Wednesday, 20 January 2021

লাল গ্রহ মঙ্গল - পর্ব ১০

 



পঞ্চম অধ্যায়

মঙ্গলের চাঁদ

 

মঙ্গল গ্রহের চারপাশে ঘুরছে তার দুটো উপগ্রহ - ফোবোস ও ডিমোস। মঙ্গলের এই উপগ্রহ দুটোর আকৃতি আমাদের চাঁদের মত জ্যামিতিক গোলাকার নয়, অনেকটা বড় সাইজের আলুর মত। আর আকারেও আমাদের চাঁদের তুলনায় অত্যন্ত ছোট। আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী আসফ হল ১৮৭৭ সালের আগস্ট মাসে মঙ্গলের এই উপগ্রহদুটো আবিষ্কার করেছিলেন। রোমান পৌরাণিক কাহিনির যুদ্ধের দেবতা মার্সের ঘোড়ার গাড়ির ঘোড়া দুটোর নাম ছিল ফোবোস ও ডিমোস। গ্রিক পৌরাণিক কাহিনিতে ফোবোস হলো অ্যারিস (মার্স)  ও আফ্রোদিতি (ভেনাস)'র ছেলে। আসফ হল মঙ্গলের এই উপগ্রহদুটোর নাম রাখলেন ফোবোস ও ডিমোস - আতঙ্ক ও ভয়। উপগ্রহদুটো মঙ্গলের বিষুব রেখা বরাবর প্রায় বৃত্তাকার কক্ষপথে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরছে। দুটো উপগ্রহই অনুজ্জ্বল পদার্থ দিয়ে তৈরি, তাই এরা খুব একটা উজ্জ্বল নয়। এদের গঠন ও উপাদান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ভেবেছিলেন এরা আসলে উপগ্রহ নয় - এরা হয়তো অন্য কোন গ্রহের বিচ্ছিন্ন অংশ, যারা মঙ্গল গ্রহের মহাকর্ষ বলের টানে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে। কিন্তু ওরকম হলে তারা এমন বৃত্তাকার কক্ষপথে এত কাছ থেকে ঘুরতো না। পৃথিবীর চাঁদ পৃথিবী তৈরি হবার সময়েই তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মঙ্গলের চাঁদদুটো মঙ্গলের সাথে তৈরি হয়নি। হতে পারে এগুলো মঙ্গলেরই ছিটকে পড়া অংশ থেকে তৈরি হয়েছে। কোন একটা মহাজাগতিক সংঘর্ষে মঙ্গলের দুটো অংশ ছিটকে পড়েছিল। সেই অংশদুটোই মঙ্গলের মহাকর্ষ বলের ক্ষেত্রে আটকে পড়ে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে শুরু করেছে উপগ্রহের মতো।

          উপগ্রহদুটোর মধ্যে ফোবোসের আয়তন ডিমোসের চেয়ে বড়। মঙ্গলের ভূমি থেকে ফোবোসের দূরত্ব ৫,৯৮১ কিলোমিটার। ফোবোসের কক্ষপথের ব্যাসার্ধ, অর্থাৎ মঙ্গলের কেন্দ্র থেকে ফোবোসের কেন্দ্র পর্যন্ত দূরত্ব, ৯৩৭৮ কিলোমিটার। ৭ ঘন্টা ৩৯ মিনিটে মঙ্গলের চারপাশে একবার ঘুরে আসে ফোবোস। মঙ্গলের ভূমি থেকে বিষুবরেখা বরাবর তাকালে দেখা যায় ফোবোস মঙ্গলের পশ্চিম দিকে উঠে আর ৪ ঘন্টা ২০ মিনিট পর পূর্ব দিকে অস্ত যায়। তারপর ১১ ঘন্টা পর আবার উদয় হয়।

          ফোবোসের আকৃতি এবড়ো-খেবড়ো। এর গড় ব্যাস মাত্র ২২.২ কিলোমিটার এবং ক্ষেত্রফল ৬,১০০ বর্গ কিলোমিটার। এর উজ্জ্বলতা খুব কম, কারণ সূর্যের আলোর মাত্র ৭.১% প্রতিফলিত হয় এর গা থেকে। পৃথিবীর চাঁদ যেমন আলো দেয়, মঙ্গলের চাঁদ সেরকম আলো দেয় না। ফোবোসের ঘনত্ব এত কম যে এটাকে কঠিন পাথুরে উপগ্রহ বলা চলে না। ধারণা করা হচ্ছে ফোবোস গঠিত হয়েছে খুবই হালকা ধুলোর মত পদার্থ দিয়ে। এর  উপরিতলের ধুলোর আস্তরণের পুরুত্ব হতে পারে প্রায় ১০০ কিলোমিটার। কিন্তু এর মাধ্যাকর্ষণ বলের পরিমাণ প্রায় নগণ্য। এত কম মাধ্যাকর্ষণ নিয়ে এত ধুলো কীভাবে ধরে রাখছে এটা এখনো রহস্যময়।

          ফোবোসের গায়ে ৯ কিলোমিটার চওড়া বিশাল এক ক্রেটার। এই ক্রেটারের নাম স্টিকনি। ধারণা করা হচ্ছে মঙ্গল গ্রহের উপর গ্রহাণুর আঘাতের ফলে মঙ্গল গ্রহ থেকে ছিটকে আসা বড় কোন পাথরের টুকরোর আঘাতে এই ক্রেটারের সৃষ্টি হয়েছে।

          ফোবোস মঙ্গলের ভূমির এত কাছে থেকে চারপাশে ঘুরছে যে, ঘুরতে ঘুরতে এটা মঙ্গলের আরো কাছে চলে আসছে। আগামী ৮০ লক্ষ বছরের মধ্যে ফোবোস মঙ্গলের ভূমির মাত্র ৭,১০০ কিলোমিটারের মধ্যে চলে আসবে। এই দূরত্ব হলো ফোবোসের রোশ লিমিট (Roche Limit)। ফরাসি জ্যোতির্বিজ্ঞানী এডুয়ার্ড রোশ ১৮৪৮ সালে হিসেব করে দেখিয়েছিলেন কোন গ্রহের উপগ্রহ যদি একটা নির্দিষ্ট দূরত্বের চেয়ে গ্রহটির কাছে চলে আসে, তখন গ্রহটির মাধ্যাকর্ষণ বলের প্রভাবে উপগ্রহটি ভেঙে যায়। তারপর সেই ভাঙা টুকরোগুলো গ্রহটির চারপাশে একটি বৃত্ত তৈরি করে ঘুরতে থাকে। ফোবোসও ভেঙে গিয়ে মঙ্গলের চারপাশে ঘুরতে থাকবে।

 

চিত্র: ফোবোসের ক্রেটার - স্টিকনি

         

ফোবোসের তুলনায় অনেক ছোট উপগ্রহ ডিমোস। মঙ্গল থেকে ২৩,৪৫৯ কিলোমিটার দূরে থেকে ৩০ ঘন্টা ১৮ মিনিটে মঙ্গলের চারপাশে একবার ঘুরে আসে ডিমোস। ফোবোস যেমন ক্রমশ মঙ্গলের কাছে চলে আসছে, ডিমোস আস্তে আস্তে মঙ্গল থেকে দূরে চলে যাচ্ছে। মঙ্গলের বিষুব রেখা থেকে দেখলে ডিমোস মঙ্গলের আকাশে পূর্ব দিকে উঠে, আর ৬০ ঘন্টা পর পশ্চিম দিকে অস্ত যায়।

          ডিমোসের আকৃতিও এবড়ো-খেবড়ো। এর আকার ১৫ কিমি x ১২.২ কিমি x ১০.৪ কিমি, মোট ক্ষেত্রফল মাত্র ১৪০০ বর্গ কিলোমিটার। ডিমোসের গায়েও ক্রেটারের চিহ্ন আছে, তবে ফোবোসের মত অত বড় নয়। ডিমোসের ক্রেটারগুলোর ব্যাস ২.৫ কিলোমিটারের কম।

 

সারণি: ফোবোস ও ডিমোসের ভৌত উপাত্ত

উপাত্ত

ফোবোস

ডিমোস

কক্ষপথের ব্যাসার্ধ

৯,৩৭৮ কিমি

২৩,৪৫৯ কিমি

কক্ষপথে একবার ঘুরতে সময় লাগে

৭ ঘন্টা ৩৯ মিনিট

৩০ ঘন্টা ১৮ মিনিট

কক্ষপথের নতি

.০৮ ডিগ্রি

.৭৯ ডিগ্রি

কক্ষপথের উৎকেন্দ্রিকতা

.০১৫১

.০০০৫

গড় আকার

২৬.৮ কিমি x ২২.৪ কিমি x ১৮.৪ কিমি

১৫ কিমি x ১২.২ কিমি x ১০.৪ কিমি

ভর

১০৬ কোটি কোটি কিলোগ্রাম

২৪ কোটি কোটি কিলোগ্রাম

গড় ঘনত্ব

১৯০০ কেজি/ঘন মিটার

.৯ গ্রাম/সিসি

১৭৫০ কেজি/ঘন মিটার

.৭৫ গ্রাম/সিসি

ক্ষেত্রফল

৬,১০০ বর্গ কিমি

১,৪০০ বর্গ কিমি

 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts