Tuesday, 31 March 2020

পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ৫


দেশের কাজ

১৯৫৭ সালে পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ মিঞা ইফতেখার উদ্দিন যুক্তরাজ্য সফরে এসে লন্ডনের পাকিস্তানি কমিউনিটিতে আবদুস সালামের কথা শুনে অবাক হয়ে গেলেন। লন্ডনের মত শহরে বিশ্ববিদ্যালয়ের একটা ডিপার্টমেন্ট চালাচ্ছেন একজন পাকিস্তানি তরুণ অধ্যাপক! ইম্পেরিয়েল কলেজে গিয়ে তিনি দেখা করলেন প্রফেসর সালামের সাথে। সালামের নাম-ডাক কাজ-কর্ম দেখে অভিভূত হয়ে গেলেন ইফতেখার উদ্দিন।
          পাকিস্তানের প্রভাবশালী পত্রিকা 'পাকিস্তান টাইম্‌স'-এর মালিক ইফতেখার উদ্দিন। কয়েক দিন পরেই পাকিস্তান টাইম্‌স-এ বেশ বড় একটা প্রতিবেদন প্রকাশিত হলো প্রফেসর আবদুস সালামের বৈজ্ঞানিক সাফল্যের ওপর। সেই প্রতিবেদনে পাকিস্তানের সোনার ছেলেকে পাকিস্তানের উন্নয়নে কাজে লাগানোর ব্যাপারে জোর দেয়া হয়।
          যে সালামকে তিন বছর আগে প্রাণভয়ে পালাতে হয়েছিল লাহোর ছেড়ে - সেই লাহোর তো বটেই, পুরো পাকিস্তানের জনগণ আবার নতুন করে চিনলো প্রফেসর আবদুস সালামকে। ইফতিখার উদ্দিনের প্রভাবে পাকিস্তান সরকার ও প্রভাবশালী মহলে বেশ তোড়জোড় শুরু হলো আবদুস সালামকে নিয়ে। পাঞ্জাব ইউনিভার্সিটি দ্রুত সম্মানসূচক ডিএসসি ডিগ্রি দিয়ে দিলো তাঁকে।
          পাকিস্তানের সাথে আবদুস সালামের রাষ্ট্রীয় যোগাযোগ আরো নিবিড় হতে শুরু করলো। তিনি ভাবতে শুরু করলেন- ইউরোপ, আমেরিকা, রাশিয়া যে বিজ্ঞান ও কারিগরি দক্ষতা অর্জন করেছে তা তাদের সঠিক দূরদর্শী রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ এবং নিয়মিত বিজ্ঞানচর্চার ফসল। সালামের প্রশ্ন জাগে, "আমরা- মানে গরীব বিশ্ব এত গরীব কেন? সেটা কি পুরোটাই রাষ্ট্রীয় সম্পদের অভাব? নাকি সম্পদ সৃষ্টির উদ্যমের অভাব? নাকি সঠিক প্রশিক্ষণ ও কৌশলের অভাব?
          ১৯৫৮ সালে পাকিস্তানের মিলিটারি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে নিয়েছে। আইয়ুব খান পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছেন। সব মিলিটারি শাসকই যেমন শুরুতে উন্নয়ন উন্নয়ন বলে খুব হৈ চৈ করে - আইয়ুব খানও তা শুরু করলেন। তাঁর নজর পড়লো প্রফেসর সালামের ওপর। তিনি পাকিস্তানের জাতীয় বিজ্ঞান কমিশন গঠন করে তার সদস্য মনোনীত করলেন প্রফেসর সালামকে। পাকিস্তান শিক্ষা কমিশনেরও উপদেষ্টা নিয়োজিত হলেন প্রফেসর সালাম।
          মহা উৎসাহে নিজের দেশের কাজে লেগে গেলেন প্রফেসর সালাম। কয়েক বছরের মধ্যেই প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের খুব কাছের মানুষ হয়ে উঠলেন তিনি। ১৯৫৯ সালে পাকিস্তান সরকারের 'সিতারা-ই-পাকিস্তান' খেতাব পেলেন আবদুস সালাম।
          ১৯৫৯ সালের ৪ আগস্ট পাকিস্তান সায়েন্টিফিক কমিশনের প্রথম অধিবেশনের উদ্বোধনী ভাষণে আইয়ুব খান খুব গুরুত্ব দিয়ে বললেন, "আমাদের মাঝে প্রফেসর  আবদুস সালামকে পেয়ে আমরা গর্বিত। এত কম বয়সে বিজ্ঞানের যে উঁচু আসনে তিনি অধিষ্ঠিত হতে পেরেছেন তা আমাদের পাকিস্তানের জন্য গৌরবের বিষয়। প্রফেসর আবদুস সালাম আজ প্রত্যেক পাকিস্তানির প্রেরণার উৎস। আমার দৃঢ় বিশ্বাস প্রফেসর সালামের প্রত্যক্ষ সহযোগিতার ফলে সায়েন্টিফিক কমিশন অনেক বেশি ফলপ্রসূ হবে।"
          পাকিস্তানে আবদুস সালামের গ্রহণযোগ্যতা হঠাৎ করে বেড়ে গেলো। তিনি বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে পাকিস্তানের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ঘটানোর লক্ষ্যে অনেকগুলো পদক্ষেপ গ্রহণ করলেন। তাঁর লক্ষ্য পরবর্তী দশকের মধ্যেই পাকিস্তানকে অর্থনৈতিকভাবে উন্নত জাতির সমতুল্য করে তোলা। তিনি স্বপ্ন দেখছেন চীন, জাপান বা রাশিয়ায় যেরকম শিল্প-বিপ্লব ঘটেছে, পাকিস্তানেও ঘটবে।
          দ্রুত একটা উন্নয়নের তালিকা তৈরি করে ফেললেন প্রফেসর সালাম। কোন রকম সময় নষ্ট না করেই এই প্রকল্পগুলো বাস্তবায়িত হবে এরকম ইচ্ছে সালামের। সালামের প্রকল্পের তালিকা অনেকটা এরকম: (ক) বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষার উন্নয়ন, (খ) চিকিৎসা, জনস্বাস্থ্য ও পরিচ্ছন্নতার উন্নয়ন, (গ) খাদ্য ও চাষাবাদ এবং খাদ্য প্রযুক্তির উন্নয়ন, (ঘ) সেচ ব্যবস্থা ও মৃত্তিকা বিজ্ঞানের উন্নয়ন, (ঙ) শিল্প-কারখানায় সরবরাহের জন্য কাঁচামালের কারখানা প্রতিষ্ঠা, (চ) প্রতিরক্ষা বিজ্ঞানের উন্নয়ন।
          বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি শিক্ষার উন্নয়নের লক্ষ্যে শিক্ষাখাতে বরাদ্দ বাড়ানোর জন্য সরকারকে রাজি করাতে চেষ্টা করলেন আবদুস সালাম। তাতে অনেক সুফল পাওয়া গেলো। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় গঠিত হলো। আবদুস সালামের নেতৃত্বে জাতীয় বিজ্ঞান পরিষদ বা ন্যাশনাল সায়েন্স কাউন্সিল গঠন করা হলো। পাকিস্তানের জাতীয় আয়ের শতকরা এক ভাগ বরাদ্দ করা হলো বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ও গবেষণাগার স্থাপন করার জন্য।
          ১৯৬১ সালে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের প্রধান বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা নিয়োজিত হন প্রফেসর সালাম। আইয়ুব খানের সঙ্গে তাঁর সরাসরি কথা হয় যে কোন বৈজ্ঞানিক সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। লন্ডনে ইম্পেরিয়েল কলেজে অধ্যাপনা ও গবেষণা, আন্তর্জাতিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য নিরলস পরিশ্রম করেও পাকিস্তানের বিজ্ঞান-উন্নয়নের জন্য সময় বের করেন আবদুস সালাম।
          পাকিস্তানে কাজ করতে গিয়ে আবদুস সালামের সাথে পরিচয় হয় ডক্টর ইশরাত হোসেন উসমানির। করাচিতে একটা বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে দেখা হয় দু'জনের। ডক্টর উসমানি ১৯৩৭ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে পিএইচডি করেছেন। পাকিস্তানে ফিরে তিনি সরকারি প্রশাসনিক কাজে যোগ দিয়েছিলেন। তারপর তাঁর বিজ্ঞান-চর্চা একেবারেই বন্ধ ছিল প্রায় পঁচিশ বছর। এতদিন পর আবদুস সালামের কণা পদার্থবিজ্ঞানের ওপর বক্তৃতা শুনে উসমানির বিজ্ঞান-গবেষণার ইচ্ছে জেগে উঠলো পুরোমাত্রায়। করাচি থেকে লাহোরে ফেরার পথে আবদুস সালাম ও ইশরাত উসমানির মধ্যে অনেক কথা হলো। আবদুস সালাম দেখলেন প্রশাসনের এই সিনিয়র কর্মকর্তাকে দিয়ে পাকিস্তানের বিজ্ঞানের অনেক উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব।  
          প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সাথে পরামর্শ করে ডক্টর উসমানিকে প্রশাসন থেকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয়ে নিয়ে আসা হলো। পাকিস্তান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন গঠিত হবার পর ডক্টর ইশরাত হোসেন উসমানিকে কমিশনের চেয়ারম্যান পদে নিয়োগ দেয়া হয়। এসময় পাকিস্তানের জাতীয় মহাকাশ গবেষণা কেন্দ্রও স্থাপিত হয় আবদুস সালামের নেতৃত্বে। আবদুস সালামের উদ্যোগে ডক্টর উসমানি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাটমিক এনার্জি এজেন্সির বোর্ড অব ডিরেক্টর্‌স এর চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়েছিলেন ১৯৬২-৬৩ সালের জন্য।
          ডক্টর উসমানিকে সাথে নিয়ে প্রফেসর সালাম পাকিস্তানে অনেকগুলো বৈজ্ঞানিক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলেন। অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের আওতায় পাঁচ মেগাওয়াট শক্তি সম্পন্ন রিসার্চ রি-অ্যাক্টর তৈরি হয় পাকিস্তানে। ১৯৬৫ সালে ইসলামাবাদে স্থাপিত হয় পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি (PINSTECH)। এই প্রতিষ্ঠানের ভবন তৈরিতে সাহায্য করেন আমেরিকান স্থপতিরা। বিশ্বের সবচেয়ে সুন্দর বৈজ্ঞানিক ভবনগুলোর একটি হলো এও পিনস্টেক ভবন। এটাকে পাকিস্তানের 'বৈজ্ঞানিক তাজমহল' বলা হয়। 

ইসলামাবাদের পাকিস্তান ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি


মহাকাশ গবেষণার জন্য গঠিত হয় স্পেস অ্যান্ড আপার অ্যাটমোস্ফিয়ার রিসার্চ কমিটি- সুপারকো (SUPARCO)। আবদুস সালাম ছিলেন এই দুটো প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যান। ১৯৬২ সালে সুপারকো পাকিস্তানের প্রথম ওয়েদার রকেট উৎক্ষেপণ করে। দেশে নিউক্লিয়ার ইলেকট্রিসিটি নিউক্লিয়ার পাওয়ার রি-অ্যাক্টর স্থাপিত হয় করাচিতে। ১৩৭ মেগাওয়াট ক্ষমতা সম্পন্ন এই রি-অ্যাক্টর তৈরিতে কারিগরি সহায়তা নেয়া হয় কানাডা থেকে। প্রাকৃতিক ইউরেনিয়াম ও ভারী পানি ব্যবহার করা হয় এই রিঅ্যাক্টরে।
          এসব কর্মযজ্ঞে পাকিস্তানের প্রচুর তরুণ বিজ্ঞানের দিকে আকৃষ্ট হলো। প্রচুর কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হলো। প্রায় তেরো বছর ধরে নিরলস কাজ করেছেন আবদুস সালাম পাকিস্তানের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়নে। এই সময়ে চার শতাধিক পাকিস্তানি তরুণকে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির সর্বোচ্চ প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষ জনশক্তি তৈরি করেছেন। তাঁরা নিউক্লিয়ার ফিজিক্স, নিউক্লিয়ার ইঞ্জিনিয়ারিংসহ পদার্থবিজ্ঞানের নানা শাখায় অবদান রাখতে পেরেছেন।
           আবদুস সালামের উদ্যোগে বেশ কয়েকটি ধান ও গম গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি হলো পাকিস্তানে। পাকিস্তানের নদী শাসন ও পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা খুবই নাজুক। বন্যা ও খরা পাকিস্তানের নিত্যসঙ্গী। পশ্চিম পাকিস্তানের অনেক জমির মাটিতে লবণাক্ততা এত বেশি যে সেখানে ফসল ফলানো প্রায় অসম্ভব। মুগল আমল থেকে এই সমস্যায় ভুগছে সেই অঞ্চলের মানুষ। দুশ' বছরের ইংরেজ শাসনেও অবস্থার কোন উন্নতি হয়নি। কীভাবে এর উন্নয়ন ঘটানো যায় সে ব্যাপারে কারো কোন ধারণা নেই। আবদুস সালাম ইউরোপ ও আমেরিকা থেকে বিশেষজ্ঞ বিজ্ঞানীদের নিয়ে এলেন পাকিস্তানে। সেই বিশেষজ্ঞ দলে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট কেনেডির বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টা জেরি ওয়াইজনারও ছিলেন।
          সব দেখে শুনে একটা সাময়িক সমাধান দিলেন বিশেষজ্ঞরা। প্রচুর গভীর নলকূপ স্থাপন করে ভূগর্ভস্থ পানি দিয়ে জমি ধুয়ে ফেলতে হবে। গভীর নলকূপের পানি দিয়ে চাষাবাদ করতে হবে। কিন্তু যতগুলো গভীর নলকূপ স্থাপন করতে হবে - তার খরচ জোগানোর মতো যথেষ্ট অর্থ সরকারের নেই। শুধু এই প্রকল্পের ক্ষেত্রে নয়, অন্যান্য সব উন্নয়ন প্রকল্পের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার ঘটলো।
          একটা ব্যাপার এখানে লক্ষ্যণীয়- আবদুস সালামের এবং পাকিস্তান সরকারের সবগুলো প্রকল্পেরই লক্ষ্যস্থল ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়ন। পূর্ব-পাকিস্তান দেশের অংশ হলেও সেখানকার উন্নতির প্রতি কারোরই কোন নজর ছিল না। বরং পূর্ব-পাকিস্তানে উৎপন্ন খাদ্যশস্যের প্রায় সবটুকুই তারা পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেতো। আবদুস সালাম তাঁর পাকিস্তানের উন্নয়ন পরিকল্পনায় পূর্ব-পাকিস্তান সম্পর্কে আলাদা করে কখনোই কিছু বলেননি।
          সরকারের উন্নয়ন মন্ত্রণালয় সালামের প্রকল্পগুলোর ব্যাপারে যতই হ্যাঁ হ্যাঁ করুক- অর্থ মন্ত্রণালয় টাকা জোগাতে অপারগ। এ ধরণের উন্নয়ন পরিকল্পনার সুফল পেতে হলে এক সাথে বিশাল অংকের টাকা খরচ করতে হয়। ছোটখাট বাজেট - এখানে একটু, ওখানে একটু করলে কোন উন্নয়নই হয় না, কেবল পন্ডশ্রম হয়, টাকাগুলোও জলে যায়। আবদুস সালামের প্রকল্পগুলোর ক্ষেত্রেও প্রায় সেরকম ফলই পাওয়া গেলো। পাঁচ-ছয় বছর ধরে চেষ্টা করেও তাঁর কোন প্রকল্প থেকেই কোন দৃষ্টিগ্রাহ্য উন্নয়ন সম্ভব হলো না।
          আবদুস সালাম দেখলেন সরকারের বেশির ভাগ বাজেটই খরচ হয়ে যাচ্ছে প্রতিরক্ষা খাতে। অথচ প্রতিরক্ষার উন্নয়ন আছে তাঁর তালিকার একেবারে শেষে। পাকিস্তান সরকার বার্ষিক আয়ের বেশির ভাগই খরচ করে ফেলছে ভারতের সাথে যুদ্ধ করে কিংবা যুদ্ধের প্রস্তুতিতে। এই যুদ্ধ যদি বন্ধ করা যায় - তাহলে সবগুলো উন্নয়ন প্রকল্পই বাস্তবায়িত করা যায় কত সহজে।
          প্রফেসর সালাম ভাবলেন যদি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরু সামনা সামনি বসে আলোচনার মাধ্যমে দু'দেশের সমস্যার সমাধান করে ফেলেন তাহলে তো আর যুদ্ধ করতে হয় না। কিন্তু যুদ্ধ চলে গেলে মিলিটারি নির্ভর পাকিস্তান সরকারের আর থাকে কী?
          তবুও চেষ্টা করে দেখতে দোষ কী? ১৯৬৪ সালে ভারতের উদয়পুরে ইন্ডিয়ান অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান হোমি ভাবার উদ্যোগে বৈজ্ঞানিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে হোমি ভাবার সাথে দুই দেশের নেতার সরাসরি বৈঠক সম্পর্কে আলোচনা করলেন আবদুস সালাম। আবদুস সালামের সাথে প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের যেরকম অন্তরঙ্গ সম্পর্ক, সেরকমই সম্পর্ক হোমি ভাবার সাথে প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর। ঠিক হলো আবদুস সালাম আইয়ুব খানকে রাজি করাতে চেষ্টা করবেন, আর হোমি ভাবা জওহরলাল নেহেরুকে। কিন্তু কারো চেষ্টাতেই কিছু হলো না।
          আবদুস সালাম তবুও আশা ছাড়েন না পুরোপুরি। তিনি লন্ডন-পাকিস্তান করতেই থাকেন। প্রায় প্রতি মাসেই তিনি লন্ডন থেকে পাকিস্তানে যান বৈজ্ঞানিক কাজে।
          ১৯৬৫ সালের আগস্ট মাসে সোয়াতে একটা উঁচু পর্যায়ের বৈজ্ঞানিক সম্মেলনের আয়োজন করা হয়। পাকিস্তানের শীর্ষ পর্যায়ের সব বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা উপস্থিত সেখানে। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান উদ্বোধন করেন সেই সম্মেলন। বৈজ্ঞানিক উন্নয়ন নিয়ে অনেক সুন্দর সুন্দর কথা বলা হলেও আবদুস সালাম বুঝতে পারছেন যে কাজের কাজ কিছুই হবে না। কারণ সবাই কেমন যেন উশখুশ করছেন। কারণ যে কোন মুহূর্তেই ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ শুরু হয়ে যেতে পারে। সম্মেলনের শেষের দিন সালাম যখন লন্ডনের উদ্দেশ্যে রওনা হচ্ছেন - যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলো। হতাশ হয়ে পড়লেন আবদুস সালাম। তৃতীয় বিশ্বে স্বপ্ন দেখা সহজ, কিন্তু বাস্তবায়ন মোটেও সহজ নয়। তিনি ভাবতে লাগলেন- এর কারণ কী?
          পরের এক দশক ধরে পাকিস্তানের উন্নয়নে অনেক কাজ করেছেন আবদুস সালাম। কিন্তু উল্লেখযোগ্য কোন পরিবর্তনই তিনি করতে পারেননি। তবে প্রচুর পাকিস্তানি তরুণকে বিজ্ঞানে উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছেন।


        ১৯৬৯ সালে আইয়ুব খান ক্ষমতা হারালেন। এলেন ইয়াহিয়া খান। কিন্তু ইয়াহিয়া খানের সাথে আবদুস সালামের কোন রকম সহজ সম্পর্ক গড়ে উঠলো না। ১৯৭১ সালে নয় মাস ব্যাপী মুক্তিযুদ্ধে তিরিশ লাখ শহীদের রক্তের বিনিময়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হলো। ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত সামরিক শক্তি প্রয়োগ করে ইতিহাসের জঘন্যতম গণহত্যা করেও স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম ঠেকাতে পারলো না। তার নিজের ক্ষমতাও চলে গেলো। তার জায়গায় ক্ষমতা দখল করলেন জুলফিকার আলি ভুট্টো।
       ভুট্টো ক্ষমতায় আসার পর আবদুস সালাম খুবই অস্বস্তিতে পড়লেন। ভুট্টোর সাথে তাঁর সম্পর্কটা কখনোই সহজ ছিলো না। ১৯৫৮ সালে আইয়ুব খানের অনুরোধে আবদুস সালাম যখন দেশের কাজে আসেন ভুট্টো ছিলেন আইয়ুব খানের জ্বালানি ও শক্তি মন্ত্রী। আইয়ুব খানের মন্ত্রী থাকাকালিন আবদুস সালামের সবগুলো প্রকল্পে ভুট্টো সহযোগিতা করতে বাধ্য হয়েছিলেন। কিন্তু পররষ্ট্রমন্ত্রী হবার পর আঞ্চলিক শান্তি প্রতিষ্ঠার প্রতি খুব একটা আগ্রহ ছিলো না ভুট্টোর। পারমাণবিক শক্তিকে শান্তিপূর্ণ উপায়ে ব্যবহার করার চেয়ে পারমাণবিক অস্ত্র বানানোর প্রতিই বেশি ঝোঁক ছিল ভুট্টোর। ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধে হেরে যাবার পর ভুট্টো আরো হিংস্র হয়ে ওঠেন পারমাণবিক অস্ত্র পাবার ব্যাপারে। ১৯৬৭ সালে ভুট্টোকে মন্ত্রীসভা থেকে বরখাস্ত করেন আইয়ুব খান। পরের বছর পাকিস্তান পিপল্‌স পার্টি প্রতিষ্ঠা করেন ভুট্টো।
          ইয়াহিয়া খান ১৯৭০ সালে সাধারণ নির্বাচন দিলে ভুট্টোর দল পশ্চিম পাকিস্তানের ১৩৮টি আসনের মধ্যে ৮১টিতে জিতেন। এদিকে পূর্ব পাকিস্তানের ১৬৯টি আসনের মধ্যে ১৬৭ আসনে জিতেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের দল আওয়ামী লিগ। গণতান্ত্রিক নিয়ম অনুযায়ী বঙ্গবন্ধুরই সমগ্র পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হবার কথা। কিন্তু ভুট্টো তা মানতে রাজি নন। তারপর আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস তো সবার জানা। আমাদের মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষে প্রফেসর আবদুস সালামের কোন ভূমিকার কথা কোথাও জানা যায়নি।
          ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে পাকিস্তানি মিলিটারিরা যখন আত্মসমর্পণ করে - পাকিস্তানি দাম্ভিক মিলিটারিদের মেরুদন্ড ভেঙে যায়। তারা যখন লজ্জায় মুখ ঢাকতে ব্যস্ত ভুট্টো তখন পাকিস্তানের ক্ষমতা দখল করলেন। কট্টর ধর্মকে পুঁজি করে তিনি ক্ষমতায় থাকতে চাইলেন। তেল সমৃদ্ধ ধনী মুসলিম দেশগুলোর সমর্থন লাভ করতে সচেষ্ট হলেন। আর দেশের মধ্যে ধর্মীয় উন্মাদনা ছড়িয়ে দিলেন। আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে সাম্প্রদায়িকতা উস্কে দিলেন তিনি।
          ১৯৭১ সালে পরাজয়ের লজ্জা ঢাকার জন্য এবং মিলিটারিদের হাতে রেখে ক্ষমতায় থাকার জন্য ভুট্টো মিলিটারিদের বাজেট বাড়িয়ে দিলেন। ফলে আবদুস সালামের সবগুলো উন্নয়ন প্রকল্প অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে গেলো। ভুট্টো আবদুস সালাম ও অ্যাটমিক এনার্জি কমিশনের চেয়ারম্যান ডক্টর উসমানিকে ডেকে বললেন পারমাণবিক বোমা বানানোর ব্যবস্থা করতে।
          আবদুস সালাম শান্তিপূর্ণ উপায়ে পারমাণবিক শক্তি ব্যবহারের পক্ষে। তিনি জাতিসংঘের 'পিসফুল ইউজ অব অ্যাটমিক এনার্জি'র উদ্যোক্তা। ১৯৬৮ সালে তিনি এ জন্যে পুরষ্কারও পেয়েছেন। তিনি তো পারমাণবিক বোমা বানানোর ব্যাপারে সম্মতি দিতে পারেন না। ডক্টর উসমানিও পারমাণবিক বোমা বানানোর ঘোর বিরোধি। ফলে ভুট্টোর আদেশে অ্যাটমিক এনার্জি কমিশন থেকে পদত্যাগ করতে বাধ্য হলেন ডক্টর উসমানি।
          আবদুস সালামকে পারমাণবিক শক্তি কমিশন থেকে সরিয়ে দিলে আন্তর্জাতিক সমালোচনা হতে পারে ভেবে আবদুস সালামকে কিছু বললেন না ভুট্টো। কিন্তু প্রেসিডেন্টের বৈজ্ঞানিক উপদেষ্টার পদ হারালেন আবদুস সালাম। সালাম অপমানিত বোধ করেছেন, কিন্তু তখনো কমিশন থেকে পদত্যাগ করেননি। তিনি পদত্যাগ করেছেন আরো দু'বছর পর ১৯৭৪ সালে।
          ১৯৭৪ সালের মে মাসে ভারত তাদের প্রথম পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটায়। এতে অপমানে রক্তে আগুন ধরে যায় জুলিফিকার আলি ভুট্টোর। তিনি জনগণের সামনে প্রতিজ্ঞা করেন, "ইন্ডিয়া যদি অ্যাটম বোমা বানাতে পারে, আমরা পারবো না কেন? আমরা দরকার হলে ঘাসপাতা খেয়ে থাকবো, দরকার হলে না খেয়ে থাকবো, তবুও আমাদের অ্যাটম বোমা বানাতেই হবে। অ্যাটম বোমা ছাড়া আমাদের আর কোন বিকল্প নেই।"


ভাষণ দিচ্ছেন আবদুস সালাম। বসে আছেন ভুট্টো 

ভুট্টো আবদুস সালামকে চাপ দিলেন পাকিস্তান সরকারের পূর্ণকালীন বৈজ্ঞানিক পদে যোগ দিতে। কিন্তু সালামের পক্ষে ইম্পেরিয়েল কলেজের গবেষণা, ইতালিতে নিজের গড়া ইন্টারন্যাশনাল সেন্টার ফর থিওরেটিক্যাল ফিজিক্স সেন্টার ছেড়ে পুরোপুরি পাকিস্তানে চলে আসা সম্ভব নয়। এর কিছুদিন পরেই ১৯৭৪ সালের সেপ্টেম্বরে জাতীয় পরিষদে আহমদিয়াদের অমুসলমান ঘোষণা করলেন ভুট্টো। ধর্মান্ধরা সাম্প্রদায়িকতার যে আগুন জ্বালানোর জন্য এতদিন ধরে ফুঁ দিচ্ছিলো - দপ্‌ করে জ্বলে উঠলো সারা পাকিস্তানে। শত শত আহমদিয়ার রক্তে রঞ্জিত হলো পাকিস্তানের পথ। আহমদিয়াদের ঘরবাড়ি, দোকানপাট, মসজিদ আগুনে পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। মুলতানে আবদুস সালামদের বাড়িও রেহাই পেলো না। তাদের ঔষধের দোকান পুড়ে ছাই হয়ে গেলো। একেবারে ধ্বংস হয়ে গেলো আবদুস সালামের বিশ্বাসের ভিত।
          আবদুস সালাম ভেবে দেখলেন পাকিস্তানিদের চোখে তিনি এখন একজন আহমদিয়া। রাষ্ট্র যেখানে আহমদিয়াদের অধিকারে বিশ্বাসী নয়, সেক্ষেত্রে তাঁকেও তো কেউ আর বিশ্বাস করবে না। ভুট্টোর সাথে দেখা করে তিনি পদত্যাগপত্র তুলে দিলেন ভুট্টোর হাতে।
          সালাম তাঁর পদত্যাগপত্রে প্রেসিডেন্ট ভুট্টোকে উদ্দ্যেশ্য করে লিখলেন, "আপনি জানেন যে আমি একজন আহমদিয়া সম্প্রদায়ের সদস্য। সম্প্রতি জাতীয় পরিষদে আহমদিয়া সম্প্রদায় সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে আমি বিশ্বাস করি তা ইসলামের মূল লক্ষ্যের সাথে সঙ্গতিহীন। কারণ ইসলাম ধর্মে কাউকে অন্যের ধর্মীয় বিশ্বাস সম্পর্কে সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষমতা দেয়া হয়নি। মানুষের ধর্মীয় বিশ্বাস একান্তই ব্যক্তিগত, এবং এই বিশ্বাস শুধুমাত্র তাঁর এবং তাঁর সৃষ্টিকর্তার মধ্যে। সেখানে অন্য কারো কিছু বলা ইসলাম বিরোধী।"
          ভুট্টো আবদুস সালামের পদত্যাগপত্র গ্রহণ করে ভদ্রতা রক্ষার্থে বললেন, "যোগাযোগ রাখবেন। জানেন তো এসব শুধুমাত্র রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। কোন কিছুই আমার ব্যক্তিগত নয়। আমাকে কিছুটা সময় দেন, আমি আবার সবকিছু বদলে দেবো।"
          আবদুস সালামও জানেন এসব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আহমদিয়াদের সম্পর্কে ভুট্টোর কোন ব্যক্তিগত আক্রোশ বা বিদ্বেষের পরিচয় আবদুস সালাম আগে কখনো পাননি। কিন্তু তবুও আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে আইনগত সিদ্ধান্তটা তো ভুট্টোই নিয়েছেন। আবদুস সালাম ভুট্টোকে বললেন, "আপনি যে কথাগুলো আমাকে বললেন সেগুলো যদি একটা কাগজে লিখে দেন, আমি আমার পদত্যাগপত্র ফিরিয়ে নিতে পারি।"
          "না, আমি কোন কিছু লিখিত দিতে পারবো না।" ভুট্টোর সরাসরি উত্তর। খুবই হতাশ হয়ে লন্ডনে ফিরে এলেন আবদুস সালাম। আহমদিয়াদের অমুসলিম ঘোষণার প্রতিবাদে নিজেকে আরো বেশি মুসলমান প্রমাণ করার জন্য তিনি নামের আগে মোহাম্মদ লিখতে শুরু করলেন, এবং দাড়ি রাখতে শুরু করলেন।
          তারপরও যখনই সুযোগ পেয়েছেন পাকিস্তানের বিজ্ঞান উন্নয়নে সাহায্য করেছেন আবদুস সালাম। নোবেল পুরষ্কার পাবার পর পুরষ্কারের পুরো অর্থই খরচ করেছেন পাকিস্তানিদের পুরষ্কার দেবার জন্য। পাকিস্তানি শিক্ষার্থীদের জন্য তাঁর অফিসের দরজা সবসময়ই খোলা থাকতো। পাকিস্তানের প্রতি ভালোবাসার কারণে প্রায় সারাজীবন ইউরোপে কাটালেও পাকিস্তান ছাড়া আর কোন দেশের নাগরিকত্ব গ্রহণ করেননি আবদুস সালাম। মৃত্যুর পরে তাঁর ইচ্ছেমতো দেহটাও ফিরে গেছে পাকিস্তানের মাটিতে।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts