Saturday, 4 January 2025

তাহার নামটি অঞ্জনা

 


তখন সবে ক্লাস নাইনের বার্ষিক পরীক্ষা দিয়েছি। বাড়িতে যান্ত্রিক বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম ছিল একটি এক ব্যান্ড ফিলিপস রেডিও। ছুটির দিনের দুপুর কাটতো সেই রেডিওতে কান লাগিয়ে বিজ্ঞাপন তরঙ্গ শুনতে শুনতে। সেই সময় সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কিংবা সহসা মুক্তি পাবে এরকম সিনেমাগুলির উপর বিশেষ অনুষ্ঠান প্রচারিত হতো। সেই অনুষ্ঠানগুলি ছিল আমার খুবই প্রিয়। বৌরানি সিনেমা তখন সদ্য মুক্তি পেয়েছে। বিজ্ঞাপনে প্রচারিত সেই সিনেমার অনুষ্ঠান শুনতে শুনতে সবকিছু মুখস্থ করে ফেলেছি। রাজ্জাক, বুলবুল আহমেদ, শাবানা, অঞ্জনা, গোলাম মোস্তফা – সবার যে ক’টা সংলাপ বিজ্ঞাপনে উচ্চারিত হয়েছে সেগুলি সব মুখস্ত হয়ে গেছে। ইত্তেফাক পত্রিকায় তখন সিনেমার অনেক বিজ্ঞাপন ছাপানো হতো। সেগুলি দেখতে দেখতে অনেক নায়ক নায়িকা চিনে ফেলেছিলাম। অঞ্জনার চেহারাও আমার চেনা হয়ে গেছে ততদিনে।  

বার্ষিক পরীক্ষার পর একবার শহরে যাবার সুযোগ হয়। অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছি কখন বাবা শহরে নিয়ে যাবেন। অবশেষে সেই সুযোগ এলো। তবে সরাসরি শহরে নয়। শহরের আগে এক রাত পটিয়ায় থাকতে হলো। আমার বড়ভাই তখন পটিয়া কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার জন্য ভর্তি হয়েছে। কলেজের হোস্টেলে থাকে। আমি প্রথমবারের মতো গেলাম তার হোস্টেলে। আগের সপ্তাহে সে শহরে গিয়ে বৌরানি সিনেমা দেখে এসেছে। এজন্যও খুব ঈর্ষা হলো আমার।  

পরদিন ভোরে উঠেই ট্রেন ধরে শহরে। বাবার কাজকর্ম অনেক। তাঁর সাথে আন্দরকিল্লার বইয়ের দোকান থেকে কোর্টবিল্ডিং, বাংলাদেশ ব্যাংক – সবকিছু ঘুরতে ঘুরতে আমি অধৈর্য হয়ে পড়ছিলাম কখন সিনেমা হলে ঢুকবো। আমার বাবার প্রিয় সিনেমা হল ছিল সিনেমাপ্যালেস এবং খুরশিদ মহল। লালদিঘীর কাছাকাছিই তাঁর স্বাচ্ছন্দ্যের এলাকা। আগের সপ্তাহে তিনি দাদাকে এই সিনেমা দেখিয়েছেন সিনেমাপ্যালেসে। কিন্তু এসপ্তাহে বৌরানির বদলে অন্য একটি সিনেমা চলছে সেখানে। যে কোনো সিনেমাই আকর্ষণীয়, কিন্তু আমাকে দেখতে হবে বৌরানি। সিনেমাটি আমার বাবারও এত ভালো লেগেছে যে আমাকে সাথে নিয়ে আবার দেখবেন তিনিও। 

স্টেশন রোডে নুপুর সিনেমা তখন চট্টগ্রামের অভিজাত সিনেমা হলগুলির একটি। জীবনের প্রথমবারের মতো ঢুকলাম সেখানে এবং মগ্ন হয়ে দেখলাম – বৌরানি। অঞ্জনা অভিনীত ওটাই আমার দেখা প্রথম সিনেমা। 





রাজ্জাকের বিপরীতে অঞ্জনা, আর বুলবুল আহমেদের বিপরীতে শাবানা। রাজ্জাক গ্রাম থেকে শহরে পড়তে আসে। কলেজের প্রিন্সিপাল শওকত আকবর তার চাচার বন্ধু। তাই প্রিন্সিপালের বাসায় তার থাকার জায়গা হয়। প্রিন্সিপালের মেয়ে অঞ্জনা। বাসায় কলেজে পড়ুয়া মেয়ে আছে বলে জোয়ান কোন ছেলেকে বাসায় থাকতে দেবেন না অঞ্জনার মা। তাই প্রিন্সিপাল রাজ্জাককে বিবাহিত হিসেবে পরিচয় দেন। এ নিয়ে নানারকম মজার ঘটনা ঘটতে থাকে। নেচে নেচে গান করা, প্রেম করা, অভিমান করা ছাড়া অঞ্জনার আর তেমন বিশেষ কিছু করার ছিল না সিনেমায়, তবুও ঐটুকুতেই আমার তাকে শাবানার চেয়েও বড় অভিনেত্রী বলে মনে হলো। 

কয়েক মাস পরেই আমার আরো অনেক সিনেমা দেখার সুযোগ এসে গেল। অঞ্জনা অভিনীত পরের সিনেমা যেটা দেখলাম সেটা হলো ‘সুখের সংসার’। নারায়ণ ঘোষ মিতা পরিচালিত ভীষণ মেলোড্রামাটিক সিনেমা। তখন আমি সবেমাত্র বাঁশখালির অজপাড়া থেকে মহকুমা শহর পটিয়ায় এসে সেখানকার মডেল হাইস্কুলে ক্লাস টেনে ভর্তি হয়েছি। থাকি বড়ভাইয়ের হোস্টেলে। পটিয়াতে একটি সিনেমা হল আছে – শুধুমাত্র এই কারণেই পটিয়াকে নির্দ্বিধায় শহর বলে মেনে নিয়েছি। হাতে কোনরকমে পাঁচ টাকা জমলেই তৃতীয় শ্রেণির টিকেট কেটে সিনেমা হলে ঢুকে পড়া যেতো। শুধুমাত্র পুরনো সিনেমাগুলিই সেই হলে মুক্তি পেতো – তাতে আমার কোনো সমস্যা ছিল না। কারণ আগে না দেখা যেকোনো সিনেমাই আমার কাছে নতুন এবং আকর্ষণীয়। সেই সময় আমি যে মনযোগ দিয়ে সিনেমা দেখতাম – অত মনযোগ দিয়ে লেখাপড়া করলে জীবনটা অন্যরকম হতো। সিনেমার প্রত্যেকটি সংলাপ, গান, এমনকি আবহসঙ্গীত পর্যন্ত আমার মুখস্থ হয়ে যেতো। শুধুমাত্র নায়ক-নায়িকা নয়, সিনেমার ছোট-বড় সব চরিত্রই মনে গেঁথে যেতো নাটকীয় সংলাপের কারণে। এখন যেসব সংলাপকে অতিনাটকীয় বলে মনে হয়, সেই সময় সেইসব সংলাপসর্বস্ব চরিত্রগুলোকেই আমার কাছে ভীষণ আকর্ষণীয় মনে হতো। 

সেই সময় প্রতি সপ্তাহের শুক্রবারে একাধিক নতুন সিনেমা মুক্তি পেতো। ঢাকায় মুক্তি পাবার পরের সপ্তাহে চট্টগ্রামের সিনেমা হলে নতুন সিনেমা আসতো। পটিয়ায় সেই সিনেমা আসতো আরো কয়েক মাস পর। সুখের সংসার দেখার জন্য ততদিন অপেক্ষা করতে হয়নি। বড়ভাই তার বন্ধুদের সাথে সিনেমা দেখার জন্য শহরের বাসে ওঠার সময় নির্লজ্জভাবে একপ্রকার জোর করেই আমি বাসে উঠে গিয়েছিলাম। পটিয়া থেকে বাস আসতো তখন অনেক ঘুরে কালুরঘাটের ব্রিজ পার হয়ে। বহদ্দার হাট, মুরাদপুর পার হয়ে চকবাজারের গুলজার সিনেমার সামনে দিয়ে কলেজ রোড ধরে আন্দরকিল্লা চলে যেতো বাসগুলি। মনে আছে, গুলজার সিনেমার সামনে প্রায় চলন্ত বাস থেকে নেমে দৌড়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম সিনেমার টিকেট কাউন্টারে। 





সুখের সংসার-এর নায়ক ফারুক এমএ পরীক্ষা দিয়ে পত্রিকার হকারি করছে। বড়লোক নায়িকা রোজিনার সাথে পরিচিত হচ্ছে তাদের বাড়িতে পেপার দিতে গিয়ে ঝগড়ার মাধ্যমে। নাটকীয়তায় ভরপুর। সেখানে অঞ্জনা ছিল ফারুকের ছোট বোন। তার বিয়ে হয় বড়লোকের ছেলে প্রবীর মিত্রের সাথে। প্রবীর মিত্র সারাক্ষণ বই পড়ে। বিয়ের পর স্ত্রীর সাথে কীভাবে কথা বলবে সে বিষয়েও সে বই পড়ে জ্ঞান অর্জন করে। এত বইপড়া মানুষ এত হাবাগোবা কীভাবে হতে পারে সেই প্রশ্ন সেদিন মনেও আসেনি। আশ্চর্যের ব্যাপার হলো সেই সিনেমার অনেক সংলাপ আমার এখনও মনে আছে। অঞ্জনার অভিনয় দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে গিয়েছিলাম। অঞ্জনার অভিনয়ের প্রতি আমার মুগ্ধতা এরপর আরো যত সিনেমায় তাঁর অভিনয় দেখেছি – কোনোটাতেই কমেনি। যেকোনো চরিত্রেই অঞ্জনা তাঁর অভিনয় প্রতিভার স্বাক্ষর রাখতেন। 





প্রধান নায়িকা হিসেবেও তিনি অনেক সিনেমায় অভিনয় করেছেন। নায়করাজ রাজ্জাকের সাথেও তিনি তিরিশটির বেশি সিনেমায় নায়িকা হয়েছেন। প্রধান চরিত্রে অভিনয়ের জন্য দুবার জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন। তিনি যে তিন শ’র বেশি সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন সেই তথ্য আমার জানা ছিল না। আজ অঞ্জনার মৃত্যুসংবাদ পাবার পর আমার নিজের সেই কৈশোরের সিনেমা দেখার দিনগুলির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে। অঞ্জনা অভিনীত অনেকগুলি চরিত্রের কথাই মনে পড়ছে। তিনি খারাপ অভিনয় করেছেন এরকম কোন চরিত্র মনে পড়ছে না। বাংলাদেশের সেরা ক্ল্যাসিক নির্মাতা আলমগীর কবীর অঞ্জনাকে নিয়ে তৈরি করেছিলেন শরৎচন্দ্রের পরিণীতা। ১৯৮৬ সালে জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছেন তিনি পরিণীতায় ললিতার চরিত্রে অভিনয় করে। এর আগে ১৯৮১ সালেও তিনি জাতীয় পুরষ্কার পেয়েছিলেন ‘গাংচিল’ সিনেমায় ‘নীলা’ চরিত্রে অভিনয়ের জন্য। [অঞ্জনার মৃত্যুর খবর পেয়ে ইউটিউবে গাংচিল দেখলাম কিছুক্ষণ আগে। নীলা চরিত্রে অভিনয়ের জন্য কেন অঞ্জনাকে জাতীয় পুরষ্কার দেয়া হলো বুঝতে পারলাম না। চরিত্রটিতে বিশেষ কিছু করার ছিল না।]

বাংলাদেশের সিনেমায় যাঁরা অভিনয় করতেন সেই সময়  প্রায় প্রত্যেকেই অতিঅভিনয় করতেন। সেক্ষেত্রে আমার কাছে মনে হয়েছে অঞ্জনা ছিলেন অনেকটাই ব্যতিক্রম। তিনি যথাসম্ভব স্বাভাবিক অভিনয় করার চেষ্টা করতেন। অঞ্জনার অভিনয় প্রতিভার যথাযথ মূল্যায়ন হয়েছে কি না আমি বলতে পারছি না। কারণ আমাদের দেশের সিনেমা ইন্ডাস্ট্রিকে দীর্ঘদিন ধরে অন্যদেশের সিনেমার সাথে কোন ধরনের প্রতিযোগিতা করতে হয়নি। তারপরও ইন্ডাস্ট্রিটি ধ্বংস হয়ে গেছে। শুনেছি ২০০৮ সালের পর অঞ্জনা আর কোন সিনেমাতে অভিনয় করেননি। অভিনয় করার মতো হয়তো তেমন কোন সুযোগই ছিল না। আমাদের পরের প্রজন্মের কেউ অঞ্জনার অভিনয় দেখেছেন বলেও মনে হয় না। সুতরাং অভিনয় শিল্পী হিসেবে তিনি অমর হয়ে থাকবেন এরকম দুরাশা আমি করি না। তবে আমার মনে থাকবে তাঁর অভিনয়ের কথা। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

James Watson – an extraordinary scientist, but an intolerable racist and misogynist man

  The “Eagle” pub on the Cambridge campus has become as famous as Cambridge University itself, having witnessed hundreds of discoveries, inn...

Popular Posts