Saturday 9 February 2019

প্রথম দেখা আমেরিকা - সপ্তদশ পর্ব


লস অ্যাঞ্জেলেস-২

হিস্‌ হিস্‌- হিস্‌ হিস্‌-

থেমে থেমে শব্দ হচ্ছে একটা এই শব্দেই ঘুম ভেঙ্গেছে চোখ না খুলে বুঝতে চেষ্টা করছি শব্দটি আসছে কোত্থেকে মনে হচ্ছে আমার বিছানার খুব কাছ থেকেই আসছে শব্দটি সাপ ঢুকে পড়লো নাকি রুমের ভেতর? সাপের কথা ভাবতেই গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠলো আস্তে করে চোখ খুললাম
            
না, সাপ নয় দেখলাম একজন লোক বুকডন দিচ্ছে ফ্লোরে আর ফোঁস ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলছে বিছানায় উঠে বসলাম বুকডনরত লোকটিকে কালরাতে ঘুমন্ত দেখেছিলাম জিমের ছেড়ে যাওয়া বিছানায়
            
খালি গা, হাফ প্যান্ট পরা লোকটি কুৎসিত ভঙ্গিতে বুকডন দিয়েই চলেছে মনে হচ্ছে বুকডন দেয়ার জন্যই আমেরিকায় এসেছে সে কোন্‌ দেশ থেকে এসেছে এখনো জানি না
            
ফ্লোরজুড়ে তার শরীরচর্চা চলছে বাথরুমে যেতে হলে তাকে ডিঙিয়ে যেতে হবে এখন কিন্তু তা সম্ভব নয় মৃদু কেশে, গলায় শব্দ করে দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করলাম কিন্তু কোন প্রতিক্রিয়া হলো না তার বুকডন দেয়াটাকে মনে হচ্ছে সে তপস্যার পর্যায়ে নিয়ে গেছে, এত সহজে তার তপোভঙ্গ হবে না এরকম পরিস্থিতিতে খাঁটি বাংলাভাষা মাঝে মাঝে ভালো কাজ দেয় সোজা বাংলায় বললাম, " মিয়া, ফাইজলামি পাইছো? সক্কালবেলা ঘরের মইদ্যে মিলিটারি ট্রেনিং শুরু কইরছো?"
            
এবার কাজ হলো বুকডন বন্ধ হলো ফ্লোরে বসে পড়লো ব্যায়ামবীর আমার দিকে তাকিয়ে ছোট ছোট চোখ আরো ছোট করে জ্ঞিজ্ঞেস করলো, "হোয়াট ডিড ইউ সে?"
            "গুডমর্নিং"
            "গুডমর্নিং ইউ সেড গুডমর্নিং? ভেরি সেনটেন্স ফর গুডমর্নিং হোয়াট ল্যাঙ্গুয়েজ ইজ দিস?"
            "বাংলা"
            "বাংলা? আর ইউ ফ্রম বাংলাদেশ?"
            
মনটা ভরে গেলো এই অজানা দেশের মানুষটির মুখে বাংলাদেশের নাম শুনে যেখানেই যাই সবাই ভাবে ইন্ডিয়ান বাংলাদেশ যে একটি স্বাধীন দেশ সেটাই অনেকে জানে না জ্ঞিজ্ঞেস করলাম, "আপনি কোত্থেকে এসেছেন?"
            "ফ্রান্স"
            
ফ্রান্স! অবাক হবার পালা আমার লোকটার চেহারায় সামান্য চায়নিজ ছাপ আছে আবার ইংরেজি উচ্চারণ মোটেই চায়নিজদের মতো নয়, ফরাসিদের মতোও নয়
            
লোকটা বুঝতে পেরেছে আমি কী ভাবছি বললো, "আমি আসলে ভিয়েতনামী খুব ছোটবেলায় মা-বাবার সাথে চলে গিয়েছিলাম ফ্রান্সে আমি একজন ডাক্তার আমার নাম ট্র্যান- চ্যান ট্র্যান"
            
ডাক্তার চ্যান ট্র্যান উঠে দাঁড়িয়েছেন এবার বিছানা থেকে তোয়ালে টেনে নিয়ে গা ঢাকতে ঢাকতে বললেন, "তুমি সেসময় আসলেগুডমর্নিংবলোনি, মিলিটারি ট্রেনিং সম্পর্কিত কিছু একটা বলেছো"
            
বুঝতে পারছি লোকের সাথে চালাকি করে পার পাওয়া আমার কম্ম নয় অকপট হওয়াই এখন সবচেয়ে সহজ পথ কিন্তু বাংলায় যা বলেছিলাম তা তো ইংরেজিতে অনুবাদও করতে পারছি না মিয়া ফাইজলামি পাইছো ইংরেজি অনুবাদ কী হবে? না, অকপট হওয়া সম্ভব হলো না
            
বাক্যের শেষ অংশটাকে ইংরেজি করে শোনালাম তাকে কিন্তু বলেই অন্যরকম বিপদে পড়লাম ডাক্তার সাহেব আমার কথা শুনেই ব্যায়ামের উপকারিতা বিষয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন
            
বক্তৃতা শুনে মনে হচ্ছে এই ডাক্তার রোগীদের ওষুধ না দিয়ে কেবল ব্যায়ামের নির্দেশাবলীই লিখে দেন প্রেসক্রিপশানে। যেমন: বুকডন-১০টি, দৈনিক তিনবার কর্তব্য, উল্লফন-১৫টি; শয্যাত্যাগের পরপর
            দ্রুত বাথরুমে ঢুকে গেলাম ব্যায়ামের উপকারিতার মহাভারত থেকে বাঁচতে
            
বাথরুম থেকে বেরিয়ে দেখি ডাক্তার রুমে নেই তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে রুমের বাইরে এসে দেখি ডাক্তার সাহেব করিডোরে পায়চারি করছেন ভঙ্গিটা অস্বস্তির যথাসময়ে টয়লেট (সরি, রেস্টরুম) খালি না পেয়েই এই পায়চারি নাকি এটা তাঁর প্রাতঃকালীন ব্যায়ামের অংশ বুঝতে পারলাম না          

ঝলমলে রোদেলা সকাল হলিউড হাইল্যান্ড স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে চেপে বসলাম এখানকার স্টেশনে প্রবেশ বা প্রস্থান পথে চেকিং সিস্টেম নেই টিকেট চে করার জন্য কোন গার্ডও দেখলাম না কোথাও টিকেট ছাড়া ভ্রমণ করে অনেকেই মাঝে মাঝে নাকি ট্রেনে টিকেট চেকার আসে কিন্তু সেটা এতই ঢাকঢোল পিটিয়ে যে সেদিন সবাই সাধু হয়ে যায়
            
আজ আবার এসেছি ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে আমার বাৎসরিক টিকেটটি নিতে হবে ইয়ার-পাস নেবার কাউন্টার আলাদা একটি ফরমে নাম ঠিকানা সহ অনেক তথ্য দিতে হলো কাউন্টারে পরিচয়-পত্র হিসেবে পাসপোর্ট দেখাতে হলো ডিজিটাল ক্যামেরায় ছবি তুলে নিয়ে তা ম্যাগনেটিক কার্ডে প্রিন্ট করে দেয়া হলো সারা বছরের ইউনিভার্সাল স্টুডিও-পাস আগামী এক বছর যাবত যতবার খুশি আমি ইউনিভার্সাল স্টুডিওতে ঢুকতে পারবো বিনে পয়সায় আমার হয়তো এক বছরের মধ্যে আর আসা হবে না, কিন্তু যারা স্থানীয় বা আমেরিকান- তাদের জন্য এটা নিশ্চয় একটি ভালো সুযোগ


            

আজ আবার ঘুরে দেখলাম চারদিক স্টুডিও-ট্যুরে গেলাম কিন্তু খেয়াল করলাম গতকাল যেরকম থ্রিল অনুভব করছিলাম, আজ সেরকম মনে হচ্ছে না আজকের ট্যুর গাইডও তেমন ভালো নয় তাছাড়া আগে থেকে কী হতে যাচ্ছে সব জানা থাকাতে গতকালের উত্তেজনাটা নেই একটি সিনেমা একবার দেখার পরপরই আবার দেখতে বসলে যেরকম লাগে আমারও সেরকম লাগছে আজ আরো কিছুদিন পরে এলে হয়তো আবার ভালো লাগবে সব
            
ইউনিভার্সাল সিটি স্টেশন থেকে মেট্রোরেলে চেপে চলে গেলাম রেডলাইনের শেষ প্রান্তে ইউনিয়ন স্টেশনে এই স্টেশনটি ইউনাইটেড স্টেটস এর সর্বশেষ রেলরোড স্টেশন আমেরিকার উত্তরদিক থেকে রেললাইন শুরু হয়ে দক্ষিণের শেষ মাথায় এসে এখানেই শেষ হয়েছে


ইউনিয়ন স্টেশন বিল্ডিং
     
ক্যালিফোর্নিয়া আমেরিকার সবচেয়ে দক্ষিণের রাজ্য এরপরেই প্রশান্ত মহাসাগর স্টেশন বিল্ডিংটি অনেক পুরনো বলে মনে হচ্ছে স্প্যানিশ স্টাইলের বিল্ডিং, মার্বেল পাথরের ঝকঝকে মেঝে কেমন একটা গির্জা গির্জা ভাব ওয়েটিং রুমটাকে মনে হচ্ছে রেলওয়ে জাদুঘর থরে থরে সাজানো আমেরিকান রেলওয়ের বহু ঐতিহাসিক মুহূর্তের ফটোগ্রাফ
            
ইউনিয়ন স্টেশন থেকে বেরিয়ে সামান্য উত্তর দিকে গেলেই লস অ্যাঞ্জেলেস সেন্ট্রাল পোস্ট অফিসের বিশাল ভবন সেদিন ট্যুরবাসে এসেছিলাম এদিকের অনেকগুলো রাস্তায় হাঁটতে হাঁটতে মেক্সিকান পার্কে এসে দেখি পার্ক সুনশান তেমন কেউ নেই আজ পার্কের বেঞ্চিতে ঘুমাচ্ছে কিছু মানুষ, পাশে রাখা বিরাট ময়লা ব্যাগ আমেরিকার গৃহহীন মানুষ
            
সামনের ফুটপাতে বিরাট লম্বা লাইন চার্চের দরজায় গিয়ে মিশেছে লাইনে যারা দাঁড়িয়ে আছে- দেখেই বোঝা যাচ্ছে তারা খুব গরীব রবিবার দিন এই চার্চে ফ্রি লাঞ্চের ব্যবস্থা আছে, তাই এত ভীড়
            
পার্কের বেঞ্চে বসে দেখছিলাম ফ্রি-লাঞ্চের আশায় লাইনে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে আমাদের দেশেও শুক্রবারে মসজিদের সামনে ভিখারিদের এরকম ভিড় হয় আমাদের দেশের ভিখারিদের সাথে এদেশের ভিখারিদের পার্থক্য কী? এরা লাইনে দাঁড়ায়, আমরা বেলাইনে দাঁড়াই আর কিছু?
            
ধনতন্ত্রের পৃষ্ঠপোষকরা গণতন্ত্র গণতন্ত্র বলে চেঁচায় সবার জন্য সমান অধিকারের কথা বলে কিন্তু এই ভিখারিগুলো আসলে কীসের অধিকারী? আমেরিকান বাজেটের শতকরা বাইশ ভাগ খরচ হয় সোশাল সিকিউরিটি খাতে, আরো চৌদ্দ ভাগ বরাদ্দ আছে কল্যাণভাতা বাবদ এদেশে তো গরীব থাকার কথা নয়, গৃহহীন থাকার কথা নয় কিন্তু চোখের সামনেই দেখছি গরীব মানুষ, ফুটপাতে গাছের নিচে পার্কে ঘুমানো গৃহহীন মানুষ তবে আমেরিকান অর্থনীতি আর বাংলাদেশের অর্থনীতিতে পার্থক্য কোথায়? অর্থনীতির জটিল তত্ত্ব আমার মাথায় ঢুকছে না কিছুতেই
            
পার্কের বেঞ্চে ঘুমন্ত একজন মানুষের ছবি তুলতেই উঠে বসলো লোকটা জড়ানো গলায় বললো, "ছবি তুলেছো?"
            "হ্যাঁ"
            "দশ ডলার বের করো"
            আবার কোন বিপদে পড়লাম?
            
লোকটির চোখ টকটকে লাল মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল, বলিষ্ঠ শরীরের শ্বেতাঙ্গ আমেরিকান তার বেঞ্চের নিচে গড়াচ্ছে ব্রাউন পেপারে মোড়া দুতিনটি বিয়ারের বোতল এদেশে প্রকাশ্য স্থানে অ্যালকোহল পান করা আইনত দন্ডনীয় বলে বোতলে কাগজ পেঁচিয়ে খায় লোকটি এই দুপুরেই মদ খেয়ে মাতাল হয়ে আছে ভয়ংকর ব্যাপার কিন্তু চাহিবামাত্র দশ ডলার বের করে দেবো আমি? এটা কি ঢাকা শহর নাকি? পকেট থেকে মানিব্যাগ বের করলে সে ব্যাগ আমার পকেটে ঢোকাতে পারবো তার কোন নিশ্চয়তা নেই
            
ট্রাভেল-বুকের পরামর্শ অনুযায়ী কিছু খুচরো ডলার আলাদা করে রেখেছিলাম শার্টের পকেটে; ছিনতাইকারীদের জন্য কারণ ছিনতাইকারীরা নাকি পকেটে কিছু না পেলে নিজেদের খুব অপমানিত মনে করে ছুরি চালিয়ে দেয় সেখান থেকে এক ডলারের একটি নোট লোকটির হাতে ধরিয়ে দিয়ে হাঁটতে শুরু করলাম লোকটি বিশ্রি ভাষায় গালাগালি করছে আমার হাঁটার গতি বেড়ে গেলো 
            
চায়না টাউনের দিকে কিছুদূর গিয়ে দেখি হনহন করে হেঁটে আসছেন ডাক্তার ট্র্যান গলায় ক্যামেরা ঝুলছে এই গরমেও গায়ে লম্বা ওভারকোট আমাকে দেখতে পেয়েই বললেন, "হ্যালো"
            "হ্যালো এদিকে কোথায়?"
            "হাঁটছি হেঁটে হেঁটে দেখছি সব হাঁটলে শরীর ভালো থাকে হৃৎপিন্ডে ..."
            
এইরে, আবার শুরু হলো মনে হচ্ছে লোকটি হলিউড থেকে হেঁটে হেঁটে চলে এসেছে ডাউন টাউন পর্যন্ত বারো মাইল রাস্তা হেঁটে এসেছে এই ভরদুপুরে! তাও একটা ভারী ওভারকোট গায়ে দিয়ে! জ্ঞিজ্ঞেস করলেই হয়তো তাপসঞ্চালন বিষয়ে বক্তৃতা শুরু করবে কেটে পড়াই বুদ্ধিমানের কাজসি ইউ লেইটারবলে একটু জোরেই পা চালালাম চায়না টাউনের দিকে
            
লস অ্যাঞ্জেলেসের চায়না টাউনটি বেশ বড়, ষোলটি ব্লক জুড়ে ছড়ানো ছিটানো চায়নিজদের ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লস অ্যাঞ্জেলেসে প্রায় দু'লাখ চায়নিজ আছে। তাদের মধ্যে প্রায় দশ হাজারের মত চায়নিজের বাস এই চায়না টাউনে বাকীরা সব থাকে আরো পুবে মনটেরি পার্কের দিকে
            
আজ রবিবার বলে অনেক দোকানপাট বন্ধ তারপরও ভীড় কম নয় বিশেষ করে রেস্টুরেন্টগুলোতে প্রচন্ড ভীড় দেখা যাচ্ছে প্রায় সবাই চায়নিজ এখানে কত প্রজন্ম কাটছে তাদের এই আমেরিকায়?
            
১৮৫০ সালের লোকগণনায় লস অ্যাঞ্জেলেসে চায়নিজ ছিলো মাত্র দু'জন ফাউ আর লুইস; পেশায় গৃহভৃত্য উনিশ শতকের শেষের দিকে যখন এখানে রেলওয়ের কাজ শুরু হয়, দলে দলে চায়নিজ শ্রমিক আসতে থাকে রেলওয়ে স্টেশনের পাশের খালি জায়গায় বসতি গড়ে উঠলো তাদের দিনের পর দিন খেটেছে তারা স্থানীয় আমেরিকানরা কোনদিনই ভালো চোখে দেখেনি চায়নিজদের সুযোগ পেলেই তারা চায়নিজদের ওপর আক্রমণ অত্যাচার চালিয়েছে ফলে চায়নিজরা বাধ্য হয়েছে সবসময় দলবেঁধে থাকতে
            
১৮৭১ সালে একদিনে উনিশজন চায়নিজকে খুন করা হয় এই লস অ্যাঞ্জেলেসে শুধু খুন করেই ক্ষান্ত হয়নি ১৯৩১ সালে বুলডোজার দিয়ে গুড়িয়ে দেয়া হয় চায়নিজদের বসতি; রেলওয়ে স্টেশনের পাশে গড়ে ওঠা তাদের প্রথম চায়না টাউন রেলওয়ে স্টেশন সম্প্রসারণের জন্য ওটা নাকি জরুরী ছিলো সবকিছু হারিয়ে চায়নিজরা সরে এলো রেলওয়ে স্টেশন থেকে কয়েক ব্লক পরে এখানে; বর্তমানের চায়না টাউনে
            
চায়না টাউনে এখন গড়ে উঠেছে বিরাট বিরাট সুপার মার্কেট এখানে আছে চায়নিজদের নিজস্ব ব্যাংক, মন্দির, ক্যাসিনো, হোটেল আর রেস্টুরেন্ট একটি চায়নিজ রেস্টুরেন্টে ঢুকে সাজানো মাছ দেখে আর লোভ সামলাতে পারলাম না দামও বেশ সস্তা এখানে মাত্র সাড়ে ছয় ডলারে মাছ আর ভাত এখানে টিপসও দিতে হয় না
            
ডাউন টাউন সিভিক সেন্টারের দক্ষিণ দিকে জাপানীদের আস্তানা- লিটল টোকিও ১৮৮০ সাল থেকে জাপানীদের বাস এখানে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানীজ-আমেরিকানদের সরিয়ে নেয়া হয়েছিলো এখান থেকে জাপানীরা প্রাণভয়ে তাদের ব্যবসা বাণিজ্য ঘরবাড়ি সব ফেলে চলে গিয়েছিলো যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে দেখলো স্থানীয় আমেরিকানরা দখল করে নিয়েছে তাদের সবকিছু আর কোনদিন তা ফিরে পায়নি তারা সবকিছু আবার নতুন করে গড়ে তুলতে হয়েছে এখানে, যেমন গড়তে হয়েছে জাপানে
            
হাঁটতে হাঁটতে ফিরে এলাম ইউনিয়ন স্টেশনে সন্ধ্যা নামার আগেই ফেরা উচিত রবিবারের সন্ধ্যায় ট্রেনে যাত্রীসংখ্যা খুব কমে যায় বলে বিপদের সম্ভাবনা বেড়ে যায় সারা কম্পার্টমেন্টে ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাত্র ছয়-সাতজন যাত্রী ট্রেন প্লাটফরমে থেমে আছে অনেকক্ষণ
            
কয়েকজন ভিখারি ঘুরে বেড়াচ্ছে প্লাটফরমে একজন উঠলো আমাদের কম্পার্টমেন্টে ট্রেন ছাড়ার পর একে একে সবার সামনে গিয়েই হাত পাতলো কেউ কিছু দিলো না তাকে মনে হচ্ছে ভিক্ষাবৃত্তি খুব একটা লাভজনক নয় এখানে
            
সন্ধার আগেই পৌঁছে গেলাম হলিউড সিটিতে একটা স্যুভেনির শপে পরিচয় হলো একজন বাংলাদেশির সাথে তিনি দেখিয়ে দিলেন আরো কিছু বাংলাদেশি দোকান স্যুভেনির শপ ছাড়াও বেশ কিছু ফুডকর্নার চালাচ্ছেন বাংলাদেশিরা কথা বললাম তাদের সঙ্গে বাংলাদেশের জন্য তাঁদের সবার উদ্বেগ, আশা, হতাশা সবকিছুই আছে- যেমন থাকে প্রথম প্রজন্ম প্রবাসীর কয়েকজন বললেন এগারোই সেপ্টেম্বরের পরে তাঁদের কী কী নতুন সমস্যায় পড়তে হচ্ছে তাঁদের প্রত্যেকের ভেতরেই দেখলাম  অ্যারাবিয়ানদের প্রতি প্রচন্ড ক্ষোভ
            
খুব ভালো লাগলো স্বদেশীয়দের সাথে কথা বলে কাল চলে যাচ্ছি শুনে একজন এয়ারপোর্টে পৌঁছে দেবার প্রস্তাব করলেন মনটা ভরে গেলো তাঁর বদান্যতায় বুঝিয়ে বললাম তাঁকে, হোস্টেল থেকেই এয়ারপোর্ট শাটলের ব্যবস্থা আছে অনেকেই জোর করলেন তাঁদের বাসায় যাবার জন্য, সেখানে রাতে খাবার জন্য প্রবাসে মানুষ মাত্রেই সজ্জন আমি অতিথি বলেই হয়তো কথাটা খুব সত্য নইলে প্রবাসীদের এতটা দলাদলিতো থাকার কথা ছিলো না অপরিচিত মানুষ শত্রু  হয় না, পরিচয়ের পরে স্বার্থের বেড়াজালেই গড়ে ওঠে মানুষে মানুষে শত্রু তা।
            
হোস্টেলে ফেরার পথে গতকালের যীশুপ্রেমিক লোকটিকে দেখলাম আজও ফুটপাতে দাঁড়িয়ে একই ভঙ্গিতে হাতপা ছুঁড়ে যীশুর প্রেম বিতরণ করছে হয়তো এটাই তার জীবিকা, এভাবেই হয়তো তার সংসার চলে পৃথিবীতে শুধুমাত্র বেঁচে থাকার জন্য মানুষকে কত সংগ্রাম করতে হয়, কত ধরনে সংগ্রাম করতে হয়- আমি তাদের কতটুকুই বা খবর রাখি

______________


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts