Monday, 4 February 2019

প্রথম দেখা আমেরিকা - পঞ্চম পর্ব




আলবুকারকি: প্রথম দিন

আমেরিকানরা কি আরাম যা করার তা বাথরুমেই সেরে নেয়? নইলে বাথরুম এত বড় কেন? আর কেনই বা বাথরুমে এত সাজসজ্জা? বাতি জ্বালালেই চোখ ঝলসে দেয়া আলো দেয়াল জুড়ে বিশাল আয়না মানুষ নিজের চেহারা দেখতে ভালোবাসে, কিন্তু শুধু তার জন্যই এতো? বেসিনের পাশে ঝকঝকে কাচের গ্লাস, কফি মেশিন, কফি মগ একপাশে বাথটাব হলিউডে সিনেমায় দেখা যায় অনেকে বাথটাবের পানিতে সারা শরীর ডুবিয়ে রেখে কফি খায় অনেকে আবার ওই অবস্থায় বই পড়ে তাতে কফির স্বাদ বা বই পড়ার আনন্দ বেড়ে যায় কিনা পরীক্ষা করে দেখার এখনই সুযোগ
            
কফির বয়ামে কালো কফি দেখা যাচ্ছে কিন্তু বানাবো কীভাবে? কফি বানানোর ঝামেলা তো কম নয় ক্যাফে লা-তে, ক্যাপাচিনো ইত্যাদি অনেক নামের অনেক প্রকার কফি আছে কার্যত দেখা যাচ্ছে আমি কোন প্রকার কফিই বানাতে জানি না কাপে এক চামচ কফি দিয়ে গরম পানি ঢেলে দিলে যা হবে তাকেই ব্ল্যাক কফি হিসেবে চালিয়ে দেয়া যেতে পারে কিন্তু সেরকম এলেবেলে কফি নিশ্চয় এই মহার্ঘ বাথটাবে ডুবে ডুবে খাওয়া যাবে না রাজকীয় হোটেলের বাথটাবের একটা ন্যূনতম মর্যাদা তো আছে
            
বাথটাবে পানি ভর্তি করতে গিয়ে বুঝতে পারলাম কিঞ্চিৎ ঝামেলা আছে ট্যাপের ঘাড় ধরে মোচড় দিলেই পানি পড়ার কথা কিন্তু সে নিয়ম কাজ করছে না এখানে লাল নীল দুটো ট্যাপই দেখা যাচ্ছে, কিন্তু গরম বা ঠান্ডা কোন পানিই বেরোচ্ছে না পানি সাপ্লাই বন্ধ হয়ে গেছে তো বলা যাবে না কারণ এখানে তো আর বাংলাদেশেরওয়াসাপানি সাপ্লাইয়ের দায়িত্ব নেয়নি
            
ইঞ্চি ছয়েক লম্বা চিকন একটা রডের মত দেখা যাচ্ছে ট্যাপের নিচে ওটাতে চাপ দিতেই তা দেয়ালে ঢুকে গেলো আর শাওয়ার থেকে প্রচন্ড ঠান্ডা পানি এসে এক নিমিষেই ভিজিয়ে দিলো আমাকে
            
মেজাজ খারাপ হয়ে গেলো আমার স্বভাবের ওপর রাগ হচ্ছে এখন স্টিভেন গতকাল জ্ঞিজ্ঞেস করেছিলো বাথটাবের কলকব্জা দেখিয়ে দেবে কিনা স্বভাবগত লজ্জার কারণে বলেছি,  "না, লাগবে না"
            
আসলে লজ্জা, নাকি ইগো? কোন কিছু শিখতেও লজ্জা পাই! এই বাজে স্বভাবের জন্য পাঁচ মিনিটের জায়গায় অনেক সময় পাঁচ ঘন্টা লাগে আমার কোন কিছু ঠিকমত বুঝতে তবু না বুঝেওহ্যাঁসূচক মাথা নাড়ানো, না পারলেওপারবোবলে বেকায়দায় পড়ার স্বভাব আমার যাচ্ছে না কিছুতেই
            
কোন রকমে শাওয়ার বন্ধ করলাম এটা ওটা নেড়ে চেড়ে ট্যাপে ঠান্ডা গরম দুরকম পানিই পাচ্ছি কিন্তু বাথটাবের তলার ছিদ্রটা বন্ধ করবো কীভাবে? সব পানি তো বেরিয়ে যাচ্ছে ছিদ্র দিয়ে আশে পাশে কোথাও ছিপি বা জাতীয় কিছু দেখছি না যেটা দিয়ে পানি আটকাবো অবস্থা দেখে মনে হচ্ছে স্কুলের পাটিগণিতে চৌবাচ্চার পানির যে অংক করেছিলাম তা এখানে কাজে লাগবে বলেই শেখানো হয়েছিলো প্রথম দ্বিতীয় নল দিয়ে বাথটাবে পানি প্রবেশ করবে আর তলার ছিদ্র দিয়ে তা বেরোতে থাকবে এভাবে কতক্ষণে বাথটাবটি পানিতে ভর্তি হবে? বেশ প্র্যাকটিকেল প্রবলেম বাথটাবের গায়ে বোতামের মত ছোট্ট একটা গুঁটি দেখা যাচ্ছে ওটাতে সামান্য চাপ দিতেই বাথটাবের তলার ছিদ্র বন্ধ হলো
            
এখানে যারা আসে সবাই কি আমার মত এত গ্যাঞ্জাম করেই বাথরুম সারে? আসলে তা মনে হয় না আমেরিকানদের ঘরে ঘরে এরকম বাথটাবের আয়োজন আছে হয়তো আর যদি না থাকে, তাহলে হয়তো তারা হোটেলের বেয়ারা ডাকবে উর্দি পরা বেয়ারা এসে সব ঠিকঠাক করে দেবে বাথটাবে পানি ভর্তি করে বলবে- ‘স্যার, ইওর বাথরুম ইজ রেডি তার পর যতক্ষণ টিপ না দেয় ততক্ষণ বেয়াড়ার মত দাঁড়িয়ে থাকবে
            
এত আয়োজন করে যে বাথটাব ভর্তি করলাম সেখানে শরীর ডুবিয়ে রেখে তেমন কোন আলাদা সুখ পেলাম না নাকি সুখ পেতেও শিতে হয়, জানতে হয়! যেমন আমার এক সুরা-রসিক বন্ধু বলে, “বোতলের সুখ বোতল মুখে দিলেই আসে না রে, তার জন্য সাধনা করতে হয়
            
ছোটবড় বারোটি তোয়ালে বাথরুমে একজন মানুষের জন্য বারোটি তোয়ালে লাগে? ঝকঝকে সাদা তোয়ালে, নরম তুলতুলে তোয়ালে গায়ের সাথে লেগে থাকে নরম পালকের মত এই তোয়ালেগুলো কোন কোনটা মাঝে মাঝে লোকজনের ব্যাগে করে হোটেলের বাইরে চলে গেলে খুব একটা দোষ দেয়া যায় না তাদের ভালো জিনিসের লোভ সামলানো সহজ নাকি? তবে এখন নাকি হোটেলের তোয়ালেতে মাইক্রোচিপ্‌স লাগানো থাকে যেন তোয়ালের গতিবিধি নজরে রাখা যায়।
            
সকালের নরম সোনালী আলোয় জেগে উঠেছে আলবুকারকি শহর জানালা ঘেঁষে দাঁড়াতেই চোখ গেলো নিচের সুইমিং পুলের দিকে পরিষ্কার নীল আকাশের প্রতিফলন পুলের স্বচ্ছ পানিতে
            
ঘড়িতে বাজে সাতটা সকাল বাংলাদেশে এখন রাত একটা টেলিফোন করা দরকার এখানে পৌঁছানোর সংবাদটা না পেলে তাদের চিন্তা যাবে না আমাকে নিয়ে আমার ভাইবোনদের দুশ্চিন্তা যায় না কখনো টেলিফোন না করলে হয়তো সারা রাত ঘুমাতেই পারবে না তারা।
          
রুমে মোট চারটি টেলিফোন সেট দুই বেডসাইড টেবিলে দুটো, রিডিং টেবিলে একটি আর বাথরুমে একটি রিডিং টেবিলের সেটটার নিচে রাখা আছে হোটেল রুম থেকে টেলিফোন করার নিয়ম কানুন বিভিন্ন রকম কলের বিভিন্ন রকম রেট আমেরিকা নিজেকে যতই ফ্রি ফ্রি বলে চিৎকার চেঁচামেচি করুক না কেন, এখানে কোন কিছুই ফ্রিতে পাওয়া যায় না হোটেল থেকে ইন্টারন্যাশনাল কলের যে চার্জ, সে চার্জ জমা করলে প্লেনের টিকেট কেনা যাবে আমার সাথে ফোন-কার্ড আছে, কিন্তু হোটেল থেকে ফোন কার্ডে কথা বললেও প্রতি মিনিটে একডলার করে দিতে হবে মনে হচ্ছে টেলিফোনে হাত দিলেই একটা গরম ছ্যাঁকা লাগবে





            
রাস্তায় বেরিয়ে এলাম এদিক ওদিক তাকাতে তাকাতে পাবলিক টেলিফোন খুঁজছি ফুটপাত ধরে অনেকক্ষণ পর্যন্ত হাঁটার পরেও কোন স্ট্রিট টেলিফোন বুথ চোখে পড়লো না এমন তো হবার কথা নয় আমেরিকাতে প্রতি তেরো জন মানুষের জন্য দশটা টেলিফোন সেট আছে এখানে তো টেলিফোনের অভাব হবার প্রশ্নই ওঠে না একটু পরেই বুঝতে পারলাম সমস্যাটা কোথায় এখন রাস্তার ধারে একশ' মিটারের মধ্যেই অনেকগুলো ফোন বুথ দেখতে পাচ্ছি অস্ট্রেলিয়ায় যেমন সুন্দর করে কাচের ঘর তৈরি করা থাকে, আমার চোখ সেরকম কিছু খুঁজছিলো এতক্ষণ এখানে সেরকম কোন যত্ন নেই পাবলিক টেলিফোনের যেন তেন ভাবে গাড়ির পার্কিং মিটারের মতো কোমর সমান একটা খুঁটির উপর বসিয়ে রাখা হয়েছে পাবলিক টেলিফোন সাথে একটা শিকল দিয়ে বাঁধা আছে টেলিফোন ডাইরেক্টরি সেটের ওপর কোন আচ্ছাদন নেই কথা বলতে হলো ফুটপাতে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড রোদে ঘামতে ঘামতে এর মাঝেই সূর্য এতটা তেতে উঠেছে মরুভূমির সূর্য এর চেয়ে মোলায়েম হবেই বা কীভাবে!
            
আলবুকারকি শহরটা বেশ ছড়ানো ছিটানো চারটি ভাগে ভাগ করা যায় পুরো সিটিকে মূল সিটি ডাউন টাউন, পশ্চিমে ল্ড টাউন, পূর্বে নিউ মেক্সিকো ইউনিভার্সিটি এরিয়া নিয়ে আপ টাউন ইউনিভার্সিটি এলাকায় গতকাল স্টিভেনের সাথে ঘুরে এসেছি এখন ডাউন টাউনটা হেঁটে হেঁটে ঘুরে দেখলাম
            
বেশ পরিচ্ছন্ন শহর আলবুকারকি খুব ভীড় নেই কোথাও কাজের দিনেই এমন নিস্তব্ধতা, ছুটির দিনে তো মনে হয় ঘুমন্ত পুরীর মতো লাগবে। ডাউন টাউনের রাস্তাগুলোর নাম দেখে বেশ অবাক হলাম টিহেরাসের সমান্তরাল কপার স্ট্রিট তারপর সেন্ট্রাল তার সমান্তরাল পর পর রাস্তাগুলোর নাম গোল্ড, সিলভার, লেড, কোল, আয়রন বেশ মজা লাগছে এরকম সোনা, রুপা, সীসা, কয়লা, লোহা মার্কা রাস্তা দেখে



            
দোকানপাট খুলছে আস্তে আস্তে কারো যেন কোন তাড়া নেই আমেরিকায় সবকিছু প্রচন্ড গতিতে ছুটছে- এরকম বাক্য আলবুকারকির জন্য প্রযোজ্য নয় মনে হচ্ছে আলবুকারকি একটি অলস নগরী
            
মেক্সিকোর সীমান্তবর্তী এই নিউ মেক্সিকো রাজ্যের প্রায় পুরোটাই মরুভূমি কিছু এলাকা রেড ইন্ডিয়ানদের জন্য সংরক্ষিত আমেরিকার আদিবাসী রেড ইন্ডিয়ানরা সরকারের সাথে চুক্তি অনুযায়ী তাদের সংরক্ষিত এলাকায় স্বাধীনভাবে থাকে তারা ট্যাক্সও দেয় না সরকারকে সাধারণের সাথে তাদের মেলামেশাও খুব একটা নেই অস্ট্রেলিয়ার আদিবাসীদের মতোই অবস্থা এখানকার রেড ইন্ডিয়ানদের তাদের সংস্কৃতির পোশাক, অলংকার, শিল্পকর্ম ইত্যাদি নিয়ে চুটিয়ে ব্যবসা করছে যারা তারা কেউই রেড ইন্ডিয়ান নয়

সেন্ট্রাল অ্যাভিনিউর সবচেয়ে বড় স্যুভেনির শপে ঢুকে দেখলাম রেড ইন্ডিয়ানদের জিনিসপত্র ভর্তি দোকান আশ্চর্য হয়ে খেয়াল করলাম প্রায় সবকিছুইমেড ইন চায়না চায়নিজরা হাওয়া খেতে গিয়েও নাকি ব্যবসা করে এগারোই সেপ্টেম্বর সন্ত্রাসীরা আমেরিকার টুইন টাওয়ার ধ্বংস করে ফেললো। সেই সময় শোকাভিভূত দেশপ্রেমিক আমেরিকানদের আমেরিকার পতাকা সাপ্লাই করে মিলিয়ন ডলার কামাই করলো চায়নিজরা



            
অবশ্য আলবুকারকি শহরটি আসলে রেড ইন্ডিয়ানদেরও নয়, এটি ছিলো স্প্যানিশদের স্প্যানিশরা এখানে আসে ষোড়শ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে ষোড়শ শতাব্দীর শেষের দিকে তারা ব্যবসা বাণিজ্যের খাতিরে কিছু ব্যবসাকেন্দ্র স্থাপন করে এখানে ওখানে তারই ধারাবাহিকতায় ১৭০৬ সালে এখানে গড়ে উঠে আলবুকার্‌কি শহর বর্তমান আলবুকারকির সাথে কোন মিলই ছিলো না সেদিনের আলবুকারকির
            
সেই সময় এটা ছিলো মরুভূমির মাঝে একটি চিহ্নিত জায়গা যেখানে বণিকরা মিলিত হতো ব্যবসার খাতিরে স্প্যানিশরাই জায়গার নাম রেখেছিলো আলবুর্‌কারকি (Alburquerque) প্রথমআর(r)’টি বাদ দেয়া হয়েছে অনেক পরে নাম রাখা হয়েছিলো তৎকালীন নিউ স্পেনের ভাইসরয় (Viceroy) ফ্রান্সিসকো ফার্নান্দেজ ডি লা শুভা- ডিউক অব আলবুকারকি (Francisco Fernandez de la Cueva, Duke of Alburquerque)’ নামে
            
১৮৪৬ সাল পর্যন্ত জায়গা ছিলো মেক্সিকোর অন্তর্ভূক্ত মেক্সিকানদের কিন্তু তখন আমেরিকা গায়ের জোর দেখাতে শুরু করেছে আমেরিকানদের মনে হলো তাদের আরো জায়গা দরকার মেক্সিকোর বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করলো আমেরিকা ১৮৪৮ সাল পর্যন্ত চললো যুদ্ধ মেক্সিকো পরাজিত হলো আমেরিকা এই নিউ মেক্সিকো সহ বিরাট এলাকা দখল করে নিলো
            
তারপর গৃহযুদ্ধের সময় আমেরিকানরা নিজেদের মধ্যেই অনেক রক্ত ঝরিয়েছে এখানে আলবুকারকি মূল উন্নয়ন শুরু হয় ১৮৮০ সালের দিকে, যখন এদিকে রেল রোডের কাজ শুরু হয় তারপর বড় মাপের উন্নয়ন শুরু হয় ঐতিহাসিক ৬৬ নম্বর রোডের সাথে যুক্ত হবার পর দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় আণবিক বোমা প্রকল্পের কারণে দ্রুত উন্নয়ন ঘটে শহরের
            
ক্ষুধায় পেট চোঁ চোঁ করছে সিভিক প্লাজার সাবওয়েতে ঢুকলাম সাবওয়ের বার্গার নাকি পৃথিবী বিখ্যাত বিজ্ঞাপনে দেখা যায় জন প্রচন্ড মোটা লোক এদের বার্গার খেয়ে ছয় মাসে ২২ কেজি ওজন কমিয়ে ফেলেছে ম্যাকডোনাল্ড বা হাংরি জ্যাকসের মতো বার্গার তৈরি করা থাকে না এখানে অর্ডার দেয়ার পরে বানিয়ে দেয় অর্ডার দেয়াটা যে এখানে একটা বিদঘুটে রকমের শক্ত কাজ তা বুঝতে পারলাম র্ডা দিতে গিয়ে যে বস্তুগুলোর নাম লেখা আছে তার মধ্যে চিকেন শব্দটা ছাড়া বাকিগুলোর একটাও চিনি না আমি সুতরাং আন্দাজে ঢিল ছুঁড়ে যে বস্তু হাতে পেলাম তার গন্ধে পাকস্থলী ল্টে বেরিয়ে আসার জোগাড় আর পানীয়! ক্লোরিনের তীব্র গন্ধ এবার বুঝতে পারছি বিজ্ঞাপনের লোকটা কেন ২২ কেজি ওজন হারাতে বাধ্য হয়েছে কেনা বার্গার ফেলে দিতে হলে ওজন তো কমবেই।
            
আলবুকারকির আকাশ ঝকঝকে নীল মরুভূমির আকাশ হয়তো এরকমই হয় সূর্য পূর্ণপ্রতাপে বীরত্ব জাহির করছে শহরের নাম প্রথম পড়েছিলাম রিচার্ড ফাইনম্যানের লেখায় (Richard Feynman, জন্ম: নিউইয়র্ক, ১১ মে ১৯১৮, মৃত্যু: ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৮৮, পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার: ১৯৬৩) ফাইনম্যানের প্রথম স্ত্রী আরলিন এই শহরের একটা হাসপাতালে কাটিয়েছেন তাঁর জীবনের শেষ দুটো বছর      


      

হাসপাতালটি খুঁজে পেতে দেরি হলো না পঞ্চান্ন বছরে অনেক কিছুই বদলে গেছে নিশ্চয় কিন্তু আমার মনে হচ্ছে এই ৬৬ নম্বর রোডের পাশেই ফাইনম্যান চুলা জ্বালিয়ে মাংস ভেজেছেন আরলিনের অনুরোধে এখানেই কোন একটা গাছের নিচে ঝরা পাতায় শুয়ে রাত কাটিয়েছেন ফাইনম্যান সান্টা ফে থেকে আসতে দেরি হয়ে গিয়েছিলো বলে
            
অনেকদূর পর্যন্ত হাঁটলাম এখানের পাবলিক বাসগুলো দেখতে কেমন যেন লক্কর ঝক্কর মনে হচ্ছে আমেরিকার বাস বলে মনেই হয় না আমেরিকা সম্পর্কে শোনা আর নিজের চোখে দেখার মধ্যে মিলছে না বলেই রকম মনে হচ্ছে জানি না
            
রাস্তা পার হতে খুব সমস্যা হচ্ছে আমার আমার অভ্যস্ত চোখ যেদিকে তাকিয়ে গাড়ি দেখেএখানে গাড়ি আসে অন্যদিক থেকে
            রাস্তার পাশে বিশাল বিলবোর্ড দেখা যাচ্ছেবব ফিস অ্যান্ড চিপস”- ববের মাছ ভাজা দোকান রোড ৬৬ থেকেই শুরু হয়েছে পার্কিং এরিয়া ববের দোকানটা এই পার্কিং এরিয়া পেরিয়ে অনেক ভেতরে কাছে গিয়ে দেখলাম এলাহি কারবার মাছ ভাজার দোকান বলতে আমার ধারণা হয়েছিলো বাংলাদেশে রাস্তার পাশে কেরোসিনের চুলায় পিঁয়াজি ভেজে বিক্রি করার মতো কিছু একটা হবে কিন্তু যে রীতিমত ইন্ডাস্ট্রি
            
প্রায় খানেক লোক বসার মত একটা ওয়েটিং এরিয়া সারি সারি বেঞ্চ আর টেবিল পাতা সেখানে বিশাল স্বচ্ছ প্লাস্টিকের তাবু টাঙানো আছে জায়গাটাকে ঘিরে লাইটপোস্টের সাথে ছোট ছোট মাইক লাগানো লোকজন বসে আছে হাতে নীল রঙের টিকেট নিয়ে মূল দোকানের সামনে লম্বা লাইন
            
লাইনে দাঁড়িয়ে সবার দেখাদেখি পড়ে দেখছি ববের মেনু অনেক রকম মাছ পাওয়া যায় এখানে এই মাছগুলোর নাম আগে কখনো শুনিনি সুতরাং নাম দেখার বদলে দাম দেখতে শুরু করলাম সবচেয়ে সহজ কাজ হলো সামর্থ্য অনুযায়ী অর্ডার দেয়া
            
কাচের কাউন্টারে ওপাশে মোটা স্প্যানিশ মহিলা মাছ আর আলুভাজির অর্ডার দেবার কাজটাও দেখা যাচ্ছে খুব একটা সহজ নয় এখানে কোন ধরনের আলু? চাকা চাকা করে কাটা আলু নাকি ফালি ফালি করে কাটা? ভাজিতে নুন দেবে- নাকি নুন ছাড়া? কোন্‌ ধরনের কেচাপ পছন্দ করো? পলিথিন ব্যাগ দেবো নাকি ব্রাউন ব্যাগ দেবো?
            
মনে হচ্ছে আমেরিকার সবকিছুই খুব সুনির্দিষ্ট হতে হয় এখানে যা বায়ান্ন তা বায়ান্নই দাম রেখে নীল টিকেট ধরিয়ে দিলো টিকেট নিয়ে বসলাম ওয়েটিং এরিয়ায়
            
মাইকে এক একটা নম্বর ধরে ডাকা হচ্ছে আর সে নম্বরের টিকেটধারী তাদের অর্ডার সংগ্রহ করছে অন্য একটা কাউন্টার থেকে অর্ডার দেবার পরেই মাছ ভাজা হয় তাই অপেক্ষা করতে হচ্ছে বেশিক্ষণ অপেক্ষা করতে হলো না আমাকে মাছ আর আলুভাজি নিয়ে ফিরে এলাম হোটেলে
            
দৈনিক আড়াই শ' ডলারের হোটেলে সাড়ে চার ডলারের লাঞ্চ একটু বেমানান কিন্তু তাতে কী? মানানসই কিছু আনার জন্য টেলিফোনে অর্ডার দিলে হয়তো দেখা যাবে এই বব এন্ড কোং- সাপ্লাই দেবে এখানে, আর দাম নেবে চল্লিশ ডলার প্লাস ট্যাক্স
            
জেট-ল্যাগ কাটেনি এখনো নিউ মেক্সিকোর এই মধ্যদুপুরে আমার বায়োলজিক্যাল ক্লকে গভীর রাত ঘুমে দু'চোখ জড়িয়ে আসছে





No comments:

Post a Comment

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts