Monday 30 March 2020

পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ৪


আবার কেমব্রিজ, এবং ইম্পেরিয়েল কলেজ

কেমব্রিজে এসে সেন্ট জোন্স কলেজের কাছে ব্রিজ স্ট্রিটে একটা অ্যাপার্টমেন্ট ভাড়া নিলেন আবদুস সালাম। ইংল্যান্ডের শীতের সাথে পরিচয় আছে তাঁর, কিন্তু ডিসেম্বরের তুষারঝরা ঠান্ডায় একেবারে জমে যাবার অবস্থা তাঁর স্ত্রী ও তিন বছরের মেয়ের। বাসায় রুম হিটিং-এর ব্যবস্থাও ততো ভালো নয়। তাছাড়া ভাষা নিয়েও সমস্যা হচ্ছে সালামের স্ত্রীর। কাজ চালানোর মতো ইংরেজিও জানেন না হাফিজা। ফলে ঘর থেকে বেরোনোর কোন উপায় নেই তাঁর। এতদিন আবদুস সালামের গাড়ির দরকার হয়নি। এবার স্ত্রী-কন্যাকে নিয়ে বেরোতে গেলেই গাড়ির দরকার হয়। ড্রাইভিং শিখতে হলো আবদুস সালামকে। কিন্তু ড্রাইভিং টেস্টে রিভার্স পার্কিং-এ ফেল করলেন তিনি। জীবনে প্রথমবার কোন পরীক্ষাতে ফেল করলেন আবদুস সালাম - হোক না সেটা গাড়ি চালানোর লাইসেন্স পাবার পরীক্ষা।
          কেমব্রিজে গণিতের লেকচারার হিসেবে আবদুস সালামের বেতন নির্ধারিত হলো বছরে ৪৫০ পাউন্ড। সেন্ট জোন্স কলেজের ফেলোশিপ থেকে পান বছরে তিনশ' পাউন্ড এবং অন্যান্য ভাতা বাবদ বছরে দু'শ পাউন্ড। সেই সময় বছরে সাড়ে নয়শ' পাউন্ডে বেশ সচ্ছলভাবেই দিন চলে যাচ্ছিলো সালামদের।
          কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা শুরু করলেন আবদুস সালাম ১৯৫৪ সালের শুরু থেকে। সপ্তাহে তিন ঘন্টা ক্লাস নিতে হয় স্নাতক পর্যায়ে, তিন ঘন্টা লেকচার দিতে হয় পিএইচডি স্টুডেন্টদের, আর  ছয় ঘন্টা স্নাতক শিক্ষার্থীদের গবেষণা প্রকল্পের তদারকি করতে হয়। এই নির্ধারিত ক্লাসগুলো ছাড়াও সেই বছর 'ডিরাক কোর্স'ও পড়াতে হলো আবদুস সালামকে। 
        কোয়ান্টাম মেকানিক্স কোর্স পড়াতেন নোবেল বিজয়ী পল ডিরাক। ছাত্রাবস্থায় ডিরাকের এই কোর্স করেই পদার্থবিজ্ঞানের প্রতি আকৃষ্ট হয়েছিলেন আবদুস সালাম। ১৯৫৪ সালে পল ডিরাক প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে গেলে ডিরাকের কোর্সটা পড়ানোর দায়িত্ব পান আবদুস সালাম। আটাশ বছরের তরুণ আবদুস সালামের জন্য এটা ছিল একটা বিরাট সম্মান। পল ডিরাক পড়ানোর সময় তাঁর 'ইনট্রোডাকশান টু কোয়ান্টাম মেকানিক্স' বই থেকে হুবহু পড়ে যেতেন। বইয়ের বাইরে অতিরিক্ত একটা শব্দও উচ্চারণ করতেন না। আবদুস সালামের পড়ানোর স্টাইল স্বাভাবিক ভাবেই ডিরাকের লেকচারের চেয়ে প্রাণবন্ত হলো। ছাত্রদের কাছে অনেক প্রিয় হয়ে উঠলেন আবদুস সালাম। 
          পারিবারিক জীবনও বেশ সুখেই কাটছে আবদুস সালামের। তাঁর ছোট ভাই আবদুল মজিদকে নিয়ে এসেছেন কেমব্রিজে। সেন্ট জোন্স কলেজে বিজ্ঞানের স্নাতক ক্লাসে ভর্তি করে দিয়েছেন তাকে। (কেমব্রিজের ডিগ্রি শেষ করে আবদুল মজিদ পাকিস্তানে ফিরে গিয়েছিলেন ম্যানুফ্যাকচারিং কেমিস্ট হিসেবে। পাকিস্তানের পেনিসিলিন ইন্ডাস্ট্রিতে বিরাট উন্নয়ন ঘটিয়েছিলেন তিনি। পরে তিনি জাতিসংঘের ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশান - ইউনিডো'র ভিয়েনা অফিসে কাজ করেছেন অনেক বছর ফার্মাসিউটিক্যাল ইন্ডাস্ট্রির কারিগরি উপদেষ্টা হিসেবে।) ১৯৫৪ সালের নভেম্বরে আবদুস সালাম ও হাফিজা বেগমের দ্বিতীয় কন্যা আসিফার জন্ম হয়। 
          কেমব্রিজে ক্লাস নেয়ার পেছনে অনেক সময় চলে গেলেও জোরেশোরে গবেষণা শুরু করলেন আবদুস সালাম। প্রফেসর কেমার চলে যাওয়াতে কেমারের বেশ কয়েকজন পিএইচডি ছাত্র এখন সালামের তত্ত্বাবধানে গবেষণা করছেন। সালামের গবেষক ছাত্রদের একজন ছিলেন ওয়াল্টার গিলবার্ট। ১৯৫৫ সালে সালাম আর গিলবার্ট মৌলিক কণার ওপর কাজ করেন। সালামের সাথে কাজ করার সময়েই গিলবার্টের পরিচয় হয় জেম্‌স ওয়াটসনের সাথে। দু'বছর আগে ১৯৫৩ সালে কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে ফ্রান্সিস ক্রিক ও জেম্‌স ওয়াট্‌সন ডিএনএ'র গঠন আবিষ্কার করেছেন।
          ১৯৫৭ সালে গিলবার্ট সালামের অধীনে পিএইচডি অর্জন করে হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটিতে যোগ দেন। জেম্‌স ওয়াটসনও তখন হার্ভার্ডে চলে গেছেন। গিলবার্ট হার্ভার্ডে গিয়ে কাজ করেন জেম্‌স ওয়াটসনের গ্রুপে। ডিএনএ'র আণবিক উপাদান সংক্রান্ত যুগান্তকারী আবিষ্কারের জন্য ১৯৮০ সালে রসায়নে নোবেল পুরষ্কার পান গিলবার্ট। পরে হিউম্যান জিনোম প্রজেক্টের অন্যতম প্রধান গবেষক হন ওয়াল্টার গিলবার্ট।
          আবদুস সালামের গাইড ও গবেষণা সহযোগী পল ম্যাথিউজ তখন বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটিতে। সালাম তাঁর সাথে আবার গবেষণা শুরু করলেন।

আবদুস সালাম ও পল ম্যাথিউজ

 
১৯৫৪ সালের শেষে তাঁরা একটি পেপার পাঠালেন ফিজিক্যাল রিভিউতে। প্রফেসর পিয়ার্লস পেপারটার একটা মুখবন্ধও লিখে দিয়েছিলেন। কিন্তু পেপারটি প্রত্যাখ্যাত হলো। ভীষণ ধাক্কা খেলেন আবদুস সালাম। সাধারণত গবেষণাপত্রের রেফারির নাম গোপন থাকে। কিন্তু আবদুস সালাম ব্যক্তিগত উদ্যোগে খবর নিয়ে জানতে পারলেন যে তাঁদের পেপারটির রেফারি ছিলেন ফ্রিম্যান ডাইসন। ফ্রিম্যান ডাইসন তাঁদের গবেষণাপত্র রিজেক্ট করেছেন এই যুক্তিতে যে ওটা অনেকটা বইয়ের অধ্যায়ের মতো হয়ে গেছে ফলে ফিজিক্যাল রিভিউতে প্রকাশের যোগ্যতা হারিয়েছে। 
আবদুস সালাম হতাশ না হয়ে পেপারটি ইতালির নভো সিমেন্টো জার্নালে পাঠালেন। ১৯৫৫ সালের জুলাই মাসে তা প্রকাশিত হলো সেখানে। সালাম ক্রমশ বুঝতে পারছিলেন যে তাঁদের রি-নরমালাইজেশান থিওরি দ্রুত আকর্ষণ হারাচ্ছে, তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান দ্রুত বদলে যাচ্ছে। গতির সাথে তাল মেলাতে না পারলে গবেষণা জগতে টিকে থাকতে পারবেন না। সালাম নতুন বিষয় নিয়ে ভাবতে শুরু করলেন - নিউট্রিনোর ভর এবং চার্জ না থাকার বিশেষত্ব কী?
          ১৯৫৫ সালে জাতিসংঘ কর্তৃক আহূত শান্তির জন্য পরমাণু সম্মেলনের বৈজ্ঞানিক সচিব নিযুক্ত হলেন আবদুস সালাম। ভারতের বিজ্ঞানী ডক্টর হোমি ভাবা হলেন সভাপতি। জাতিসংঘে আবদুস সালামের এই আনুষ্ঠানিক যোগদানের নেপথ্যে স্যার মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খানের প্রত্যক্ষ ভূমিকা ছিল। মৌলবাদীদের দাবির মুখে জাফরুল্লাহ খান পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। তারপর থেকে তিনি জাতিসংঘের পাকিস্তান প্রতিনিধি হিসেবে নিউইয়র্কে কাজ করছিলেন।
          অ্যাটম ফর পিস বা শান্তির জন্য পরমাণু'র বিখ্যাত সম্মেলনে আবদুস সালাম অভিভূত হয়ে অনুভব করলেন বিশ্বমানবতায় বিশ্ব-বিজ্ঞানের অবদান রাখার ক্ষমতা অসীম। পদার্থবিজ্ঞানের জন্য একটি আন্তর্জাতিক কেন্দ্র প্রতিষ্ঠার চিন্তা এখান থেকেই তাঁর মনে আসে। তিনি বুঝতে পারেন- তৃতীয় বিশ্বে সুযোগ এত কম আসে যে সবচেয়ে ভালো ছাত্র-ছাত্রীর পক্ষেও কোন সুযোগ পাওয়া অসম্ভব হয়ে ওঠে। তৃতীয় বিশ্বের ভালোদের সুযোগ করে দেয়ার জন্য তিনি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ হলেন তত্ত্বীয় পদার্থবিদ্যার আন্তর্জাতিক কেন্দ্র গড়ার ব্যাপারে। কারণ তিনি জানতেন তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান অল্প কয়েকটি বিষয়ের একটি যে বিজ্ঞানে খুব অল্প ঐতিহ্য সম্বল করেও বেশ ভালো বিজ্ঞানী তৈরি করা যায়। তৎকালীন পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে আন্তর্জাতিক পারমাণবিক সংস্থায় তিনি এ ধরনের কেন্দ্র স্থাপন করার প্রস্তাব করেন।
          ১৯৫৬ সালের সেপ্টেম্বরে আমেরিকার সিয়াটলে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে আবদুস সালাম পদার্থবিজ্ঞানের একটা নতুন ধরনের সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলেন। ঐ সম্মেলনে দু'জন তরুণ চায়নিজ পদার্থবিজ্ঞানী সুং ডাও লি এবং চেন নিং ইয়াং পারমাণবিক কণার প্যারিটি ভায়োলেশান (parity violation) ব্যাখ্যা করেন। লি ও ইয়াং শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে ভারতীয় বংশোদ্ভূত অধ্যাপক চন্দ্রশেখর সুব্রাহ্মনিয়ামের ছাত্র ছিলেন।
          পরমাণুর নিউক্লিয়াসের মধ্যে বিটা ক্ষয় (beta decay) তথা দুর্বল পারমাণবিক বিক্রিয়া কেন ঘটে কে ঘটায় সে সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন তত্ত্ব তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। ভরহীন নিউট্রিনোর ভূমিকা নিয়ে অনেক তত্ত্বীয় গবেষণা চলছে। এর মধ্যে ইয়াং ও লি ধারণা দিচ্ছেন যে অতি-পারমাণবিক কণাগুলোর ধর্ম তাদের ঘূর্ণনের দিকের ওপর নির্ভরশীল হতে পারে। কণার স্পিন বা ঘূর্ণনের দিকের ওপর অনেক কাজ হয়েছে ইতোমধ্যে। একটি কর্কস্ক্রু ডানদিকে ঘুরালে যেদিকে যাবে বামদিকে ঘুরালে যাবে তার বিপরীতদিকে। কিন্তু এতে তো কর্ক-স্ক্রুর ধর্ম বদলে যেতে পারে না। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের অলিখিত প্রধান বিচারক উল্‌ফগং পাউলি বিশ্বাস করেন যে পারমাণবিক বা অতিপারমাণবিক কোন কণার ধর্মই দিক-নির্ভর নয়। কর্ক-স্ক্রুকে যেমন ইচ্ছে করলে যে কোন দিকেই নিয়ে যাওয়া যায় - কণার বেলাতেও সেরকম সম্ভব।
          কিন্তু লি এবং ইয়াং ধারণা করছেন মানুষের মধ্যে যেমন ডানহাতি ও বাঁহাতি মানুষ আছে, সেরকম পারমাণবিক কণার মধ্যেও আছে। ধরা যাক একটি দরজা ঘড়ির কাঁটা যেদিকে ঘোরে সেদিকে খোলে এবং আরেকটি দরজা খোলে ঘড়ির কাঁটার বিপরীত দিকে। এখন যদি এই দুটো দরজা থেকে দুটো কণা নির্গত হয় - তাদের দিক হবে পরস্পর বিপরীত। এ তো হলো ধারণা। কিন্তু পরীক্ষামূলক প্রমাণ ছাড়া তো কিছুই সুনির্দিষ্টভাবে বলা সম্ভব নয়। নিউইয়র্কের কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে এই ধারণা পরীক্ষা করে দেখার চেষ্টা চলছে।
          যেহেতু অধ্যাপক পাউলি এই ধারণা সমর্থন করেন না, বেশির ভাগ বিজ্ঞানীই পাউলির সাথে একমত। কিন্তু সিয়াটল সম্মেলনে আবদুস সালামের মনে হলো এরকম হওয়া সম্ভব। আমেরিকা থেকে ইংল্যান্ডে ফেরার পথে প্লেনে বসে সারা রাত ভাবলেন। দুর্বল নিউক্লিয়ার মিথষ্ক্রিয়ায় উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখে নিউট্রিনো। যদি নিউট্রিনো ভরশূন্য হয় - তার বেগ হয় আলোর বেগের সমান। মনে হয় যেন একটা ক্ষুদ্র কর্ক-স্ক্রু আলোর বেগে গর্ত খুঁড়ে চলেছে। এখন এই নিউট্রিনোকে যদি পেছন দিক থেকে লক্ষ্য করা হয় মনে হবে এটা ডানদিকে ঘুরছে। এখন এটাকে যদি টেনে খুলে নেয়া হয় - এটা বাম দিকে ঘুরতে ঘুরতে বেরিয়ে আসবে। কিন্তু সমস্যা হলো আলোর বেগে ঘুরছে যে স্ক্রু তাকে তো অন্যদিকে টেনে বের করা যাবে না। ওটাতো একই দিকে ঘুরতে থাকবে। এখন নিউট্রিনো যদি ভরহীন হয় - তাহলে একটা নিউট্রিনোর স্বাক্ষর হলো তার ঘূর্ণনের দিক। সেক্ষেত্রে তার যদি প্রতিবিম্ব নেয়া হয় - প্রতিবিম্বে দেখা যাবে নিউট্রিনোটি বিপরীত দিকে ঘুরছে। তার মানে প্রতিবিম্বের নিউট্রিনোর ধর্ম বদলে গেলো। ডান-বামের সাম্যতা এখানে লঙ্ঘিত হচ্ছে। অর্থাৎ প্রমাণিত হচ্ছে নিউট্রিনোর ভরশূন্যতা প্যারিটি ভায়োলেশানের কারণ।
          ইংল্যান্ডে ফিরে কয়েকদিনের মধ্যেই প্রয়োজনীয় গাণিতিক হিসেব করে ফেললেন আবদুস সালাম। তারপর সেগুলো নিয়ে ছুটে গিয়ে উঠলেন বার্মিংহামগামী ট্রেনে। বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির প্রফেসর পিয়ার্লস পাউলির ঘোর সমর্থক। তিনি আবদুস সালামের পেপারটাতে একটু চোখ বুলিয়েই বলে দিলেন, "আমি বিশ্বাস করি না যে দুর্বল নিউক্লিয়ার মিথষ্ক্রিয়ায় বাম-ডানের সাম্যতা লঙ্ঘিত হয়।"
          এবার কী করবেন আবদুস সালাম? তাঁর ইচ্ছে করছে প্রফেসর পাউলির সাথে সরাসরি কথা বলতে। কিন্তু পাউলিকে ভয় পান আবদুস সালাম। শুধু সালাম কেন অনেকেই ভয় পান পাউলিকে। সালাম ভাবলেন সার্নের কোন বিজ্ঞানীর সাথে আগে আলাপ করা যাক। ১৯৫৪ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ইউরোপের নিউক্লিয়ার গবেষণা কেন্দ্র সার্ন (CERN)। মাত্র দু'বছরের মাথায় সেখানে নিউট্রিনো শনাক্ত করা সম্ভব হয়েছে। আবদুস সালাম তাঁর পেপারটি নিয়ে সার্নে এলেন। পাউলি তখন তাঁর জুরিখের বাড়িতে। সালাম সার্নের বিজ্ঞানী ফিলিক্স ভিলারকে দিয়ে পাউলির কাছে তাঁর প্যারিটি ভায়োলেশানের পেপারটা পাঠিয়ে দিলেন। পাউলি পেপারটা নিয়ে ফিলিক্সকে বললেন, "বন্ধু সালামকে আমার শুভেচ্ছা জানিয়ে বলো এর চেয়ে ভালো কিছু চিন্তা করতে।"
          সালাম পাউলির মন্তব্য শুনে একেবারে গুটিয়ে গেলেন। পাউলি জোর গলায় ঘোষণা দিয়ে রেখেছেন নিউট্রিনোর ডান-বাম সাম্যতা যে লঙ্ঘিত হবে না সে ব্যাপারে তিনি মোটা অংকের বাজি ধরতে রাজি আছেন। সালাম প্যারিটি ভায়োলেশানের পেপারটা আর প্রকাশ করলেন না।  কিন্তু কয়েক মাস পরেই তিনি বুঝতে পারলেন পাউলির কথা না শুনলেই ভালো হতো।
          ১৯৫৬ সালের শেষের দিকে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীরা পারমাণবিক কণার বাম-ডান সাম্যতা ভঙ্গের প্রমাণ পেলেন। তাঁরা চৌম্বক ক্ষেত্রে তেজষ্ক্রিয় নিউক্লিয়াস থেকে নির্গত বিটা কণা (ইলেকট্রন) পর্যবেক্ষণ করে দেখলেন যে সবগুলো বিটা কণা শুধুমাত্র নিউক্লিয়াসের একটি দিক থেকেই বের হচ্ছে। এরপর যখন চৌম্বক ক্ষেত্রের দিক পরিবর্তন করে দেয়া হলো - দেখা গেলো সবগুলো বিটা কণা এবার নিউক্লিয়াসের অন্যদিক থেকে বের হচ্ছে। খুবই সাধারণ মানের পরীক্ষণ থেকে অসাধারণ ফল পাওয়া গেলো। পারমাণবিক কণার প্যারিটি ভায়োলেশান প্রমাণিত হলো।
          ১৯৫৭ সালের ১৫ জানুয়ারি কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে এক সাংবাদিক সম্মেলন করে এই ফলাফল জানানো হলো। পরদিন নিউইয়র্ক টাইমস খুব গুরুত্ব দিয়ে এই সংবাদ প্রকাশ করলো। মুহূর্তেই সারা পৃথিবী জেনে গেলো এই সংবাদ। প্রফেসর পাউলি খুব লজ্জা পেলেন। ২৪শে জানুয়ারি তিনি সালামের কাছে ক্ষমা চেয়ে চিঠি লিখলেন, "আমাদের প্রিয় বন্ধু 'প্যারিটি' মারা গেছে।"
          এর কয়েকদিন পর ২৭শে জানুয়ারি ১৯৫৭ পাউলি প্রফেসর ভিসকফের কাছে লেখা এক চিঠিতে বলেন, "গত ২১ তারিখে আমি তিনটি পরীক্ষণ ও দুটো তত্ত্বীয় গবেষণাপত্র পাই। সবগুলোতেই প্যারিটি ভায়োলেশান সংক্রান্ত। অথচ এর ছয় থেকে আট সপ্তাহ আগে আমি সালামের কাছ থেকে এরকম একটা পেপার পেয়েছিলাম। আমি তখন এগুলোকে গুরুত্ব দিইনি। খুব বেঁচে গেছি যে আমি কোন বাজি ধরিনি। ধরলে আমি ফতুর হয়ে যেতাম। কিন্তু আমি যা বলেছি তার জন্য আমি সবার সামনে বোকা হয়েছি। এখন সবার অধিকার আছে আমাকে নিয়ে হাসাহাসি করার।"
          সালাম তাঁর প্যারিটি ভায়োলেশানের পেপারটা প্রকাশ করেছিলেন ইতালির নভো সিমেন্টোতে। কিন্তু তখন অনেক দেরি হয়ে গেছে। ১৯৫৭ সালে প্যারিটি ভায়োলেশান সংক্রান্ত গবেষণার জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান লি এবং ইয়াং। এই পুরষ্কারের দাবিদার আবদুস সালামও হতে পারতেন - একটুর জন্য তা হলো না।
          ১৯৫৬ সালের শেষে আবদুস সালাম লন্ডনের ইম্পেরিয়েল কলেজে ফলিত গণিতের প্রফেসর পদের অফার পেলেন। ১২৮৪ সালে প্রতিষ্ঠিত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যের কাছে ১৯০৭ সালে প্রতিষ্ঠিত ইম্পেরিয়েল কলেজ কিছুই নয়। এই কারিগরি কলেজটাকে কেমব্রিজের ছাত্র শিক্ষক সবাই 'কামারদের কলেজ' বলে বিদ্রুপ করে।
          বিশ্বজুড়ে শিল্পবিপ্লবের জন্য প্রয়োজনীয় প্রকৌশলী ও প্রযুক্তিক তৈরির জন্য এই কলেজ স্থাপিত হয়েছিল। ১৯৩২ সালে জর্জ থমসন ইম্পেরিয়েল কলেজের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। জর্জ ছিলেন ইলেকট্রনের আবিষ্কারক জেমস থমসনের ছেলে। ১৯৩৭ সালে জর্জ থমসন ইলেকট্রন ডিফ্রাকশান আবিষ্কার করে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান। সে হিসেবে ইম্পেরিয়েল কলেজের মর্যাদাও খুব একটা কম নয়। ১৯৫৩ সালে জর্জ থমসনের অবসরের পর অধ্যাপক প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট যোগ দেন এই কলেজে। প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট ১৯৪৮ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন।
          প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট ইম্পেরিয়েল কলেজের উন্নতি ও প্রসার ঘটাচ্ছেন। বড় বড় গবেষণাগার তৈরির পাশাপাশি উদীয়মান সম্ভাবনাময় প্রতিভাবান গবেষক বাছাই করে নিয়ে আসছেন ইম্পেরিয়েল কলেজে। তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে আবদুস সালামের প্রতিভা ও যোগ্যতার খবর পেয়েছেন প্যাট্রিক ব্ল্যাকেট।
          একদিন সকালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে নিজের অফিসে যখন কাজ করছেন আবদুস সালাম - দরজায় প্যাট্রিক ব্ল্যাকেটকে দেখে অবাক হয়ে গেলেন। ব্ল্যাকেট লন্ডন থেকে নিজেই চলে এসেছেন আবদুস সালামের কাছে। সালামকে সরাসরি প্রশ্ন করলেন, "আপনি কি একটা ডিপার্টমেন্টের চেয়ারম্যান হতে চান?"
          "কে চায় না বলুন? অবশ্যই চাই।"
          "তাহলে ইম্পেরিয়েল কলেজে আপনাকে স্বাগতম। আপনি আমাদের ফলিত গণিত বিভাগের দায়িত্ব নিন।"
          শুরুতে মনস্থির করতে পারছিলেন না আবদুস সালাম। কিন্তু যখন দেখলেন যে ইম্পেরিয়েল কলেজ দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, নতুন ফিজিক্স বিল্ডিং হলে ফলিত গণিত থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে বদলি হবার সুযোগ আছে, তিনি রাজি হয়ে গেলেন।
          ১৯৫৭ সালের জানুয়ারিতে ইম্পেরিয়েল কলেজের প্রফেসর ও ফলিত গণিত বিভাগের চেয়ারম্যান পদে যোগ দিলেন আবদুস সালাম। কেমব্রিজে তাঁর বেতন ছিল বছরে নয় শ' পাউন্ড, আর ইম্পেরিয়েল কলেজে তাঁর বেতন হলো বছরে তিন হাজার পাউন্ড। আবদুস সালাম হলেন প্রথম পাকিস্তানি এবং দ্বিতীয় এশিয়ান যিনি কোন ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভাগীয় চেয়ারম্যান হলেন। তাঁর আগে ১৯৩৬ সালে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ইস্টার্ন রিলিজিয়ন ও এথিক্স বিভাগের চেয়ারম্যান হয়েছিলেন সর্বপল্লী রাধাকৃষ্ণণ। (১৯৬২ সালে রাধাকৃষ্ণণ ভারতের রাষ্ট্রপতি  হয়েছিলেন)।
          লন্ডনে এসে ইম্পেরিয়েল কলেজের কাছে পুটনির ক্যাম্পিয়ন রোডে বাসা নিলেন আবদুস সালাম। এখান থেকে কলেজ কাছে, হিথ্রো বিমান বন্দর কাছে এবং সর্বোপরি সাউথফিল্ডের আহমদিয়া মসজিদ কাছে। তাঁর বাবার  সুবিধার জন্য মসজিদের কাছে বাসা নিয়েছেন আবদুস সালাম। তাঁর বাবা চোখের চিকিৎসার জন্য ইংল্যান্ডে এসেছিলেন। ১৯৫৭ সালের পুরোটাই তিনি ছিলেন আবদুস সালামের বাসায়। 
          সালামের স্ত্রী হাফিজা বেগম তাঁদের দুই মেয়েকে নিয়ে ১৯৫৬ সালের নভেম্বরে পাকিস্তানে চলে গিয়েছিলেন। সেখানে ডিসেম্বরে তাঁদের তৃতীয় কন্যা বুশরার জন্ম হয়। তিন মেয়েকে নিয়ে হাফিজা বেগম লন্ডনে আসেন ১৯৫৮ সালে।
          ইম্পেরিয়েল কলেজের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান গ্রুপ আস্তে আস্তে সমৃদ্ধ হতে শুরু করেছে। সালামের শিক্ষক, বন্ধু ও সহকর্মী পল ম্যাথিউজ বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটি থেকে চলে এসেছেন ইম্পেরিয়েল কলেজে। পাকিস্তানি ছাত্র রিয়াজুদ্দিন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে পিএইচডি শুরু করেছিলেন প্রফেসর সালামের তত্ত্বাবধানে। সালামের সাথে রিয়াজুদ্দিনও চলে এসেছেন ইম্পেরিয়েল কলেজে। সেখান থেকেই তিনি ১৯৫৯ সালে পিএইচডি সম্পন্ন করেন।
          ইম্পেরিয়েল কলেজে যোগ দেয়ার কয়েক বছরের মধ্যেই আবদুস সালাম গবেষণায় ব্যাপক সাফল্য পেতে আরম্ভ করেন। ১৯৫৮ সালে তাঁর রি-নরমালাইজেশান সংক্রান্ত গবেষণার জন্য তিনি কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের জন হপকিন্স প্রাইজ ও অ্যাডাম্‌স প্রাইজ পান। ১৯৫৯ সালে মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পান। আবদুস সালাম ছিলেন সেই সময়ের রয়েল সোসাইটির সবচেয়ে কম বয়সী ফেলো।
          ১৯৬০ সালে আবদুস সালাম ইম্পেরিয়েল কলেজের ফলিত গণিত বিভাগ থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে যোগ দেন। সেখানে আবদুস সালামের জন্য তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের বিশেষ 'চেয়ার' প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। সেখানে তিনি গড়ে তোলেন খুবই ফলপ্রসূ রিসার্চ গ্রুপ।
          আবদুস সালাম তাঁর অধ্যাপনা ও গবেষণা জীবনের শেষ পর্যন্ত ইম্পেরিয়েল কলেজের সাথেই ছিলেন। কণা-পদার্থবিজ্ঞানের (particle physics) বিভিন্ন মৌলিক অংশে আবদুস সালাম তাঁর প্রতিভার কালজয়ী স্বাক্ষর রেখেছেন প্রায় পঞ্চাশ বছরের নিরলস গবেষণার মাধ্যমে। তাঁর গবেষণার স্বীকৃতিও তিনি পেয়েছেন। ১৯৬১ সালে পেয়েছেন ফিজিক্যাল সোসাইটি অব লন্ডনের ম্যাক্সওয়েল পুরষ্কার। ১৯৬৪ সালে পেয়েছেন রয়েল সোসাইটি অব লন্ডনের হিউজ পুরষ্কার।
          রি-নরমালাইজেশানের পর আবদুস সালামের আরেকটি উল্লেখযোগ্য অবদান হলো মৌলিক কণাগুলোর শ্রেণীকরণের জন্য গণিতের গ্রুপ থিওরির ব্যবহার। ১৯৬০ সালে জাপানের কয়েকজন বিজ্ঞানী সর্বপ্রথম প্রস্তাব করেছিলেন যে পরিচিত মৌলিক কণাগুলো (ইলেকট্রন, প্রোটন ও নিউট্রন) আরো তিনটি মৌলিকতর কণা দিয়ে তৈরি, পরে যাদের নাম দেয়া হয়েছে কোয়ার্ক। আবদুস সালামই প্রথম অ-জাপানী বিজ্ঞানী যিনি এই ধারণা গ্রহণ করেছিলেন। বস্তুকণার কোয়ার্ক-তত্ত্ব এখন প্রতিষ্ঠিত।
          আবদুস সালামের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান অবশ্যই ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোর্স ও দুর্বল নিউক্লিয়ার ফোর্সের একত্রীকরণ তত্ত্ব। যার জন্য ১৯৭৯ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি। আবদুস সালাম হলেন প্রথম মুসলমান নোবেল বিজয়ী বিজ্ঞানী। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

অলিভিয়া নিউটন-জন

  কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস কর...

Popular Posts