Friday, 7 June 2024

হেনড্রিক লরেন্টজ: আইনস্টাইনের গুরু




প্রফেসর হেনড্রিক লরেন্টজ সম্পর্কে বলতে গিয়ে আইনস্টাইন দ্বিধাহীনভাবে বলেছেন, “He meant more to me personally than anybody else I have met in my lifetime” – “ব্যক্তিগতভাবে আমি জীবনে যত মানুষের সংস্পর্শে এসেছি তাদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তিনি।“ আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার তত্ত্ব আবিষ্কৃত হয়েছে লরেন্টজ-এর গবেষণার ফসল থেকে। পদার্থের পারমাণবিক তত্ত্বের জন্য বিখ্যাত ছিলেন হেনড্রিক অ্যান্টুন লরেন্টজ। ১৯০২ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি এবং তাঁর ছাত্র পিটার জিম্যান। 

১৮৫৩ সালের ১৮ জুলাই নেদারল্যান্ডের আর্নহেমে জন্ম হয় হেনড্রিক লরেন্টজের। তাঁর বাবা ছিলেন গেরিট ফ্রেদেরিক, মা গিরট্রুইডা। চার বছর বয়সে লরেন্টজ মাতৃহারা হন। তাঁর বাবা আবার বিয়ে করেন লুবার্টা হুপকিসকে। মাতৃস্নেহ বঞ্চিত লরেন্টজ একেবারে শৈশব থেকেই লেখাপড়ার মধ্যে বড় হন।

লেখাপড়ার ব্যাপারে খুবই সিরিয়াস ছিলেন লরেন্টজের বাবা। ছোটবেলাতেই একটি কঠোর নিয়মকানুনসমৃদ্ধ স্কুলে ভর্তি করে দেন তাকে। ওখান থেকে ১৮৬৬ সালে হাইস্কুলের বেশ এডভান্সড কোর্সে ভর্তি হয়ে যান অনায়াসে। ১৮৭০ সালে লিডেন ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হন এবং দুবছরের মধ্যে গণিত ও পদার্থবিজ্ঞানে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন। ১৮৭২ সালে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করার পর আর্নহেমের একটি নৈশবিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। শিক্ষকতার পাশাপাশি তিনি আলোর প্রতিফলন ও প্রতিসরণ সম্পর্কিত পিএইচডি গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। 

১৮৭৫ সালে মাত্র বাইশ বছর বয়সে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেন হেনড্রিক লরেন্টজ। এরপর যোগ দেন লিডেন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টে। কয়েক বছরের মধ্যেই তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান-এর প্রধান অধ্যাপকে উন্নীত হন। নেদারল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলিতে এর আগে কোন তত্ত্বীয় অধ্যাপকের পদ ছিলো না। পদার্থবিজ্ঞানের আলাদা শাখা হিসেবে তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞান তখন সবেমাত্র যাত্রা শুরু করেছে। সে হিসেবে বলা যায় হেনড্রিক লরেন্টজ ছিলেন নেদারল্যান্ডের তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানের প্রথম অধ্যাপক। পরবর্তীতে ইওরোপের অনেকগুলি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অধ্যাপনার লোভনীয় প্রস্তাব পাওয়া সত্ত্বেও তিনি অন্য কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দেননি। সারাজীবন লিডেন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনা করেই কাটিয়ে দিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর গ্রহণ করার পরেও তিনি তাঁর সোমবার সকালের লেকচার চালিয়ে গিয়েছেন। এই লেকচার ক্লাসে অংশ নিয়েছিলেন আলবার্ট আইনস্টাইন। 

লিডেন ইউনিভার্সিটিতে আইনস্টাইন তাঁর বন্ধু পল ইরেনফেস্টের কাছে যেতেন। তখন প্রতি সোমবার প্রফেসর লরেন্টজ যে পদার্থবিজ্ঞানের সাম্প্রতিক আবিষ্কার ও গবেষণার অগ্রগতি সম্পর্কে যে লেকচার দিতেন – আইনস্টাইন সেখানে যোগ দিতেন। সেখান থেকে আইনস্টাইন তাঁর নিজের গবেষণার অনেক খোরাক পেয়েছেন। 

শুরুতে ম্যাক্সওয়েলের তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের উপর কাজ করছিলেন লরেন্টজ। বিশেষ করে বিদ্যুৎ ও আলোর সম্পর্কের নীতিগুলি নিয়ে। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্বের মাধ্যমে তিনি তাঁর পিএইচডি থিসিসে আলোর প্রতিসরণ ও প্রতিফলনের নীতিগুলির নতুন ব্যাখ্যা দেন। আলোর বেগ এবং যে মাধ্যমে আলো চলাচল করে সেই মাধ্যমের ঘনত্ব ও উপাদানের মধ্যে সম্পর্ক স্থাপন করেন লরেন্টজ। 

প্রায় একই সময়ে ডেনমার্কের পদার্থবিজ্ঞানী লুডভিগ লরেঞ্জও আলোর বেগের সাথে আলোর মাধ্যমের প্রতিসরণাঙ্কের একই ধরনের গাণিতিক সম্পর্ক আবিষ্কার করেন। হেনড্রিক লরেন্টজ আর লুডভিগ লরেঞ্জের নাম অনুসারে এই সমীকরণের নাম হয় লরেন্টজ-লরেঞ্জ সমীকরণ। এই সমীকরণ অনুসারে আলোক মাধ্যম বৈদ্যুতিক চার্জযুক্ত অসংখ্য কণার সমষ্টি – যে কণাগুলি সবসময় ঢেউয়ের মতো দুলছে। মাধ্যমের ভেতর দিয়ে আলোর চলাচলের সময় এই কণাগুলির সাথে আলোর তরঙ্গের মিথষ্ক্রিয়া ঘটে। এখন আমরা সবাই আলোর কণাতত্ত্ব সম্পর্কে জানি। কিন্তু সেই ১৮৭৯-৮০ সালে পরমাণু এবং তার উপাদান – ইলেকট্রন, প্রোটন-নিউট্রন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কোন ধারণাই ছিল না বিজ্ঞানীদের। 

১৮৮১ সালে লরেন্টজ একাডেমি অব ফাইন আর্টস এর প্রফেসর ইওহান কাইজারের মেয়ে আলেত্তাকে বিয়ে করেন। হেনড্রিক ও আলেত্তা লরেন্টজ-এর দুই মেয়ে এবং দুই ছেলে হয়। তাঁদের বড় মেয়ে গিরট্রুইডা পরবর্তীতে বাবার মতোই পদার্থবিজ্ঞানী হন। 

ম্যাক্সওয়েলের সূত্র থেকে লরেন্টজের যে সমীকরণের সূত্রপাত হয়েছে, সেখান থেকেই দানা বেঁধেছে ইলেকট্রনের তত্ত্ব। ১৮৯২ সালে লরেন্টজ তাঁর তাত্ত্বিক গবেষণা থেকে উদ্ভূত প্রস্তাব করেন যেকোনো পদার্থের মধ্যেই ধনাত্মক কিংবা ঋণাত্মক চার্জযুক্ত ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণা আছে। লরেন্টজ তাত্ত্বিকভাবে প্রমাণ করেন যে এসব চার্জিত কণার কম্পনের ফলে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের উৎপত্তি হয়। ম্যাক্সওয়েল তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের সূত্র দিয়েছিলেন ১৮৫০ থেকে ১৮৭০ সালের মধ্যে। লরেন্টজ যেসময় তাঁর ইলেকট্রনের তত্ত্ব প্রতিষ্ঠা করছিলেন, সেই সময়েই ১৮৮৮ সালে হেনরিখ হার্টজ পরীক্ষাগারে তড়িতচুম্বক তরঙ্গ উৎপন্ন করতে সক্ষম হন। 

লরেন্টজ-এর সমসাময়িক বিজ্ঞানীরা বিশ্বাস করতেন যে বাতাসে ইথার নামে এক ধরনের স্বচ্ছ পাতলা অদৃশ্য বস্তু আছে। অনেক বিজ্ঞানী বাতাসে ইথারের বেগ নির্ণয় করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছেন। ফলে অনেকে বিশ্বাস করতেন যে ইথার স্থির – বাতাসে তাদের বেগ শূন্য। লরেন্টজও শুরুতে বিশ্বাস করতেন যে বাতাসে ইথার আছে এবং তার ভেতর দিয়ে আলো, শব্দ ইত্যাদি চলাচল করে। কিন্তু ১৮৮৭ সালে মাইকেলসন ও মর্লির পরীক্ষা থেকে প্রমাণিত হয়ে যায় যে ইথারের কোন অস্তিত্ব নেই। 

কিন্তু ইথারের অস্তিত্ব মিথ্যা প্রমাণিত হওয়ায় ব্যাপারটি পুরোপুরি মেনে নেননি লরেন্টজ। তিনি ইথার খুঁজে না পাবার ব্যাপারটিকে নতুনভাবে ব্যাখ্যা করলেন তাঁর ইলেকট্রন তত্ত্বের গবেষণায়।  গতির ফলে বস্তুর আকারের কী পরিবর্তন ঘটে তার তত্ত্ব আবিষ্কার করেন তিনি – যা পরবর্তীতে বিখ্যাত হয়েছে লরেন্টজ ট্রান্সফরমেশান নামে। লরেন্টজ ট্রান্সফরমেশান কাজে লাগিয়েই আইনস্টাইন আবিষ্কার করেছেন তাঁর আপেক্ষিকতার তত্ত্ব।

লরেন্টজের পরমাণু তত্ত্ব অনুসারে বস্তু যখন যেদিকে চলতে থাকে সেদিকে তার দৈর্ঘ্য কিছুটা কমে যায়। যদিও এই পরিবর্তন খুবই নগণ্য, বস্তুর গতিবেগ অত্যন্ত বেশি হলে এই পরিবর্তন মাপা সম্ভব। লরেন্টজ ধারণা দেন যে বস্তুর গতি বস্তুর ভেতরের চার্জিত বস্তুর মধ্যবর্তী বলের পরিবর্তন ঘটায়। 

লরেন্টজ ট্রান্সফরমেশান প্রকাশিত হবার আগেই পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়ে গেছেন হেনড্রিক লরেন্টজ তাঁর আলোর উপর চুম্বকত্বের প্রভাবের তত্ত্বের জন্য। ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব অনুযায়ী পরীক্ষাগারে তড়িৎচুম্বক তরঙ্গ উৎপাদনের প্রমাণ পান জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী হেনরিক হার্টজ। পরীক্ষামূলক প্রমাণ পাওয়া সত্ত্বেও ম্যাক্সওয়েলের সমীকরণে কিছুটা অসম্পূর্ণতা রয়ে গিয়েছিল – সেখানে পরমাণু তত্ত্বের কোন স্থান না থাকাতে। 

লরেন্টজ তাঁর পরমাণুর তত্ত্বে চার্জিত ইলেকট্রনের ধারণা দেন – যার প্রবাহের প্রকৃতির উপর নির্ভর করে পরিবাহী ও অপরিবাহী বস্তুর ধর্ম নির্ধারণ করা যায়। লরেন্টজ-এর তত্ত্বের পরীক্ষামূলক প্রমাণ দেন তাঁর ছাত্র পিটার জিম্যান। এই আবিষ্কারের জন্য তাঁরা দুজন ১৯০২ সালের পদার্থবিজ্ঞানের নোবেল পুরষ্কার পান। 

লরেন্টজের নোবেল পুরষ্কার-পরবর্তী গবেষণা আরো অনেক বেশি যুগান্তকারী। ১৯০৪ সালে প্রকাশিত লরেন্টজ ট্রান্সফরমেশান তত্ত্ব অনুসারে গতির ফলে গতিশীল বস্তুর ভেতরের কণার চার্জের মধ্যবর্তী তড়িৎচুম্বক বলের তারতম্য ঘটে। ফলে গতিশীল বস্তু আকারে কিছুটা সংকুচিত হয়ে যায়। এখান থেকেই পরের বছর ১৯০৫ সালে আলবার্ট আইনস্টাইন আবিষ্কার করেন স্পেশাল থিওরি অব রিলেটিভিটি। 

লরেন্টজের গবেষণা থেকে পদার্থবিজ্ঞানের এত বেশি নতুন গবেষণার পথ খুলে গিয়েছিল যে তাঁকে সেই সময়ের শ্রেষ্ঠ তত্ত্বীয় পদার্থবিজ্ঞানী হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন বিজ্ঞানীরা। ১৯০৫ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পান। ১৯০৮ সালে পান রয়েল সোসাইটির রামফোর্ড মেডেল এবং ১৯১৮ সালে পান কোপলে মেডেল। ১৯১১ সালে তাঁর সভাপতিত্বে ব্রাসেলস-এ অনুষ্ঠিত হয় প্রথম সলভে কংগ্রেস। 

১৯১৯ সালে নেদারল্যান্ড সরকার সমুদ্র নিয়ন্ত্রণের উচ্চ-পর্যায়ের কমিটির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করে প্রফেসর লরেন্টজকে। তাঁর নেতৃত্বে হাইড্রলিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর ব্যাপক উন্নতি ঘটে নেদারল্যান্ডে। 


আইনস্টাইন ও লরেন্টজ (১৯২১)


প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর লরেন্টজ ইওরোপের বিভিন্ন দেশের মধ্যে বৈজ্ঞানিক গবেষণা-সহযোগিতা পুনপ্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন। বিশ্বের বিজ্ঞানীদের মধ্যে প্রথম সারির সাত জন বিজ্ঞানীর সমন্বয়ে ‘কমিটি অন ইন্টেলেকচুয়াল কো-অপারেশন অদ দ্য লিগ অব নেশনস’-এর অন্যতম সদস্য ছিলেন লরেন্টজ। ১৯২৫ সালে তিনি সেই কমিটির চেয়ারম্যান মনোনীত হয়েছিলেন। 

১৯২৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি লরেন্টজ মৃত্যুবরণ করেন। নেদারল্যান্ডে তিনি এতটাই সম্মানিত ছিলেন যে তাঁর মৃত্যুতে দেশের সবগুলি টেলিগ্রাফ ও টেলিফোন সার্ভিস তিন মিনিটের জন্য বন্ধ রেখে তাঁর জন্য শোক প্রকাশ করা হয়। 

১৯৫৩ সালে লরেন্টজ-এর জন্মশতবার্ষিকী উপলক্ষে আলবার্ট আইনস্টাইন লিডেন ইউনিভার্সিটির অনুষ্ঠানে যে লেখাটি পাঠান সেখানে তিনি লিখেছেন, “সবাই অনুভব করতো তাঁর শ্রেষ্ঠতা, তাঁর প্রাধান্য। কিন্তু তাঁর শ্রেষ্ঠতা কারো উপরই কোন চাপ সৃষ্টি করতো না।“ 

লরেন্টজ ছিলেন অত্যন্ত মানবিক, যুদ্ধবিরোধী একজন মানুষ। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় তাঁর এক জার্মান প্রফেসর বন্ধু তাঁকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন যে – পৃথিবীতে মানুষের ভাগ্য নির্ধারিত হবে শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগে। লরেন্টজ তার উত্তরে বলেছিলেন, “সেরকম পৃথিবীতে আর যেই থাকুক, আমি থাকতে চাই না।“ 

তথ্যসূত্র

১।  https://www.nobelprize.org/prizes/physics/1902/ceremony-speech/

২। https://www.britannica.com/biography/Hendrik-Antoon-Lorentz

৩। আলবার্ট আইনস্টাইন, আইডিয়াজ অ্যান্ড ওপিনিয়ন্স, রূপা অ্যান্ড কোং, দিল্লী, ২০০৯।

৪। বায়োগ্রাফিক্যাল এনসাইক্লোপিডিয়া অব সায়েন্টিস্টস, ওয়ার্ল্ড বুক, শিকাগো, ২০০৩।

৫। https://en.wikipedia.org/wiki/Hendrik_Lorentz

 ______________

বিজ্ঞানচিন্তা মার্চ ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত






No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts