনের প্রধান সম্পাদকের কাজও করলেন। ১৯৪৫ সালে তাঁর ইংরেজি ছোটগল্প হোয়াইট আর্ম প্রকাশিত হলো এই কলেজ ম্যাগাজিনে। ১৯৪৬ সালের এম-এ পরীক্ষায় ৬০০ নম্বরের মধ্যে ৫৭৩ নম্বর পেয়ে পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে ফেললেন আবদুস সালাম।
            এত ভালো রেজাল্ট করার কারণে ইন্ডিয়ান রেলওয়ের ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্টে চাকরির অফার পেলেন আবদুস সালাম। কিন্তু রেলওয়ের চাকরির সামাজিক মর্যাদা আই-সি-এসের ধারে-কাছেও নয়। তাই আবদুস সালামের বাবা রেলওয়ের চাকরির কথা শুনেই নাকচ করে দিলেন। তাছাড়া আবদুস সালামের চোখে ইতোমধ্যেই পুরু লেন্সের চশমা উঠে গেছে। রেলওয়ের চাকরিতে এরকম চোখ নিয়ে কাজ করা যায় না।
            এসময় কিছু ব্যাপার ঘটলো যা আবদুস সালামের ভাষায় দৈবঘটন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশ যুদ্ধ প্রচেষ্টায় সহযোগিতা করার জন্য একটি তহবিল গঠন করা হয়। এর নেতৃত্বে ছিলেন ইন্ডিয়ান কংগ্রেস পার্টির পাঞ্জাব প্রতিনিধি খাইজার হায়াত তিওয়ানা। প্রায় দেড় লাখ রুপি সংগৃহিত হয় ঐ তহবিলে। যুদ্ধ শেষ হবার পরে দেখা গেলো তহবিলে বেশ কিছু টাকা রয়ে গেছে। সিদ্ধান্ত হলো ঐ টাকা দিয়ে পাঞ্জাবের দরিদ্র কৃষক পরিবারের মেধাবী ছেলেদের বিদেশে উচ্চশিক্ষার জন্য পাঁচটি বৃত্তি দেয়া হবে।
            মেধার প্রতিযোগিতায় আবদুস সালাম অপ্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু বৃত্তির শর্ত যে পূরণ হচ্ছে না। দরিদ্র কৃষকের ছেলেকে বৃত্তি দেয়া হবে। আবদুস সালামের বাবা তো শিক্ষা অফিসার, কৃষক নন। কী করা যায়!
            এগিয়ে এলেন আবদুস সালামের জ্যেঠা চৌধুরি গোলাম হোসেইন। নিজের কিছু জমি ছোট ভাইকে দিলেন। আবদুস সালামের বাবা কয়েকটা গরু ছাগল কিনে এবং ঐ জমিতে দ্রুত চাষ করে আইনত কৃষক হয়ে গেলেন। সালামের বৃত্তি পেতে আর কোন সমস্যা হলো না।  




No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts