Friday 8 February 2019

প্রথম দেখা আমেরিকা - দশম পর্ব


কনফারেন্স: শেষ দিন

আজ কনফারেন্সের শেষ দিন সকাল দশটার আগেই আমার বক্তৃতা শেষ হয়ে যাবে তারপর মুক্তি মুক্তির কথা চিন্তা করলেই ভালো লাগা এসে যায় মন জুড়ে
            
আটটা বাজার পাঁচমিনিট আগে ঢুকলাম পিকিউরিস রুমে স্টিভেনের কথা মনে হচ্ছে সত্যি এর মধ্যেই রুমে অনেক মানুষ অধিবেশনে মোট দশজন বক্তৃতা করবে স্টিভেন এসে গেলো একটু পরেই লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবের প্রফেসর হাইট অধিবেশনের সভাপতি
            
আমি আর স্টিভেন ছাড়া বক্তাদের প্রায় সবাই প্রফেসর তাদের ছাত্রছাত্রী এবং সহকর্মীদের অনেকেই এসেছেন বলে আজ এত দর্শক একটু পরে দেখি ডেবি উপস্থিত এই মেয়ে আবার উল্টোপাল্টা প্রশ্ন করে বসবে না তো? ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকোর এক বুড়ো প্রফেসর খুব জটিল জটিল প্রশ্ন করেন- প্রত্যেক অধিবেশনেই আজও তিনি হাজির স্টিভেন আমার কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করে যা বললো তার অর্থ হলো আমাদের প্রতিপক্ষ বেশ প্রস্তুত হয়ে এসেছে
            
গবেষণায়প্রতিপক্ষশব্দটা শুনতে কেমন জানি লাগে কিন্তু নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের সমস্যা হলো- পদার্থবিজ্ঞানের শাখার বয়স প্রায় সত্তর বছর হলেও এখনো পর্যন্ত তার সর্বজনগ্রহণযোগ্য কোন তত্ত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়নি যা কিছু কাজ চলছে সবই নিউক্লিয়ার মডেলের উপর ভিত্তি করে একেক গ্রুপ একেক ধরনে মডেল দেয় আর প্রত্যেকেই মনে করে তাদের মডেলই সবচেয়ে ভালো প্রত্যেকের তূণেই তীর আছে এবং যুদ্ধও করতে জানে সবাই গ্রুপের নতুন সদস্য হিসেবে আমাকে যুদ্ধবিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার ব্যাপারে স্টিভেন খুব সচেষ্ট কিন্তু সত্যি বলতে কি- মাঝে মাঝে স্টিভেনকে আমার অহেতুক গোঁয়ার্তুমি করছে বলে মনে হয়
            
স্টিভেনের ঠিক আগের বক্তা হলেন বানি ক্লার্ক, ওহাইও স্টেট ইউনিভার্সিটির প্রফেসর এই ভদ্রমহিলা প্রথম সাক্ষাতেই আমাকে খুব স্নেহের দৃষ্টিতে দেখতে শুরু করেছেন পৃথিবীর ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু থেকে বক্তৃতা দেয়ার জন্য উত্তর মেরুতে উড়ে এসেছি বলেই স্নেহ নাকি আমার মত বাদামী চামড়ার সংস্পর্শে তিনি আগে কখনো আসেননি বলেই স্নেহ বুঝতে পারছি না হয়তো তিনি সবাইকেই এরকম আন্তরিকতা দেখাতে অভ্যস্ত
            
স্টিভেনের বক্তৃতা শেষ হবার সাথে সাথে অনেকেই হাত তুলে প্রশ্ন করার সুযোগ খুঁজছে এরাই তাহলে প্রতিপক্ষ! স্টিভেন খুব সহজেই মোকাবেলা করলো তাদের তারা সম্মতি সূচক মাথা নাড়াচ্ছে দেখে মনে হচ্ছে স্টিভেনের আত্মবিশ্বাস বেড়ে যাচ্ছে সে বলছে তার পরবর্তী বক্তা তাদেরকে আরো ভালো করে বুঝিয়ে দেবে বিষয়টা মেজাজ খারাপ হয়ে যাচ্ছে স্টিভেনের ওপর আমার ওপর দায়িত্ব চাপিয়ে দেয়ার কোন মানে হয়?
            
স্টিভেনের বক্তৃতার শেষের দিকের এই অংশটি ছাড়া মূল বক্তৃতায় সে কী কী বলেছে আমি কিছুই শুনিনি মনোযোগই দিতে পারিনি তার কথায় আমার মাথায় সারাক্ষণ ঘুরপাক খাচ্ছে যদি লেজার পয়েন্টারটি ঠিকমত কাজ না করে? ওটার সুইচটি খুঁজে পাবো তো? স্ক্রিনে পয়েন্টার হিসেবে লেজার টর্চ আমি জীবনেও ব্যবহার করিনি কিন্তু সামান্য পয়েন্টার নিয়ে ভাবার কোন মানে হয় না
            
স্টিভেন বসে পড়ার সাথে সাথে উঠতে হলো আমাকে খুব একটা অসুবিধা হলো না যতটা নার্ভাস হবার জন্য প্রস্তুত ছিলাম ততোটা হইনি বলার সময় মনে হলো কয়েকজন আমি যা বলছি তাতেই সায় দিচ্ছেন প্রফেসর বানি ক্লার্ক, স্টিভেনসহ লস আলামোস ন্যাশনাল ল্যাবের কয়েকজন আর ডেবি তাদের মাথা নাড়ানো দেখে মনে হচ্ছে আমি দারুণ ভালো কোন কাজ করে ফেলেছি বেশ কিছু প্রশ্নের উত্তর দিতে হলো ইউনিভার্সিটি অব নিউ মেক্সিকোর সেই প্রফেসর প্রশ্ন করলেন নিউক্লিয়াসের সাথে নিউট্রনের সংযোগ বিষয়ে আজ যা বলছি তাতে নিউক্লিয়াসের সাথে প্রোটনের সংযোগ বিষয়েই বলেছি আমি নিউট্রন বিষয়েও কিছু কাজ করেছি বলে তাঁর প্রশ্নের উত্তর দিতে ভালোই লাগলো বেশি বেশি প্রশ্ন করেন বলে এই ভদ্রলোকের ওপর কিছুটা বিরক্ত হয়েছিলাম আমি এখন সে বিরক্তি আর নেই ভালো লাগলো খুব
            
অধিবেশন শেষে হলের করিডোরে দাঁড়িয়ে আবার অলিখিত অনির্ধারিত অধিবেশন নানারকম আলোচনা, রেফারেন্স, মতবিনিময় যার যার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত সব প্রফেসরের মধ্যে দেখলাম আমিহংস মাঝে কাক যথা’- সাদার জগতে একমাত্র বাদামি।
            
দুপুর দুটোয় ট্রিনিটি ট্যুরের বাস ছাড়বে তার আগেই লাঞ্চ সেরে আসতে হবে রুমে এসে ব্যাগ রেখে তৈরি হয়ে বেরোলাম স্টিভেন তার দু'জন গ্রিক বন্ধুর সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো চারজনে মিলে লাঞ্চে গেলাম হায়াত রিজেন্সির রেস্টুরেন্টে গ্রিকদের সাথে গ্রিক ভাষায় কথা বলছে স্টিভেন শুনতে একটু অন্যরকম লাগছে এন্থনি কুইন্স অভিনীতজোরবা দ্যা গ্রিকসিনেমার কথা মনে পড়ছে সেখানে দেখেছি গ্রিকরা কেমন হৈ চৈ করতে পারে এখন দেখছি এই তিনজনকে
            
চারজনের টেবিলে আমা ডানদিকে বসেছে রিচার্ড- কাজ করে টেক্সাস ইউনিভার্সিটিতে মুখ খুললেই কথার ফোয়ারা ছুটছে তার স্টিভেনও পাল্লা দিতে পারছে না তার সাথে সামনা সামনি বসেছে যেজন- তার নাম টনি ডাক নাম টনি হলে ভালো নাম হয় এন্থনি গ্রিকদের ক্ষেত্রেও সেরকম হয় কিনা জানি না
            
স্টিভেন যে গ্রিক বংশোদ্ভূত তা জানতাম কিন্তু সে যে গ্রিসেই জন্মেছে তা জানতাম না মেলবোর্নে পড়াশোনা তার এখন শুনছি সে নাকি অস্ট্রেলিয়ার পাশাপাশি গ্রিসেরও নাগরিক গ্রিসে সরকারী চাকরি পাবার চেষ্টাও নাকি করেছে সে কিন্তু যেহেতু বাধ্যতামূলক মিলিটারি ট্রেনিং নেয়নি তাই তার সেখানে চাকরি হবে না গ্রিসের সকল পুরুষ নাগরিককে বাধ্যতামূলক সামরিক প্রশিক্ষণ যে নিতে হয় তা আমি জানতাম না
            
খাবার বাছাই করতে গিয়ে মারাত্মক ভুল করেছি আজ জাম্বুরা সাইজের একটি টমেটোকে তিনপিস করে প্লেটের মাঝখানে বসিয়ে দিয়েছে সাথে এক স্লাইজ পিঁয়াজ ঘি দিয়ে ভেজে দিয়েছে চারপিস অ্যাস্পারাগাস (Asparagas) প্লেটের এক কোণায় পাঁচটি ছোট ছোট মাংসপিন্ড কাঁটা চামচে বিদ্ধ করে সেখান থেকে একটু মুখে দিতেই মনে হলো মাংস আগুনের সংস্পর্শে আসেনি কখনো এর তাপমাত্রা প্রায় শূন্যে কাছাকাছি খাদ্যনালীতে অভিকর্ষণ বল আর কাজ করছে না আমার সামান্য একটু ভেতরে যেতেই ভেতরে যা ছিলো তাও বেরিয়ে আসতে চাইছে অতএব আমার লাঞ্চের সমাপ্তি এখানেই।  
            
তিন গ্রিক মহানন্দে খাচ্ছে কথা বললে নাকি দ্রুত খাওয়া যায় না কিন্তু সে নিয়ম রিচার্ডের বেলায় খাটছে না মোটেও তার চোয়াল নড়ছে মেশিনের বেগে কথা বলছে আর খাচ্ছে, খাচ্ছে আর কথা বলছে মুখ থেকে কথার সাথে সাথে খাদ্য কণাও বেরিয়ে আসছে ছোট টেবিল- অন্যদের প্লেটেও রিচার্ডের মুখনিঃসৃত খাদ্যকণা ঝরে পড়ছে কিন্তু তাতে কারো কোন অসুবিধা হচ্ছে বলে মনে হলো না
            
দুটো বাজার দশ মিনিট আগেই এসে গেলাম কনভেনশান সেন্টারের ইস্ট কমপ্লেক্সের সামনে চারটি গ্রে-হাউন্ড বাস দাঁড়িয়ে আছে এখানে
            
কনফারেন্স ডেলিগেটদের জন্য স্পেশাল ট্যুর এটা পেশাদার ট্যুর কোম্পানি এর ব্যবস্থাপনার দায়িত্ব নিয়েছে ফলে এখানে কারো কোন ভাবনা নেই সব চুপচাপ হয়ে যাচ্ছে আস্তে আস্তে এর মধ্যেই বিশাল বিশাল ট্রাক এসে গেছে কনভেনশান সেন্টারের সামনে চেয়ার টেবিল গুটানো শুরু হয়ে গেছে
            
স্টিভেন আর আমার বাস আলাদা ফিরে আসার সময় আমাদের বাস ডিনারের জন্য থামবে, তাদেরটি থামবে না স্টিভেন আমার কাছ থেকে বিদায় নিলো যদি আর দেখা না হয়তাহলে এখানেই আপাতত শেষ দেখা যে যার বাসে উঠে পড়লাম।

_______________




No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts