Sunday 22 March 2020

পদার্থবিজ্ঞানী আবদুস সালাম - পর্ব ২




উচ্চশিক্ষা: কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি

ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির প্রক্রিয়া শুরু করলেন আবদুস সালাম। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ সবেমাত্র শেষ হয়েছে। ব্রিটেনে নতুন লেবার সরকার এসে সিদ্ধান্ত নিচ্ছে যে ইন্ডিয়া থেকে তারা প্রশাসন গুটিয়ে নিয়ে ভারতকে স্বাধীনতা দিয়ে দেবে। এ অবস্থায় হাই-কমিশনে সাংঘাতিক কাজের ভীড়।
            আবদুস সালামের কেমব্রিজে ভর্তির দরখাস্তে সুপারিশ করেছেন প্রফেসর চাওলা ও ডক্টর আবদুল হামিদ। মেধানুসারে তাঁর বৃত্তি পেতে কোন বাধা নেই। কিন্তু কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির কলেজগুলোতে কতজন ভারতীয় ছাত্র নেয়া হবে তার একটা কোটা আছে- যা ইতোমধ্যেই পূর্ণ হয়ে গেছে। তাই আবদুস সালামকে ভর্তির জন্য আরো এক বছর অপেক্ষা করতে হবে।
            কিন্তু হঠাৎ জানা গেলো সেন্ট জোন্স কলেজে ইংরেজি সাহিত্যে ডক্টরেট করার জন্য নির্বাচিত একজন ভারতীয় ছাত্র অনিবার্য কারণে যেতে পারছেন না। এই খালি সিটে যাওয়ার জন্য চেষ্টা করলেন আবদুস সালাম। কিন্তু সেন্ট জোন্স কলেজ সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেই বছর তারা পোস্ট-গ্র্যাজুয়েটের বদলে আন্ডার-গ্র্যাজুয়েট ছাত্র নেবে।
            আবদুস সালাম ইতোমধ্যেই বি-এ অনার্স ও এম-এ পাস করে ফেলেছেন। কেমব্রিজে গিয়ে আবার বি-এ ক্লাসে ভর্তি হবেন? তাঁর বাবা এখনো আশা ছাড়েননি যে ছেলে আই-সি-এস অফিসার হবে। অনেকের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে তিনি সিদ্ধান্ত দিলেন যে আবদুস সালাম কেমব্রিজে গিয়ে আবার বি-এ পড়ুক। আই-সি-এস পরীক্ষার ঘোষণা দিলে ওখান থেকেই পরীক্ষায় বসতে সুবিধে হবে। আই-সি-এস এর বয়স সীমা ২৫, আবদুস সালামের বয়স তখনো ২০।
            বিজ্ঞানের গবেষণার প্রতি তখনো কোন আগ্রহ জন্মায়নি আবদুস সালামের। ১৯৪৬ সালের ০৩ সেপ্টেম্বর কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটিতে ভর্তির কনফার্মেশান টেলিগ্রাম এসে পৌঁছালো আবদুস সালামের হাতে। এবার বৃত্তি কনফার্ম করতে হবে।
            সেই রাতেই ট্রেনে মুলতান থেকে লাহোরে চলে গেলেন আবদুস সালাম। পরের দিন সকালে স্টেশন থেকে ছুটতে ছুটতে পাঞ্জাব শিক্ষা অধিদপ্তরে গিয়ে শোনেন যে অত্যধিক গরমের কারণে শিক্ষা অফিস সরিয়ে নেয়া হয়েছে আড়াইশ কিলোমিটার দূরে সিমলায়। আবার ছুটে গিয়ে সিমলাগামী ট্রেন ধরলেন সালাম।
            সিমলায় পৌঁছতে পৌঁছতে দুপুর দুটো। গিয়ে দেখলেন তাঁর জন্য একটা সুখবর অপেক্ষা করছে। আরো চারজন পাঞ্জাবি ছেলের সাথে তাঁকেও উচ্চশিক্ষা বৃত্তি দেয়া হয়েছে। বছরে ৩৬৫ ব্রিটিশ পাউন্ড হিসেবে তিন বছর। বৃত্তির শর্ত এই যে ব্রিটিশ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি নিশ্চিত করতে হবে। আবদুস সালামের ভর্তির টেলিগ্রাম পকেটেই ছিল।
            এটাকেই আবদুস সালাম পরবর্তীতে দৈবঘটন হিসেবে উল্লেখ করেছেন। কারণ বৃত্তিপ্রাপ্ত বাকি চারজনকে পরের বছরে ভর্তির জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে। কিন্তু পরের বছর (১৯৪৭) ভারত আর পাকিস্তান স্বাধীন হয়ে গেলো। বৃত্তির টাকা অন্যান্য খাতে অবলুপ্ত হয়ে গেল। বাকি চারজনের আর বিদেশ যাওয়া হয়নি। 
            কেমব্রিজে ভর্তি ও স্কলারশিপ নিশ্চিত হলো। পরের মাস থেকেই ক্লাস শুরু। জাহাজে চেপে ব্রিটেনে পৌঁছাতে লেগে যাবে কয়েক সপ্তাহ। হাতে একদম সময় নেই।
            ভারত থেকে সব ব্রিটিশ সৈন্য আর কর্মকর্তারা দেশে ফিরতে শুরু করেছেন। লাহোর থেকে জানা গেছে জাহাজের কোন টিকেট নেই, ডিসেম্বরের আগে টিকেট পাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
            আবদুস সালাম চলে গেলেন দিল্লি। শনিবারের বিকেলে গিয়ে পৌঁছলেন শিপিং কোম্পানির অফিসে। অফিস ততক্ষণে বন্ধ হয়ে গেছে। অফিসের পিয়ন কাম কেরানিকে কিছু টাকা-পয়সা দিয়ে একটা অপেক্ষমান টিকেট সংগ্রহ করলেন আবদুস সালাম। তারপর রাতের ট্রেনেই ফিরে গেলেন মুলতান।
            তখন ভারত জুড়ে অস্থিরতা। হিন্দু-মুসলিম দাঙ্গা শুরু হয়ে গেছে। আবদুস সালাম যখন মুলতানে পৌঁছলেন তখন তাঁর বাবা অপেক্ষা করছিলেন ট্রেন স্টেশনে। দাঙ্গার কারণে সান্ধ্যকালীন কারফিউ জারি করা হয়েছে। মোহাম্মদ হোসেইন ম্যাজিস্ট্রেটের কাছ থেকে বিশেষ অনুমতি নিয়ে স্টেশনে এসেছেন। এই উত্তাল সময়ে তিনি মনে-প্রাণে কামনা করছেন তাঁর ছেলে যেন ভালোয় ভালোয় কেমব্রিজে গিয়ে পৌঁছতে পারে।
            একদিকে ইংরেজ তাড়ানোর যুদ্ধ, আবার অন্যদিকে ইংরেজদের দেশে যাবার প্রাণপন চেষ্টা। পরের কয়েকদিন জিনিসপত্র গোছানো চললো। স্থানীয় বড়লোক মালিক উমর আলির ছেলেদের কিছুদিন প্রাইভেট পড়িয়েছিলেন আবদুস সালাম। তিনি আবদুস সালামের বিদেশ যাবার ভ্রমণ-খরচ দিলেন কিছু।
            ১৯৪৬ এর সেপ্টেম্বরের সাত তারিখ সকালে চল্লিশ কেজি ওজনের একটি ট্রাংক সাথে নিয়ে বোম্বেগামী ট্রেনে উঠে বসলেন আবদুস সালাম। মুলতান থেকে এক হাজার কিলোমিটার দূরে বোম্বাই। সেখান থেকে লিভারপুলগামী জাহাজে উঠবেন যেদিন সিট পাওয়া যায়।
            দুদিন পর যখন বোম্বে পৌঁছলেন তখন শহরজুড়ে কারফিউ চলছে। স্টেশনের কাছে একটি সস্তা হোটেলে গিয়ে উঠলেন আবদুস সালাম। পরের দিন সকালে বোম্বে ডকে গিয়ে দেখলেন ব্রিটিশ সৈন্যে গিজগিজ করছে ডক। সবাই বসতি গুটিয়ে ফিরে যাচ্ছে ব্রিটেনে। একেক জনের দশ-বারোটা করে স্যুটকেস, সাথে অন্যান্য জিনিস তো আছেই। এসব ডিঙিয়ে জাহাজে  উঠা সহজ কাজ নয়।
            ভারী সুটকেস সামলাতে সামলাতে প্রায় বিধ্বস্ত হয়ে জাহাজে উঠলেন আবদুস সালাম। আরেকজন ভারতীয়ের সাথে শেয়ারে একটা বার্থ পাওয়া গেল। ছয়শ ব্রিটিশ সৈনিক পরিবার, ছয়শ ইতালিয়ান যারা বিশ্বযুদ্ধের সময় ব্রিটিশদের হাতে বন্দী হয়েছিলেন- এখন বন্দী-বিনিময়ের আওতায় মুক্ত, আর সাথে আবদুস সালামের মত কিছু সাধারণ নাগরিককে নিয়ে বোম্বে ডক থেকে ব্রিটেনের উদ্দেশ্যে রওনা দিলো ব্রিটিশ জাহাজ ফ্রাংকোনিয়া। 
            বিশ বছরের তরুণ আবদুস সালাম একুশ দিনের জাহাজ-যাত্রার পুরোটাই বেশ উপভোগ করলেন। অ্যাডেন বন্দরে জাহাজ ভিড়লে একটা হাতঘড়ি কিনলেন- তাঁর জীবনের প্রথম হাতঘড়ি।
            সুয়েজ খাল অতিক্রম করে জাহাজ ভিড়লো ইতালির নেপল্‌স-এ। আবদুস সালাম পা রাখলেন ইতালির মাটিতে। সেদিন কারও ধারণা ছিল না যে একদিন এই ইতালিতেই তিনি গড়ে তুলবেন আন্তর্জাতিক তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র।
            অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে লিভারপুলে পৌঁছলো ফ্রাংকোনিয়া। এরকম শীত আগে কখনো দেখেননি আবদুস সালাম। জাহাজ থেকে নেমে কী করবেন বুঝতে পারছিলেন না তিনি। ভারত তখনো ব্রিটিশের অধীন। সামর্থ্য থাকলে ভারতীয়রা ব্রিটেনের যে কোন জায়গায় যেতে পারেন। লিভারপুল ডকেও কিছু কিছু ভারতীয় দেখা যাচ্ছে। আবদুস সালামের সাথে দেখা হয়ে গেলো একজন বিশিষ্ট ভারতীয় ব্যক্তির সাথে।       
            স্যার মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান আহমদিয়া সম্প্রদায়ের বড় নেতা, সুপ্রিম কোর্টের বিচারক। আমেরিকা থেকে দেশে ফেরার পথে ব্রিটেনে কিছুদিনের  যাত্রাবিরতি করছিলেন জাফরুল্লাহ খান। সেদিন লিভারপুল ডকে এসেছিলেন তাঁর এক ভাইপোকে নিতে। তিনি দেখলেন বিশাল এক ট্রাংক সাথে নিয়ে প্রচন্ড ঠান্ডায় হু হু করে কাঁপছে একজন ভারতীয় তরুণ। তিনি এগিয়ে গিয়ে নিজের ভারী ওভারকোটটা খুলে জড়িয়ে দিলেন তরুণ আবদুস সালামের গায়ে।
            আবদুস সালামের পরিচয় পেয়ে আর কেমব্রিজে পড়তে এসেছেন শুনে তাঁকে সাথে করে লন্ডনে নিয়ে এলেন জাফরুল্লাহ খান। রাতে থাকার ব্যবস্থা করে দিলেন সাউথফিল্ডের আহমদিয়া মসজিদে।


স্যার মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান

আবদুস সালামের পরিবারের আহমদিয়া হবার ইতিহাস খুব সাধারণ। আবদুস সালামের জ্যাঠা চৌধুরি গোলাম হোসেইন সর্বপ্রথম আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অনুসারী হন। পরে ১৯১৪ সালে আবদুস সালামের বাবা চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন যখন লাহোরের ইসলামিয়া কলেজে পড়তেন- তখন ক্লাসের বন্ধুরা তাঁকে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে আন্দোলনে অংশ নেয়ার জন্য বলেন। নিজের বড় ভাই আহমদিয়া হলেও মোহাম্মদ হোসেইন তখনো আহমদিয়াদের অনুসারী হননি। তাই বলে ব্যক্তিগতভাবে আহমদিয়াদের বিরুদ্ধে কোন মতামতও তাঁর ছিল না।
            কিন্তু একটা আন্দোলন হচ্ছে দেখে তাঁর কৌতূহল হলো আহমদিয়াদের সম্পর্কে জানার। নিজের চোখে সব দেখার জন্য তিনি চলে গেলেন কাদিয়ান- যেখান থেকে আহমদিয়া সম্প্রদায়ের উৎপত্তি। তিনি যখন কাদিয়ানে পৌঁছলেন তখন মসজিদে ধর্ম-বক্তৃতা দিচ্ছিলেন আহমদিয়াদের খলিফা মির্জা নুরুদ্দিন। আহমদিয়াদের নিজের মনের শয়তানের বিরুদ্ধে মানসিক জিহাদ-ই আসল জিহাদ জাতীয় আদর্শে মুগ্ধ হয়ে আহমদিয়াদের অনুসারী হয়ে গেলেন চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইন। চৌধুরি মোহাম্মদ হোসেইনের ছেলে হিসেবে উত্তরাধিকারসূত্রেই আহমদিয়া সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত।
            পরদিন সকালে ট্রেন ধরে কেমব্রিজ চলে গেলেন আবদুস সালাম। স্টেশন থেকে ট্যাক্সিতে সোজা সেন্ট জোন্স কলেজ। ভারী ট্রাংকটি নামিয়ে দিয়ে ট্যাক্সিড্রাইভার চলে গেলো। আবদুস সালাম এদিক ওদিক তাকালেন যদি কোন কুলি পান। কলেজের একজন গার্ডকে দেখে সাহায্য করার জন্য বললে গার্ড আঙুল তুলে একটা ট্রলি দেখিয়ে দিলেন। সাংস্কৃতিক ধাক্কা শুরু হলো আবদুস সালামের। ভারতে পয়সা দিলেই কুলি পাওয়া যায়। আর ব্রিটেনে কোন কুলি নেই- নিজের বোঝা নিজেই সামলাও। মিশ্র অনুভূতি নিয়ে সেন্ট জোন্স কলেজের হোস্টেলে ঢুকলেন আবদুস সালাম।
            এই সেই পৃথিবীবিখ্যাত কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। যেখানে রয়েছেন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অন্যতম স্থপতি পল ডিরাক, তত্ত্বীয় পদার্থবিদ হার্মান বন্ডি। এখানকার বিখ্যাত ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবে কাজ করেছেন প্রথম বাঙালি পদার্থবিজ্ঞানী জগদীশ বসু। আবদুস সালামের মন ভরে গেলো এখানে এসে। সেন্ট জোন্স কলেজের ফুলের বাগানের সৌন্দর্যে তিনি মুগ্ধ।
            কেমব্রিজে আবদুস সালাম গণিত ট্রাইপস শেষ করেন প্রথম দুই বছরে। গণিতের সাথে পদার্থবিজ্ঞানও। উভয় পরীক্ষায় প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান অধিকার করেন তিনি। গণিতে প্রথম শ্রেণি অর্জন করার জন্য তিনি হলেন র‍্যাংগলার।
            তিন বছরের স্কলারশিপ পেয়েছিলেন আবদুস সালাম। শেষের বছর গণিতের থার্ড পার্ট শেষ করবেন, নাকি পদার্থবিজ্ঞানের থার্ড পার্ট শেষ করবেন তা নিয়ে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়লেন তিনি।
সেন্ট জোন্স কলেজে আবদুস সালামের টিউটর ছিলেন বিশিষ্ট জ্যোতির্পদার্থবিদ ফ্রেড হয়েল। সালাম প্রফেসর হয়েলের পরামর্শ চাইলেন। হয়েল বললেন, "তুমি যদি পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাও, এমনকি তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী হতে চাইলেও, ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবের এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স কোর্স তোমার অবশ্যই করা উচিত। নইলে তুমি কোন এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিসিস্টের চোখের দিকে তাকিয়ে কথাও বলতে পারবে না।"

            ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে এক্সপেরিমেন্টাল কোর্স শুরু করলেন আবদুস সালাম। সেই সময় ক্যাভেন্ডিস ল্যাব পৃথিবীবিখ্যাত। এখানেই রাদারফোর্ড পরমাণুর গঠন আবিষ্কার করেছেন। ল্যাবরেটরি যতই সমৃদ্ধ হোক, পরীক্ষকের যদি ধৈর্য না থাকে - তাহলে কোন পরীক্ষণেই সাফল্য লাভ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এই প্রয়োজনীয় ধৈর্যের ছিটেফোঁটাও ছিল না সালামের।
            প্রথম এক্সপেরিমেন্ট দেয়া হলো সোডিয়াম স্পেকট্রামের সবচেয়ে প্রধান দুটো ডি লাইনের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের পার্থক্য বের করা। তিনদিন ধরে কাজ করে পরীক্ষণের যন্ত্রপাতি ঠিক করলেন আবদুস সালাম। এবার ডাটা সংগ্রহের পালা। সালাম তাঁর ফলাফলের জন্য একটা শর্টকাট পদ্ধতি ঠিক করে ফেললেন। গাণিতিক হিসেব করে গ্রাফ পেপারের ওপর একটা সরলরেখা টানতে পারলে তার ছেদবিন্দু থেকেই পাওয়া যাবে কাঙ্খিত ফলাফল। গাণিতিক হিসেবে যে কোন সরলরেখার জন্য শুধু দুটো বিন্দু হলেই চলে। কিন্তু এই দুটো বিন্দুর কোন একটা যদি ভুল হয়, তাহলে পুরো রেখাটিই বদলে যাবে এবং ঐ রেখা থেকে নেয়া সমস্ত মানই ভুল হবে। সেক্ষেত্রে তৃতীয় আরেকটি বিন্দু দরকার। এখন তিনটি বিন্দুই যদি একই সরলরেখায় থাকে তাহলে বুঝতে হবে রেখাটি সঠিক।
            আবদুস সালাম তাঁর পরীক্ষণ থেকে তিনটি মান নির্ণয় করে গ্রাফের ওপর বসিয়ে সরলরেখা পেয়ে গেলেন। যে এক্সপেরিমেন্ট করতে অন্যদের দুই সপ্তাহ লেগে যায় - সেখানে চারদিনেই এক্সপেরিমেন্ট শেষ করে ফলাফল পেয়ে গেলেন আবদুস সালাম। যন্ত্রপাতি খুলে সব গুছিয়ে রেখে এক্সপেরিমেন্টের রিপোর্ট দেখাতে নিয়ে গেলেন ল্যাব সুপারভাইজার ডক্টর ডেনিস উইলকিনসন্সকে। তখনকার তরুণ ঊইলকিনসন্স ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের প্রদর্শক ছিলেন। পরবর্তীতে স্যার ডেনিস উইলকিনসন্স ইংল্যান্ডের নামকরা পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে পরিচিত হন। সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর হয়েছিলেন উইলকিনসন্স।
            উইলকিনসন্সের হাতে প্র্যাকটিক্যালের মার্কস। তিনি সালামের ল্যাববুক দেখে বেশ মজা পেলেন। সালামকে জিজ্ঞেস করলেন, "তোমার ব্যাকগ্রাউন্ড কী?"
            "গণিত"
            "আমি ঠিকই বুঝেছি। শুধু গাণিতিক নিয়ম খাটালে তো হবে না। এই এক্সপেরিমেন্টটার জন্য তোমাকে কমপক্ষে এক হাজারটা রিডিং নিতে হবে, সেখানে তুমি নিয়েছো মাত্র তিনটি। তুমি তো শূন্য পাবারও উপযুক্ত নও।"
            খুবই দমে গেলেন আবদুস সালাম। বুঝতে পারছিলেন পরীক্ষামূলক পদার্থবিজ্ঞান তাঁর জন্য নয়। ল্যাবে তাঁর কোন এক্সপেরিমেন্টই ঠিকমতো হচ্ছে না। তিনি চান একরকম, তাঁর যন্ত্রপাতি চলে অন্যরকম ভাবে। তাঁর স্কলারশিপ আছে আর মাত্র এক বছরের। এর মধ্যেই তাঁকে ফিজিক্সের থার্ড পার্ট শেষ করতে হবে। কিন্তু কীভাবে?
            সেন্ট জোন্‌স কলেজের অ্যাডভাইজার ড. জে এম ওয়ার্ডি'র কাছে এ ব্যাপারে পরামর্শ চাইলেন আবদুস সালাম।
            "তুমি এক বছরের মধ্যে শেষ করতে চাইছো এই কোর্স? তাও প্রথম শ্রেণির আশা করছো?"
            "হ্যাঁ। প্রথম শ্রেণির কমে কীভাবে আশা করি?"
            "থমসন বা মটও যা পারেননি তুমি তা করতে চাইছো?"
            চিন্তায় পড়ে গেলেন আবদুস সালাম। বিখ্যাত পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানী থমসন যা পারেননি তিনি তা কীভাবে পারবেন? এক্সপেরিমেন্ট যে তাঁর আসেই না। প্র্যাকটিক্যালের নম্বর ছাড়াই তাঁকে প্রথম শ্রেণি পেতে হবে।
            এক বছর পরে সালাম কেমব্রিজের ইতিহাসে আগে যা কোনদিনই ঘটেনি - তা ঘটিয়ে ফেললেন। প্র্যাকটিক্যালে খুবই কম নম্বর পেয়েও তত্ত্বীয়তে এত বেশি নম্বর পেলেন যে তিনি প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়ে গেলেন।
            সালামের স্কলারশিপের মেয়াদ বেড়ে গেলো। এবার বিশুদ্ধ গবেষণার সুযোগ। কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিশ ল্যাবের রীতি হলো প্রথম শ্রেণির স্নাতকেরা সবসময় এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সে গবেষণা করে। আর যারা ফার্স্ট ক্লাস পায় না - তারাই তত্ত্বীয় গবেষণার দিকে যায়। এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্সের গবেষকদের তালিকার শুরুতেই আবদুস সালামের নাম লেখা হলো।
            আবদুস সালামকে বলা হলো ড. স্যামুয়েল ডেভনের অধীনে পিএইচডি করার জন্য। তাঁর এক্সপেরিমেন্টাল প্রজেক্টের কাজ হলো ডিউটেরন আর হাইড্রোজেনের সংঘর্ষ ঘটিয়ে কী হয় তার ফলাফল নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করা।
            ফাঁপরে পড়লেন আবদুস সালাম। তিনি তো পরীক্ষণ পদার্থবিজ্ঞানের কিছুই পারেন না। কোন আগ্রহও নেই তার সেদিকে। কী করবেন বুঝতে না পেরে কিছুদিন ছুটি নেয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন।
            বাড়ি থেকে এসেছেন প্রায় তিন বছর হয়ে গেলো। ১৯৪৬ সালের সেপ্টেম্বরে এসেছিলেন। এখন ১৯৪৯-এর জুলাই। ইতোমধ্যে অনেক কিছুই বদলে গেছে ভারতবর্ষে। ১৯৪৭ সালের আগস্ট মাসে ব্রিটিশ সরকার ইন্ডিয়া ছেড়ে চলে যেতে বাধ্য হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটো স্বাধীন দেশের জন্ম হয়েছে। যে অখন্ড পাঞ্জাব থেকে ইংল্যান্ডে এসেছিলেন আবদুস সালাম, সেই পাঞ্জাব দু'ভাগ হয়ে গেছে। আবদুস সালামরা এখন পাকিস্তানি। দেশের স্বাধীনতা লাভের জন্য কিছু না করলেও নতুন দেশ গড়ার কাজে নিজেকে নিয়োজিত করতে ইচ্ছে করছে আবদুস সালামের।
            ১৯৪৯ সালে প্রথম বারের মত স্বাধীন পাকিস্তানের মুলতানে নিজেদের বাড়িতে ফিরলেন আবদুস সালাম। সেখানে একটা আনন্দের আয়োজন অপেক্ষা করছিল আবদুস সালামের জন্য। তাঁর জ্যেঠা চৌধুরি গোলাম হোসেইনের দ্বিতীয় কন্যা আমতুল হাফিজা বেগমের সাথে আবদুস সালামের বিয়ে ঠিক করে ফেলেছেন তাদের বাবা-মা। ১৯৪৯ সালের ১৯শে আগস্ট বেশ ধুম ধাম করে বিয়ে হলো আবদুস সালাম ও হাফিজা বেগমের। আবদুস সালামের বয়স তখন ২৩ আর হাফিজা বেগম ১৬।
            সদ্য স্বাধীন পাকিস্তানে প্রথম শ্রেণির কেমব্রিজ ডিগ্রি নিয়ে ফেরা আবদুস সালাম চাইলেই যে কোন সরকারি চাকরিতে ঢুকতে পারেন। কিন্তু তাঁর মাথায় ঢুকে গেছে কেমব্রিজে পদার্থবিজ্ঞানের গবেষণা চালিয়ে যাবার স্বপ্ন। তিনি চেষ্টা করলেন যদি তাঁর শিক্ষাবৃত্তিটার মেয়াদ আরো কয়েক বছর বাড়ানো যায়। বৃত্তি আর সেন্ট জোন্সের স্টুডেন্টশিপ নিয়ে বেশ আরামেই চলে যাবে তাঁর।
            সালামের বৃত্তির মেয়াদ বাড়লো আরো দুবছর। কিন্তু হিসেব করে দেখা গেলো বৃত্তির টাকায় স্ত্রীকে সাথে নিয়ে কেমব্রিজে থাকা সম্ভব নয়। ছয় সপ্তাহ পর আবদুস সালাম ফিরে এলেন কেমব্রিজে একা। তাঁর স্ত্রী রয়ে গেলেন মা-বাবার সাথে মুলতানে।
            কেমব্রিজে ফিরে এসে গবেষণার প্রস্তুতি নিতে শুরু করলেন আবদুস সালাম। এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স ছেড়ে থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে যেতে হবে। ড. স্যামুয়েলকে জিজ্ঞেস করলেন, "এক্সপেরিমেন্টাল ফিজিক্স আমার ভালো লাগে না। আমি কি থিওরেটিক্যাল ফিজিক্সে কাজ করতে পারি?"
            প্রফেসর স্যামুয়েল অবাক হয়ে গেলেন সালামের কথা শুনে। ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে এক্সপেরিমেন্ট করার সুযোগ পেলে খুশি হয়ে যায় সবাই, আর সালাম কিনা এই সুযোগ ছেড়ে যেতে চাচ্ছে থিওরি গ্রুপে? তিনি সালামকে বললেন, "তুমি চাইলে অবশ্যই কাজ করতে পারো থিওরিতে। কিন্তু তোমাকে তো একজন সুপারভাইজার খুঁজে বের করতে হবে। দেখো থিওরির কাউকে রাজি করাতে পারো কিনা।"
            সেই সময় - অর্থাৎ ১৯৪৯ সালে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে বেশ কিছু আকর্ষণীয় গবেষণা চলছিলো। নিকোলাস কেমার তখন সবল ও দুর্বল পারমাণবিক বলের পারস্পরিক ক্রিয়ায় পায়নের ভূমিকা আবিষ্কার করে খ্যাতি লাভ করেছেন। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স তখন শক্ত ভিত্তির ওপর দাঁড়াতে শুরু করেছে। পায়নের আবিষ্কার এবং কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের রি-নর্মালাইজেশানের পর তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রধান জিজ্ঞাস্য - ইউকাওয়ার মেসন তত্ত্বের রি-নর্মালাইজেশান সম্ভব কিনা। আবদুস সালাম রি-নর্মালাইজেশানের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে গেলেন নিকোলাস কেমারের কাছে।
            ইতোমধ্যে ডিপার্টমেন্ট থেকেও প্রফেসর কেমারকে অনুরোধ করা হয়েছে আবদুস সালামকে সুপারভাইজ করার জন্য।
            "প্রফেসর কেমার, আপনাকে অবশ্যই আরেক জন নতুন ছাত্র নিতে হবে।"
            "অসম্ভব। আমার সময় নেই। আট জন পিএইচডি স্টুডেন্ট নিয়ে আমি হিমশিম খাচ্ছি। পল ম্যাথিউজের মত স্টুডেন্ট হলে সুপারভাইজ করা সহজ। কিন্তু  সবাই তো আর পল ম্যাথিউজের মত ব্রিলিয়েন্ট হবে না।"
            "এই ছেলেটা কিন্তু আগের সবার চেয়ে ব্রিলিয়েন্ট। ম্যাথ্‌স ফিজিক্স দুটোতেই ফার্স্ট হয়েছে। রেকর্ড মার্কস।"
            "কোন্‌ ছেলেটা?"
            "পাকিস্তানি ছেলেটা।"
            আবদুস সালামের কথা শুনেছিলেন নিকোলাস কেমার। কিন্তু কোর্সওয়ার্কে ভালো করা আর রিসার্চে ভালো করা তো এক কথা নয়। প্রফেসর কেমারের সন্দেহ গেলো না।
            আবদুস সালাম দেখা করলেন প্রফেসর কেমারের সাথে। কেমার বললেন, "আমি তো আসলে অনেক ব্যস্ত। তুমি বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটির প্রফেসর রুডলফ পিয়েরেল্‌সকে গিয়ে ধরো। দেখো তিনি তোমাকে সুপারভাইজ করতে রাজি হন কিনা।"
            প্রফেসর রুডল্‌ফ বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী। ফ্রেড হয়েলের সুপারভাইজার ছিলেন তিনি। কিন্তু আবদুস সালাম কেমব্রিজ ছেড়ে আর কোথাও যেতে রাজি নন। তিন বছর ধরে তিনি ইংল্যান্ডে আছেন, তবুও বড় শহরে তাঁর ভালো লাগে না। কেমব্রিজ ছোট নিরিবিলি শহর। তা ছাড়া কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষা ও গবেষণার যে পরিবেশ তা তিনি আর কোথাও পাবেন বলে বিশ্বাস করেন না। তাঁর এত ভালো রেজাল্ট, স্কলারশিপ আছে - অথচ প্রফেসর কেমার তাঁকে নিতে চাচ্ছেন না। মনে মনে বেশ রাগ হলেও আবদুস সালাম কেমারকে অনুরোধ করলেন তাঁকে ফিরিয়ে না দেয়ার জন্য।
            কেমার নিমরাজি হয়ে বললেন, "দেখো, কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের সব সমস্যার সমাধান তো করে ফেলেছেন ফাইনম্যান, সুইংগার, টোমোনাগা আর ফ্রিম্যান ডাইসন। তাছাড়া মেসন সংক্রান্ত সমস্যার সমাধান করতে শুরু করেছে আমার ছাত্র পল ম্যাথিউজ। তুমি পলের কাছে গিয়ে দেখতে পারো তোমার জন্য কোন কিছু অবশিষ্ট আছে কিনা।"
            সালাম গেলেন পল ম্যাথিউজের কাছে। ম্যাথিউজের পিএইচডি তখনো শেষ হয়নি। তিনি কাজ করছিলেন মেসন থিওরির ওপর।  ম্যাথিউজ বললেন, "দেখো সালাম, আমি গত আড়াই বছর ধরে কাজ করছি মেসনের রি-নরমালাইজেশান নিয়ে। এই আড়াই বছরে শুধুমাত্র স্পিন-জিরো মেসনের রি-নরমালাইজেশান করতে পেরেছি। আর তাই এখন লিখছি আমার থিসিসে। মেসনের রি-নরমালাইজেশানের একটা জেনারেল সলিউশান বের করতে হলে তুমি ফ্রিম্যান ডাইসনের পেপারগুলো পড়ে দেখতে পারো যদি কোন ক্লু পাও।"
            ফ্রিম্যান ডাইসনের পেপারগুলো পড়তে শুরু করলেন আবদুস সালাম। ১৯৪৭ সালে ফাইনম্যান, সুইঙ্গার ও ফ্রিম্যান ডাইসন ইলেক্ট্রোডায়নামিক্সে রি-নরমালাইজেশান সমস্যার সমাধান করেছেন। পল ম্যাথিউজ মেসনের রি-নরমালাইজেশান করার সময় একবারে একটা করে মেসনের সাথে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক ফোটনের ইন্টারঅ্যাকশান (মিথষ্ক্রিয়া) বিবেচনা করেছেন।
            পল ম্যাথিউজ সালামকে বললেন, "দেখো তুমি যদি একসাথে অনেকগুলো মেসনের ইন্টার-অ্যাকশান বিবেচনা করে সমীকরণ দাঁড় করাতে পারো।"
            সালাম ফ্রিম্যান ডাইসনের পেপার অনুসরণ করে নিজের মতো কিছু সমাধান করে ম্যাথিউজকে দেখালেন। কিন্তু খুব একটা সন্তুষ্ট হলেন না পল ম্যাথিউজ। কারণ সালাম অনেকগুলো প্যারামিটার ফিট করেছেন ঠিকই, কিন্তু একটা সার্বিক সমীকরণ দাঁড় করাতে পারেননি।
            ১৯৫০ সালের এপ্রিলে ম্যাথিউজ পিএইচডি'র ভাইভা শেষ করলেন। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ভাইভা নিলেন ফ্রিম্যান ডাইসন। পল ম্যাথিউজ প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটির ইনস্টিটিউট ফর অ্যাডভান্স স্টাডিজে ফেলোশিপ পেয়েছেন। ব্রিটেন ছেড়ে আমেরিকায় যাবার আগে একটা লম্বা ছুটিতে যাবার প্ল্যান করছেন। ছুটিতে যাবার আগে সালামকে বললেন, "দেখো, আমি ছুটি থেকে ফিরে এসে যদি দেখি তুমি সমস্যার সমাধান করে ফেলেছো তাহলে ওই প্রজেক্ট তোমার। আর যদি না করতে পারো তাহলে আমি প্রজেক্ট ফিরিয়ে নেবো।"
            সালাম বুঝতে পারলেন এত কম সময়ে এত জটিল সমস্যার সমাধান করা সহজ কথা নয়। কিন্তু চেষ্টা না করে ছেড়ে দেবার পাত্র তিনি নন। তিনি ফোন করলেন প্রফেসর ফ্রিম্যান ডাইসনকে, বার্মিংহামে।
            প্রফেসর ডাইসন আমেরিকান ইউনিভার্সিটিতে কাজ করলেও বছরের কয়েকটা মাস বার্মিংহাম ইউনিভার্সিটিতে কাটান। সালাম যখন ফোন করলেন তিনি তখন আমেরিকা যাবার জন্য ব্যাগ গোছাচ্ছেন। টেলিফোনে সালাম বললেন, "স্যার, আমি একজন নতুন রিসার্চ স্টুডেন্ট। রি-নরমালাইজেশান নিয়ে সমস্যায় পড়েছি। আপনার সাথে আলোচনা করতে চাই।"
            ফ্রিম্যান ডাইসন কিছুটা বিরক্ত হলেও উঠতি গবেষকদের ফিরিয়ে দেবার মত অভদ্রতা করতে পারেন না। তিনি সালামকে বললেন, "আমার সাথে কথা বলতে চাইলে তোমাকে আজকেই বার্মিংহামে আসতে হবে। কারণ আমি কালকেই আমেরিকা চলে যাচ্ছি।" 
            আবদুস সালাম দ্রুত চেপে বসলেন বার্মিংহামগামী ট্রেনে। ট্রেনে বসে আবার পড়লেন ফ্রিম্যান ডাইসনের প্রসিদ্ধ পেপার যা ১৯৪৯ সালে প্রকাশিত হয়েছে ফিজিক্যাল রিভিউতে। বার্মিংহামে প্রফেসর ডাইসনের সাথে দেখা করে সালাম তাঁকে অনুরোধ করলেন রি-নরমালাইজেশান সমস্যার সমাধানের জন্য কিছু পরামর্শ দেয়ার জন্য। কিন্তু ডাইসন স্বীকার করলেন যে তিনি যেভাবে সমস্যার সমাধান করেছেন তা পুরোপুরি গাণিতিক নয়। তিনি কিছু অনুমান-নির্ভর কাজও করেছেন - যা ঠিকমত লেগে গেছে, কিন্তু পুরোপুরি সমাধান তিনি পাননি।  
            কিছুটা অবাক এবং হতাশ হলেন আবদুস সালাম। কিন্তু হাল ছাড়লেন না। সেই রাতটা তিনি বার্মিংহামে কাটিয়ে পরদিন সকালবেলা চলে গেলেন ট্রেন স্টেশনে। প্রফেসর ডাইসন আমেরিকা যাবার প্লেন ধরার জন্য বার্মিংহাম থেকে লন্ডন যাচ্ছেন ট্রেনে। আবদুস সালাম ডাইসনের সঙ্গে ট্রেনে লন্ডন চলে গেলেন। যেতে যেতে আলোচনা করলেন রি-নরমালাইজেশান নিয়ে। ডাইসন আবদুস সালামের প্রতিভায় মুগ্ধ হলেন। নিজে যা জানেন তা বললেন সালামকে। 
সালাম ডাইসনকে লন্ডনে বিদায় দিয়ে ট্রেনে করে চলে এলেন কেমব্রিজে। মনে মনে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করলেন মেসনের রি-নরমালাইজেশান সমস্যার শেষ দেখে ছাড়ার।
            তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানে রি-নরমালাইজেশানের ধারণাটা জন্মায় কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের জন্মের সাথে সাথে। বিশ্বব্রহ্মান্ডের সমস্ত বস্তু ও শক্তিকে প্রধানত তিনভাগে ভাগ করা যায়। প্রথম ভাগে সবচেয়ে বড় বড় বস্তু - যেমন গ্যালাক্সি, নক্ষত্র, গ্রহ, উপগ্রহ ইত্যাদি। মহাকর্ষ বল কাজ করে এসব বস্তুর ওপর। অন্যদিকে দ্বিতীয় ভাগে আছে খুবই ছোট ছোট বস্তু যেমন - অণু পরমাণু কোয়ার্ক ইত্যাদি। নিউক্লিয়ার তত্ত্বের বিভিন্ন মডেল  এখানে কাজ করলেও কোন সুনির্দিষ্ট সূত্র আমাদের নেই যা নিউক্লিয়াসের ভেতরের সমস্ত কার্যকলাপ সুনির্দিষ্টভাবে ব্যাখ্যা করতে পারে।
            আর তৃতীয় ভাগটা হলো আমাদের প্রতিদিনের জাগতিক বস্তুগুলোর অধীনে। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স আমাদের এই প্রতিদিনের পৃথিবীর সমস্ত ক্রিয়াকলাপ ব্যাখ্যা করতে পারে গাণিতিক ভাবে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স ও ইলেকট্রনের ডায়নামিক্সের সমন্বয়ে এই তত্ত্ব। কিন্তু এখানে বড় সমস্যা হলো মাঝে মাঝে কিছু ঘটনার আবির্ভাব হয় যার গাণিতিক সমাধান সম্ভব হয়না। একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে।



ধরা যাক P বিন্দুতে একটা ইলেকট্রন আছে। তার চারপাশে একটা ইলেকট্রিক ফিল্ড তৈরি হয়েছে। ধরা যাক Q বিন্দুটি P বিন্দু থেকে r মিটার দূরে। Q বিন্দুতে যে ইলেকট্রিক ফিল্ড হবে তা P বিন্দু থেকে Q বিন্দুর দূরত্বের বিপরীত অনুপাতিক। অর্থাৎ দূরত্ব যত বেশি হবে ইলেকট্রিক ফিল্ডের মান তত কমতে থাকবে। আর দূরত্ব যদি কমতে থাকে, ইলেকট্রিক ফিল্ডের মান বাড়তে থাকবে। এখন PQ এর পারস্পরিক দূরত্ব কমতে কমতে যদি শূন্য হয়ে যায় তখন ইলেকট্রনের ফিল্ড হয়ে পড়ে অসীম। এটা কিন্তু একটা অসম্ভব ঘটনা। এই অসম্ভব ঘটনাকে গাণিতিক ভাবে সম্ভব করার যে পদ্ধতি তাকেই রি-নরমালাইজেশান বলা যায়।
             ফ্রিম্যান ডাইসনের সাথে দেখা করে লন্ডন থেকে কেমব্রিজে ফিরেই সমস্যার সমাধানে লেগে পড়লেন আবদুস সালাম। কয়েকদিনের মধ্যেই মনে হলো সঠিক পথটা খুঁজে পেলেন। এতদিন চেষ্টা করছিলেন স্পেস-টাইমের আইনস্টাইনের চতুর্মাত্রিক আপেক্ষিকতার প্রয়োগে। এখন তিনি চতুর্মাত্রিক মোমেন্টাম স্পেসে কাজ করতে শুরু করলেন। দেখলেন কাজ হচ্ছে। কিছুদিনের মধ্যেই পেয়ে গেলেন যা খুঁজছিলেন।
            ছুটি থেকে ফিরে এসে সালামের কাজ দেখে অবাক হয়ে গেলেন পল ম্যাথিউজ। মেসনের রিনর্মালাইজেশানের সম্পূর্ণ সমাধান হয়ে গেছে। তাঁরা দু'জনে মিলে দ্রুত লিখে ফেললেন দশ পাতার বিখ্যাত পেপার, "ওভারল্যাপিং ডাইভারজেন্সিস অ্যান্ড দি এস-ম্যাট্রিক্স।"
            ১৯৫০ সালের সেপ্টেম্বরে পেপারটা ফিজিক্যাল রিভিউর অফিসে পৌঁছায়, এবং প্রকাশিত হয় ১৯৫১ সালের এপ্রিল মাসে। কিন্তু পেপারটা প্রকাশিত হবার আগেই প্রি-প্রিন্ট ছড়িয়ে পড়ে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের টেবিল থেকে টেবিলে। এখনকার মতো উন্নত ইলেকট্রনিক মিডিয়া তখন ছিল না। কিন্তু ইউরোপ আর আমেরিকার বিজ্ঞানীদের মধ্যে যোগাযোগটা হতো। আবদুস সালাম একটা পেপারেই বিখ্যাত হয়ে গেলেন। এই কাজটার জন্যই তিনি কেমব্রিজের পিএইচডি ডিগ্রি পাবার উপযুক্ততা অর্জন করলেন। পেয়ে গেলেন কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির স্মিথ পুরষ্কার। ১৭৬৮ সাল থেকে প্রবর্তিত হয়েছে স্মিথ পুরষ্কার। প্রতি বছর যে রিসার্চ স্টুডেন্ট তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান এবং গণিতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য অবদান রাখেন তাকে এই পুরষ্কার দেয়া হয়। আবদুস সালামের গবেষণাক্ষেত্রে সাফল্যের মুকুটে প্রথম পালক এই স্মিথ পুরষ্কার।   
            কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির নিয়ম অনুযায়ী পিএইচডি ডিগ্রির জন্য কমপক্ষে তিন বছরের গবেষণা থাকা দরকার। সে হিসেবে আবদুস সালামের হয়েছে মাত্র দেড় বছর। এরমধ্যেই তাঁর পিএইচডি থিসিস রেডি হয়ে গেছে। কিন্তু ডিগ্রির জন্য অপেক্ষা করতে হবে আরো দেড় বছর।
            আবদুস সালামের সাফল্যে প্রফেসর কেমার কিছুটা লজ্জা পাচ্ছেন এই ভেবে যে তিনি তাঁর সুপারভাইজার হতে রাজি হননি। এই লজ্জা থেকে মুক্তির জন্য তিনি ঠিক করলেন আবদুস সালামের ক্যারিয়ার গড়তে সাহায্য করবেন। তিনি প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে একটা ফেলোশিপের ব্যবস্থা করলেন আবদুস সালামের জন্য।
            কিন্তু ছোট্ট একটা সমস্যা হলো। আবদুস সালাম যেহেতু তখনো পিএইচডি ডিগ্রি পাননি, তাঁর অফিসিয়াল পরিচয় তিনি কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির ছাত্র। আর কেমব্রিজের নিয়ম অনুযায়ী তাদের কোন ছাত্র যদি অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করতে চায় তবে তার সুপারভাইজার হতে হবে কেমব্রিজেরই কেউ বা যিনি কেমব্রিজে আগে ছিলেন। প্রফেসর কেমার অফিসিয়ালি সেই ব্যবস্থাও করে ফেললেন। পল ম্যাথিউজ তখন প্রিন্সটনের ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে যোগ দিয়েছেন। পল ম্যাথিউজ হলেন আবদুস সালামের সুপারভাইজার।
            ১৯৫১ সালের জানুয়ারি মাসে নিউইয়র্কে পৌঁছলেন আবদুস সালাম। সেখান থেকে ট্রেনে চেপে নিউজার্সির প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটি। আবদুস সালাম ভেবেছিলেন ইনস্টিটিউটে পল ম্যাথিউজ ছাড়া আর কেউ তাকে চিনবেন না। কিন্তু না, তাঁর পেপার সেখানে সবাই পড়েছেন এবং তাঁকে একজন বিরাট কেউ ভাবছেন। সবাই ভাবছেন পঁচিশ বছরের এই ছেলেটা পদার্থবিজ্ঞান থেকে অবাঞ্ছিত 'ইনফিনিটি' সমস্যার মূল উপড়ে ফেলতে শুরু করেছেন।
            পল ম্যাথিউজ আর তাঁর স্ত্রী মার্গিট ম্যাথিউজ আন্তরিক অভ্যর্থনা জানালেন আবদুস সালামকে। পুরোদমে শুরু হলো সালাম-ম্যাথিউজের যৌথ গবেষণা। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সে যেমন ফাইনম্যান-সুইংগার, তেমনি মেসন তত্ত্ব হয়ে পড়লো সালাম-ম্যাথিউজের।
            ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজের পরিচালক রবার্ট ওপেনহেইমার আবদুস সালামের গবেষণা সম্পর্কে খোঁজখবর রাখেন। আবদুস সালাম তাঁর পরবর্তী পেপার সাবমিট করার আগে একটা কপি ওপেনহেইমারের অফিসে রেখে এলেন। কিন্তু পরের দিন বুঝতে পারলেন তিনি ফাইনাল কপির বদলে খসড়া কপি দিয়ে এসেছেন ওপেনহেইমারকে। দ্রুত ছুটে গেলেন ওপেনহেইমারের অফিসে। যদি তিনি পেপারটি না পড়ে থাকেন তাহলে খসড়াটা বদলে ফাইনাল কপিটা দিয়ে আসা যাবে।
            সালামকে দেখে ওপেনহেইমার বললেন, "আমি আপনার পেপারটা পড়েছি ডক্টর সালাম। খুব ভালো লেগেছে। খুবই ভালো পেপার।"
            আবদুস সালামের উচিত ছিলো এটুকু শুনে খুশি হয়ে চলে আসা। কিন্তু তিনি একটু ভুল করলেন। ওপেনহেইমারকে বললেন, "আপনি যে পেপারটা পড়েছেন ওটা ছিল খসড়া কপি। আমি ভুল করে ফাইনাল কপির বদলে খসড়াটা দিয়েছি আপনাকে।"
            "তাতে কী হয়েছে? আমি পড়েছি পেপারটা। খুব ভালো পেপার।"
            "না আসলে ওটাতে কোন ডায়াগ্রাম ছিল না তো, আমি ভেবেছি আপনি বুঝতে পারবেন না।"
            আবদুস সালাম জানতেন না ওপেনহেইমার কীরকম মেধাবী আর স্পর্শকাতর। সালামের কথায় খুবই বিরক্ত হলেন ওপেনহেইমার। রুক্ষভাবে বললেন, "আপনার রেজাল্টগুলো সঠিক। ডায়াগ্রাম ছাড়াই ওগুলো বুঝতে পারার মতো বুদ্ধি আমার আছে।"
             ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিতে আবদুস সালাম যখন কাজ করছিলেন, আলবার্ট আইনস্টাইন তখনো ছিলেন সেখানে। যদিও আইনস্টাইনের সাথে খুব একটা আলাপ-পরিচয় হবার সুযোগ ঘটেনি সালামের।
            আবদুস সালাম তাঁর প্রিন্সটনের দিনগুলো সম্পর্কে বলেছেন, "প্রিন্সটনে সবাই আমাকে যেরকম বড় মাপের বিজ্ঞানী মনে করছিলো তাতে আমি খুবই লজ্জা পাচ্ছিলাম। আমি নিজে যেটুকু করেছি সেটুকু ছাড়া সমসাময়িক পদার্থবিজ্ঞানের আর কিছুই জানতাম না তখন। আমি খুব ভয়ে ভয়ে থাকতাম এই ভেবে যে যদি সবাই জেনে যায় যে আমি কিছুই জানি না!"
            এসময় একদিন প্রিন্সটনে আবদুস সালামের সাথে দেখা করতে এলেন স্যার মোহাম্মদ জাফরুল্লাহ খান। আবদুস সালাম প্রথম যেদিন ইংল্যান্ডে পা রেখেছিলেন ঘটনাচক্রে জাফরুল্লাহ খানের সাথে দেখা হয়েছিল তাঁর। এই পাঁচ বছরে আবদুস সালাম পদার্থবিজ্ঞানের জগতে নিজেকে অনেকখানি প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। জাফরুল্লাহ খানেরও অনেক পরিবর্তন হয়েছে। ব্রিটিশ ভারতের ফেডারেল কোর্টের বিচারক জাফরুল্লাহ খান স্বাধীন পাকিস্তানের প্রথম পররাষ্ট্রমন্ত্রী এবং জাতিসংঘে স্বাধীন পাকিস্তানের প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে নিউইয়র্কে এসেছেন। আবদুস সালামের বৈজ্ঞানিক উন্নতির খবর তিনি রাখেন। তিনি জানেন সদ্য স্বাধীন দেশের উন্নতি ঘটাতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে হবে। সেই উন্নতির পথে নেতৃত্ব দিতে পারবেন আবদুস সালামের মতো তরুণ বিজ্ঞানীরা। তাই নিজেই চলে এসেছেন নিউইয়র্ক থেকে নিউজার্সিতে শুধুমাত্র আবদুস সালামের সাথে দেখা করতে।
            আবদুস সালাম জাফরুল্লাহ খানের সাথে কয়েকদিন ঘুরে বেড়ালেন নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির বিভিন্ন জায়গায়। নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সদর দফতরের ভবন তখন তৈরি হচ্ছিলো। জাফরুল্লাহ খানের মাধ্যমে জাতিসংঘের অনেক কর্মকর্তার সাথে পরিচয় হলো আবদুস সালামের। তিনি অনুভব করলেন তৃতীয় বিশ্বের উন্নতির জন্য জাতিসংঘ বিরাট ভূমিকা রাখতে পারে। সেদিন অবশ্য তিনি ভাবেননি যে কয়েক বছর পরে তিনি নিজেও জড়িত হবেন জাতিসংঘের বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নয়ন প্রকল্পে।
            প্রিন্সটনে ফিরে এসে আবদুস সালাম আবার গভীরভাবে ডুবে গেলেন মেসন রি-নর্মালাইজেশানের গবেষণায়। ততদিনে মেসন তত্ত্ব সালাম-ম্যাথিউজের নিজস্বতার ছাপ পেতে শুরু করেছে। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির বার্ষিক সভায় সালাম-ম্যাথিউজ তত্ত্ব বিশেষভাবে আলোচিত হচ্ছে। যেমন কয়েক বছর আগে হয়েছিল ফাইনম্যান-সুইংগারের কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্স সম্পর্কে। সালাম-ম্যাথিউজের রি-নরমালাইজেশান পদ্ধতিকে মেসন তত্ত্বের মূল ভিত্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। ১৯৫১ সালের অক্টোবরে রিভিউজ অব মডার্ন ফিজিক্সে প্রকাশিত হলো সালাম-ম্যাথিউজের বিখ্যাত রিভিউ পেপার 'দি রি-নরমালাইজেশান অব মেসন থিওরি'।
            ফাইনম্যান-সুইংগারের কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের পর সালাম-ম্যাথিউজের মেসন তত্ত্ব তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানীদের মধ্যে একটা নতুন আস্থার জায়গা তৈরি করলো যে নিউক্লিয়ার ফিল্ডের একটা কার্যকরী তত্ত্ব পাওয়া গেছে। প্রিন্সটনে ফ্রিম্যান ডাইসন তো ওপেনহেইমারকে বলেই ফেললেন, "আমরা এখন নিউক্লিয়ার থিওরি পেয়ে গেছি যা এমন পর্যায়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব যেখান থেকে আমাদের তত্ত্বীয় হিসাব পরীক্ষণের ফলাফলের সাথে মিলে যাবে।"
            কিন্তু তাঁদের আশার গুড় দ্রুত তেঁতো হতে শুরু করলো যখন দেখা গেলো নিউক্লিয়াসের তত্ত্ব যতটা আয়ত্ত্বে এসেছে মনে করা হয়েছিলো আসলে ততটা আসেনি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আমেরিকাতে পারমাণবিক বোমা বানানো হয়েছে। পার্টিক্যাল অ্যাক্সিলারেটরের মাধ্যমে নিউক্লিয়ার বিক্রিয়া ঘটানো সম্ভব হচ্ছে। বিভিন্ন নিউক্লিয়াসের বিক্রিয়ায় দেখা যাচ্ছে নতুন নতুন কণার দেখা পাওয়া যাচ্ছে যা কোন তত্ত্ব দিয়ে সঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ কণাগুলোর স্থায়িত্ব কাল খুবই কম (এক সেকেন্ডের হাজার ভাগেরও কম)। মেসন তত্ত্ব শুধুমাত্র মেসন কণারই কাজকর্ম ব্যাখ্যা করতে পারে, অন্য কোন কণার ক্ষেত্রে মেসন-তত্ত্ব কাজ করে না। সালাম বুঝতে পারছিলেন যে তাঁদের তত্ত্ব  দ্রুত আকর্ষণ হারাবে নতুন তত্ত্বের আবির্ভাবের সাথে সাথেই।
            আবদুস সালামের যে স্কলারশিপ ব্রিটিশ সরকারের সময়ে শুরু হয়েছিল তা পাকিস্তান সরকার এতদিন পর্যন্ত চালিয়েছিল। ১৯৫১ সালে আবদুস সালামের স্কলারশিপ শেষ হয়ে গেল। প্রিন্সটনে ইনস্টিটিউট অব অ্যাডভান্সড স্টাডিজে একটা অস্থায়ী ফেলোশিপের অফার পেয়েছেন আবদুস সালাম। কিন্তু তাঁর আর মন টিকছে না দেশের বাইরে।
            ১৯৪৯ সালে দেশে গিয়ে বিয়ে করে মাস দুয়েকের মধ্যেই আবদুস সালাম ইংল্যান্ডে ফিরে এসেছিলেন স্ত্রীকে পাকিস্তানের মুলতানে তাঁর মা-বাবার কাছে রেখে। ১৯৫০ সালে তাঁর প্রথম সন্তান আজিজার জন্ম হয়েছে। অথচ তিনি তখনো সন্তানের মুখ দেখতে পাননি। নতুন দেশের জন্ম হয়েছে - অথচ তিনি দেশ গড়ার কোন কাজে লাগছেন না। হঠাৎ মন কেমন করে উঠলো আবদুস সালামের। কন্যার টান, দেশের টানে দেশে ফেরার সিদ্ধান্ত নিলেন আবদুস সালাম। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts