Thursday, 10 October 2024

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

 


পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন  ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শিরোপা অর্জন করেছিল, তখন তার বয়স মাত্র বারো বছর, পড়তো ক্লাস সেভেনে। ছোট্ট গীতাঞ্জলি রাওয়ের বিস্ময়কর বিজ্ঞান-প্রতিভা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতা দেখে সেদিন সবাই অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু গীতাঞ্জলির বৈজ্ঞানিক-উদ্ভাবনের তো তখন সবে শুরু। ২০১৯ সালে ক্লাস নাইনে পড়ার সময় উদ্ভাবন করে ফেললো ড্রাগ-আসক্তির পরিমাণ নির্ণয়ের নতুন পদ্ধতি ‘এপিওন’। ২০২১ সালে গীতাঞ্জলি তার ‘টেথিস’-এর জন্য পেয়ে গেছে আমেরিকান প্যাটেন্ট। কোভিডের সময় ঘরে বসে তৈরি করেছে সাইবার বুলিং বা অনলাইনে দুর্ব্যবহার কমানোর মোবাইল অ্যাপ ‘কাইন্ডলি’। এই অ্যাপ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করে অনলাইন ম্যাসেজে লেখা ঘৃণাবাচক শব্দকে বদলে দিতে সাহায্য করে। বর্তমানে ইউনিসেফ গীতাঞ্জলির এই অ্যাপ-এর আরো ব্যবহারোপযোগী করে সারাবিশ্বে পৌঁছে দেয়ার দায়িত্ব নিয়েছে। কোভিডের সময় সারাবিশ্বের বিশেষ করে উন্নয়নশীল বিশ্বের কিশোর-কিশোরীদের মাঝে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টির লক্ষ্যে গীতাঞ্জলি শুরু করেছিল অনলাইন ক্লাস। এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের নব্বই হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বিনামূল্যে গীতাঞ্জলি রাওয়ের ক্লাস করে অনলাইনে। ২০২০ সালে বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিনের ‘বর্ষসেরা শিশু’ শিরোপা অর্জন করে গীতাঞ্জলি রাও স্থান করে নিয়েছে টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে। ২০২৩ সালে জিতে নিয়েছে আমেরিকান প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে ‘গার্লস লিডিং চেঞ্জ’ পুরষ্কার। ১৭ বছর বয়সে গীতাঞ্জলি ভর্তি হয়েছে বিশ্ববিখ্যাত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এম-আই-টিতে।


গীতাঞ্জলি রাও



ভারতী রাও ও রাম রাও দম্পতি ভারত থেকে আমেরিকায় এসেছিলেন অন্য সব অভিবাসীদের মতোই উন্নততর অর্জন ও জীবন যাপনের লক্ষ্যে। চাকরির প্রয়োজনে তাঁদের যেতে হয়েছে এক রাজ্য থেকে অন্য রাজ্যে। কিন্তু শত পরিশ্রমের মধ্যেও তাঁদের লক্ষ্য হলো সন্তানদের উন্নত চিন্তা ও মানবিকতায় মানুষ করা। তাঁদের প্রথম সন্তান গীতাঞ্জলির জন্ম ওহাইও রাজ্যের কলম্বাস শহরে ২০০৫ সালে। তার কয়েক বছর পর দ্বিতীয় সন্তান অনিরুদ্ধের জন্ম। সন্তানদের প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার পাশাপাশি বাড়িতে এমন একটা পরিবেশ দেয়ার চেষ্টা করেছেন তাঁরা যাতে একেবারে শৈশব থেকেই মানুষের প্রতি মমত্ববোধ তৈরি হয়, মানুষের সমস্যার সমাধান করার তাগিদ তৈরি হয়।

গীতাঞ্জলির যখন তিন বছর বয়স, তখন তাকে সাথে নিয়ে তার মা এক অসুস্থ বন্ধুকে দেখতে গিয়েছিলেন নার্সিংহোমে। সেখানে সবার মন খারাপ দেখে গীতাঞ্জলি মাকে প্রশ্ন করেছিল – কীভাবে সবার মন ভালো করা যায়। মা বলেছিলেন সঙ্গীত অনেক সময় মন ভালো করে দিতে পারে। শুরু হলো গীতাঞ্জলির পিয়ানো শেখা। নিজের আনন্দের জন্য নয়, অন্যকে আনন্দ দেয়ার জন্য শেখা। তখন থেকেই গীতাঞ্জলির জীবনদর্শন হয়ে পড়ে অন্যের কষ্ট দূর করা। এক বছর পর থেকে প্রতি সপ্তাহে নার্সিংহোমে গিয়ে সে পিয়ানো বাজিয়ে মনখারাপ মানুষের মন ভালো করার চেষ্টা করে যাচ্ছে। কয়েক বছর পর তার ছোটভাইও বেহালা হাতে যোগ দেয় তার সাথে।

বাসায় প্রতিদিন রাতের খাবারের সময় টেলিভিশনে সংবাদ দেখে সবাই মিলে। সেখানে সাম্প্রতিক যেসব সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা হয়, গীতাঞ্জলির মা-বাবা সেসব সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায় সে ব্যাপারে ছেলেমেয়েদের ভাবতে বলেন। একেবারে ছোটবেলা থেকেই সমস্যা আড়াল না করে সমস্যার মুখোমুখি হয়ে সেগুলির সমাধানের পদ্ধতি খুঁজে বের করার অনুপ্রেরণা পেয়েছে গীতাঞ্জলি। তাদের খেলাধূলার ভেতরেই থাকতো উদ্ভাবনী চিন্তার চেষ্টা। যেমন, খাদ্য সমস্যার কীভাবে সমাধান করা যায়, বিশুদ্ধ পানি সরবরাহের সমস্যা, বাসস্থান সমস্যা – এগুলির আদর্শ সমাধান কীভাবে হতে পারে। তাদের বাসায় বৈজ্ঞানিক উদ্ভাবনের সাময়িকী কেনা হয় নিয়মিত। সেখান থেকে নতুন প্রযুক্তির খবর পড়ে গীতাঞ্জলি। বিজ্ঞান যে অনেক মানুষের কল্যাণ অনেক কম সময়ের মধ্যেই করতে পারে তা সে বুঝতে পেরেছে অনেক ছোটবেলা থেকেই। তাই যেকোনো বড় সমস্যার সমাধানে তার আধুনিক প্রযুক্তি উদ্ভাবনের চিন্তা মাথায় আসে। পাঁচ বছর বয়স থেকেই তার মনে হয় রোবট আর ড্রোন দিয়ে সব সমস্যার সমাধান করে ফেলবে।

আমেরিকায় শিশুদের প্রতিভা বিকাশের জন্য অনেক রকমের প্রতিযোগিতা থাকে। ‘রিডিনেস ফ্রিডম টু রিড (READiness Freedom to Read)’ রচনা প্রতিযোগিতা যেখানে শিশুরা তাদের পড়া কোন বই নিয়ে তাদের মতামত লিখে পাঠায়। সাত বছর বয়সে সেই রচনা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে দ্বিতীয় পুরষ্কার অর্জন করে গীতাঞ্জলি। তার লেখার দক্ষতায় মুগ্ধ হন প্রতিযোগিতার বিচারকদের সবাই। এই প্রতিযোগিতার আয়োজক জেনিফার হার্টসেল স্টকডেল গীতাঞ্জলিকে বিভিন্ন ধরনের লেখার ব্যাপারে উৎসাহ যোগানো ছাড়াও বিভিন্ন কর্মশালায় অংশ নেয়ার ব্যবস্থা করে দেন। স্কুলের গ্রীষ্মের ছুটির সময় সৃজনশীল লেখার কর্মশালায় অংশ নিয়ে গীতাঞ্জলি লিখে ফেলে তার ছোটভাই অনিরুদ্ধের মাকড়শাপ্রীতি সম্পর্কে একটি বই “বেবি ব্রাদার ওয়ান্ডার্‌স”। গীতাঞ্জলি নিজেই তার বইয়ের জন্য ছবি আঁকলো। এই বইটি  “পিবিএস কিডস” প্রতিযোগিতায় দ্বিতীয় পুরষ্কার পায় এবং ২০১৫ সালে বইটি প্রকাশিত হয়। 


গীতাঞ্জলি রাওয়ের প্রথম বই



বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির প্রতি গীতাঞ্জলির আগ্রহ দেখে অ্যাডভোকেট জেনিফার স্টকডেল গীতাঞ্জলিকে তাঁর 4-H STEM ফান ক্লাসে ভর্তি করে নেন। 4-H হলো তরুণদের মেধা ও দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য আমেরিকার সবচেয়ে বড় সংগঠন – যারা আমেরিকাজুড়ে ষাট লক্ষেরও বেশি শিশু-কিশোরের প্রতিভা বিকাশে নিয়মিত অনুশীলনের ব্যবস্থা করে। 4-H বলতে বোঝায় Head, Heart, Hands and Health. নয় বছর বয়সী গীতাঞ্জলি এই ক্লাসগুলি থেকে মজা করতে করতে হাতেকলমে শিখে যায় বৈজ্ঞানিক যন্ত্রপাতি ব্যবহারের কলাকৌশল। জেনিফার স্টকডেলের বাবা একজন ইলেকট্রিশিয়ান। তিনি নিজের হাতে গীতাঞ্জলিকে শেখান কীভাবে বৈদ্যুতিক যন্ত্রপাতি কাজ করে, কীভাবে ইলেকট্রনিক্স সংযোগ দিতে হয়। কিছুদিন পরেই গীতাঞ্জলি এই বিদ্যা কাজে লাগায় তার নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে।


জেনিফার স্টকডেলের সাথে গীতাঞ্জলি ও লরেন (জেনিফারের মেয়ে)



২০১৪ সালে মিশিগানের ফ্লিন্ট শহরের পানি সরবরাহে দূষণ দেখা দেয়। পানি বিশুদ্ধকরণ এবং সরবরাহ প্রক্রিয়ার কোন কারিগরী ত্রুটির কারণে খাবার পানিতে মাত্রাতিরিক্ত সীসা আর ব্যাকটেরিয়া পাওয়া গেছে। সারা শহরে আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়েছে। টেলিভিশনের সংবাদে গীতাঞ্জলি যখন প্রতিদিন এই সংবাদ এবং পানির সীসা ও ব্যাকটেরিয়া থেকে কীরকম বিপদ হতে পারে তা দেখায় গীতাঞ্জলির মন খারাপ হয়ে যায়। বিশুদ্ধ পানির অধিকার মানুষের মৌলিক অধিকার। তাদের বাসার পানিতেও সীসা আছে কি না তা পরীক্ষা করে দেখে তার বাবা। কিন্তু গীতাঞ্জলি খেয়াল করে দেখেছে যে যন্ত্র দিয়ে পরীক্ষা করা হয় সেটা অনেক বেশি সময় নেয় ফলাফল দিতে। গীতাঞ্জলি ভাবতে থাকে কীভাবে কম সময়ে পানি বিশুদ্ধ করা যায়, কিংবা কত দ্রুত পানির বিশুদ্ধতা পরীক্ষা করা যায়।

গীতাঞ্জলি তার সমস্ত মনযোগ দিয়ে ভাবতে থাকে এ ব্যাপারে নতুন কিছু উদ্ভাবনের। স্কুলের বিজ্ঞান বইতে পড়েছে কিছু কিছু ভালো ব্যাকটেরিয়া আছে যারা খারাপ ব্যাকটেরিয়া খেয়ে ফেলে। গীতাঞ্জলি ভাবলো পানিতে ওরকম ব্যাকটেরিয়া ছেড়ে দিলে কি ওরা পানির সীসা খেয়ে ফেলতে পারবে? কিন্তু তাতেও তো সমস্যার সমাধান হবে না। পানিতে তো ব্যাকটেরিয়া রয়ে যাবে। ২০১৫ সালে গীতাঞ্জলির হাতে পড়লো ‘এম আই টি টেকনোলজি রিভিউ’। সেখানে সে প্রথম পড়লো কার্বন ন্যানোটিউবের কথা। এম-আই-টির বিজ্ঞানীরা কার্বন ন্যানোটিউব ব্যবহার করে খাদ্যে কোন বিষক্রিয়া হয়েছে কি না তা বের করার পদ্ধতি উদ্ভাবন করেছেন। খাদ্য পচে গেলে সেখান থেকে গ্যাস বের হয়। কার্বন ন্যানোটিউব সেই গ্যাস শনাক্ত করতে পারে। পচন যত বেশি, গ্যাসের পরিমাণও তত বেশি। গীতাঞ্জলির মনে হলো কার্বন ন্যানোটিউব কি তবে পানির ভেতর কী পরিমাণ সীসা আছে তাও বের করতে পারবে? কিন্তু দশ বছর বয়সী গীতাঞ্জলি তো কার্বন ন্যানোটিউব সম্পর্কে তেমন কিছুই জানে না। এখন উপায়?

4-H STEM ফান ক্লাস করার সময় গীতাঞ্জলি শুনেছিল ‘ডিসকভারি এডুকেশন থ্রি-এম ইয়ং সায়েন্টিস্ট চ্যালেঞ্জ’-এর কথা। আমেরিকার সবচেয়ে বড় গবেষণা শিল্পপ্রতিষ্ঠান থ্রি-এম (3M)। ১৯০২ সালে মিনেসোটা রাজ্যে ‘মিনেসোটা মাইনিং অ্যান্ড ম্যানুফ্যাকচারিং কোম্পানি’ হিসেবে এই প্রতিষ্ঠানের যাত্রা শুরু হয়েছিল। এরপর এই একশ বাইশ বছরে এই কোম্পানি এখন পৃথিবীর সত্তরটি দেশে দুইশর বেশি শাখা-কোম্পানি চালাচ্ছে। বিজ্ঞানের উদ্ভাবন ও গবেষণায় এই কোম্পানির অবদান অনেক। লক্ষাধিক উদ্ভাবনের প্যাটেন্ট আছে এই কোম্পানির। সারাপৃথিবী থেকে তরুণ উদ্ভাবনী প্রতিভা খুঁজে বের করে তাদের মেধাকে সত্যিকারের কাজে লাগানোর জন্য এই কোম্পানি প্রতি বছর ‘ডিসকভারি এডুকেশন থ্রি-এম ইয়ং সায়েন্টিস্ট চ্যালেঞ্জ’-এর আয়োজন করে। এই প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়ার জন্য প্রতিযোগীকে এক-দুই মিনিটের একটি ভিডিও তৈরি করে পাঠাতে হয় যেখানে তার উদ্ভাবনের বিষয়, কীভাবে কাজ করবে, কী কাজে লাগবে এবং দৈনন্দিন জীবনের কী সমস্যার সমাধানে কাজে আসবে তা ব্যাখ্যা করতে হয়। গীতাঞ্জলি পানিদূষণের মাত্রা পরিমাপের জন্য তার উদ্ভাবনের ধারণা ব্যাখ্যা করে একটি ভিডিও তৈরি করে পাঠালো থ্রি-এম চ্যালেঞ্জে। বিশুদ্ধ পানির গ্রিক দেবী টেথিসের নামে গীতাঞ্জলি তার যন্ত্রের নাম দিলো – টেথিস।

গীতাঞ্জলি তার যন্ত্রের প্রোটোটাইপ তৈরি করা শুরু করলো। কার্যকর দরকারি কার্বন ন্যানোটিউব তখনো পাওয়া যায়নি। বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসরদের কাছে এবং রাসায়নিক কোম্পানিতে ইমেইল করার পরও তেমন কোন সাড়া সে পায়নি। এগারো বছরের বাচ্চা একটি মেয়ের ইমেইলের গুরুত্ব নেই কারো কাছে। কিন্তু হাল ছেড়ার পাত্রী নয় গীতাঞ্জলি। ইউটিউব ভিডিও দেখে দেখে সে শিখে ফেলেছে মাইক্রোকন্ট্রোলার কীভাবে কাজ করে। কার্বন ন্যানোটিউব যদি পানির মধ্যে সীসার উপস্থিতি শনাক্ত করতে পারে তাহলে রেজিস্ট্যান্স বেড়ে যাবে, বিদ্যুৎ-প্রবাহের মান কমে যাবে। মাইক্রোকন্ট্রোলারের মাধ্যমে সেই সংকেত পাঠানো যাবে মোবাইল-অ্যাপএ। কিন্তু কার্বন ন্যানোটিউব পাওয়া যায়নি তখনও।

হতাশ হতে শেখেনি গীতাঞ্জলি। সে জানে অনবরত চেষ্টার মাধ্যমে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা যায়। সেই সময় থ্রি-এম থেকে ফোন এলো। পাঁচ শতাধিক উদ্ভাবনের আইডিয়ার মধ্য থেকে গীতাঞ্জলির টেথিস প্রজেক্ট ফাইনাল রাউন্ডের জন্য মনোনীত হয়েছে। শুধু তাই নয়, কার্যকর প্রোটোটাইপ তৈরির জন্য গীতাঞ্জলিকে সবধরনের সহযোগিতা করার ব্যবস্থাও করা হলো। গীতাঞ্জলিকে বৈজ্ঞানিক কাজ শেখানোর জন্য থ্রি-এম কর্পোরেট ম্যাটেরিয়াল রিসার্চ ল্যাবরেটরির বিজ্ঞানী ডক্টর ক্যাথলিন স্যাফার দায়িত্ব নিলেন গীতাঞ্জলিকে কাজ শেখানোর।

 

গীতাঞ্জলি ও তার গাইড ডক্টর ক্যাথলিন স্যাফার

 গীতাঞ্জলিরা তখন কলরাডো রাজ্যে চলে এসেছে। সেখানে নতুন স্কুলে একটি থ্রি-ডি প্রিন্টার ছিল। সেটা ব্যবহার করে টেথিসের কভার তৈরি করা হলো। ডক্টর স্যাফারের সহযোগিতায় ভারমন্টের একটি কোম্পানির কাছ থেকে কেনা হলো বিশেষ ক্লোরাইড মেশানো কার্বন ন্যানো-টিউব যেগুলি পানির সীসা শনাক্ত করতে পারে। দীর্ঘ এক বছরের অনবরত চেষ্টার পর তৈরি হলো কার্যকর টেথিস।


টেথিসের প্রোটোটাইপ 

২০১৭ সালে অন্যসব উদ্ভাবনকে পেছনে ফেলে গীতাঞ্জলির টেথিস হলো শ্রেষ্ঠ উদ্ভাবন। বারো বছর বয়সেই গীতাঞ্জলি রাও স্বীকৃতি পেলো আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের। থ্রি-এম থেকে পঁচিশ হাজার ডলার পুরষ্কার দেয়া হলো গীতাঞ্জলিকে। প্যাটেন্টের জন্য দরখাস্ত করা হলো। ২০২১ সালে আমেরিকান প্যাটেন্ট লাভ করে গীতাঞ্জলির টেথিস। প্যাটেন্ট নম্বর ১১০৮৫৯০৭।


প্যাটেন্ট সার্টিফিকেট নিচ্ছে গীতাঞ্জলি

আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবকের পুরষ্কার পাবার পর বিখ্যাত হয়ে গেছে গীতাঞ্জলি রাও। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের তরুণদের অনুপ্রেরণার অন্যতম নাম হয়ে উঠেছে গীতাঞ্জলি। বিশ্বখ্যাত মার্ভেল কমিক কোম্পানি তাদের মার্ভেল হিরো সিরিজের প্রথম বই করেছে গীতাঞ্জলি রাও-কে নিয়ে।


মার্ভেল হিরো প্রজেক্টের প্রথম বই – জিনিয়াস গীতাঞ্জলি। 

বিশ্ববিখ্যাত টাইম ম্যাগাজিন ২০২০ সাল থেকে  চালু করেছে ‘বর্ষসেরা শিশু’ নির্বাচন। শিক্ষা, বিজ্ঞান, সামাজিক সমস্যার সমাধান ইত্যাদি নানা বিষয়ে শিশুকিশোরদের উদ্যোগ ও অর্জনকে স্বীকৃতি দেয়ার উদ্দেশ্যেই টাইম ম্যাগাজিন প্রথমবারের মতো এই প্রকল্প চালু করেছে ২০২০ সালে। এই প্রতিযোগিতায় গীতাঞ্জলিকে মনোনয়ন দেয় আমেরিকান প্যাটেন্ট অফিস। পাঁচ হাজারেরও বেশি মনোনয়ন থেকে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করে ২০২০ সালের বর্ষসেরা শিশু নির্বাচিত হয় গীতাঞ্জলি রাও। টাইম ম্যাগাজিনের পক্ষ থেকে গীতাঞ্জলির সাক্ষাৎকার নিয়েছিলেন অস্কারজয়ী অভিনেত্রী ও জাতিসংঘের বিশেষ দূত অ্যাঞ্জেলিনা জোলি।


টাইম ম্যাগাজিনের প্রচ্ছদে গীতাঞ্জলি রাও



ফ্লিন্ট শহরের পানিদূষণ সমস্যা মিটে গেলেও পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এখনো বিশুদ্ধ পানির সরবরাহ নেই। গীতাঞ্জলির উদ্ভাবন সেসব দেশে কাজে লাগছে।

গীতাঞ্জলি টেথিসের পর নতুন প্রকল্প শুরু করলো – ব্যথানাশকের আসক্তি নিরাময়ের উদ্দেশ্যে। গীতাঞ্জলি দেখেছে চিকিৎসার কাজে ব্যবহৃত ব্যথানাশক মরফিন জাতীয় ওষুধের প্রতি অনেকের আসক্তি জন্মে যায়। গীতাঞ্জলি পড়াশোনা করে জানতে পেরেছে এই আসক্তি জন্মে শরীরে ওপিয়ড রিসিপ্টর জিনের মিউটেশনের ফলে। গীতাঞ্জলির আইডিয়া হলো যদি এমন কোন যন্ত্র তৈরি করা যায় যেটা দিয়ে এই আসক্তির পরিমাপ করা যাবে খুব সহজে। কিন্তু গীতাঞ্জলি তো জানে না জিনের মিউটেশান কীভাবে ঘটে। তখন সে মাত্র ক্লাস এইটে উঠেছে। কিন্তু আমেরিকার প্রফেসরদের অনেকেই সত্যিকারের প্রতিভা বিকাশে সর্বাত্মক সাহায্য করার জন্য এগিয়ে আসেন। গীতাঞ্জলির আইডিয়াকে উদ্ভাবনে পরিণত করার জন্য এগিয়ে এলেন কলরাডো বিশ্ববিদ্যালয়ের সেল বায়োলজির প্রফেসর মাইকেল ম্যাকমারি। তিনি তাঁর বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গবেষণার সুযোগ করে দিলেন গীতাঞ্জলিকে।


 

কলরাড়ো বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গীতাঞ্জলি

গীতাঞ্জলি তার স্কুলের পড়াশোনার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণাগারে গবেষণা করে উদ্ভাবন করলো অপিওড ড্রাগের আসক্তি মাপার যন্ত্র ‘এপিওন’। বেদনানাশিনী গ্রিক দেবী এপিওনের নাম অনুসারে এই যন্ত্রের নাম দিয়েছে সে। তার যন্ত্রটি কাজ করে খুব সহজ পদ্ধতিতে। একটি স্পেকট্রোফটোমিটারে ছত্রাকের জিনের ছবি বিশ্লেষণ করে গীতাঞ্জলি প্রমাণ করলো যে আসক্তির ফলে জিনের মিউটেশন হলে কোষে প্রোটিনের পরিমাণ বেড়ে যায়। তখন তাদের রঙ স্বাভাবিকের চেয়ে গাঢ় হয়ে যায়। তবে মানুষের ডিএনএ পরীক্ষা না করে নিশ্চিত হবার উপায় নেই যে তার এপিওন যন্ত্র ঠিকমতো কাজ করছে কি না। সেই সময় জিন-এডিটিং পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়ে গেছে। এই পদ্ধতি ব্যবহার করে গীতাঞ্জলির যন্ত্র ব্যবহার করে দেখার আগেই বিশ্বব্যাপী কোভিডের আক্রমণ শুরু হয়ে গেল।

কোভিডের সময় গীতাঞ্জলি উদ্ভাবন করলো অনলাইনে দুর্ব্যবহার রোধ করার অ্যাপ – কাইন্ডলি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে তার এই অ্যাপ অনলাইন ম্যাসেজের অপমানজনক আক্রমণাত্মক শব্দ শনাক্ত করতে পারে এবং তার বদলে ভালো শব্দ ব্যবহারের পরামর্শ দিতে পারে। ইউনিসেফ গীতাঞ্জলির এই অ্যাপ গ্রহণ করে এখন তা সবার জন্য ব্যবহারোপযোগী করার কাজ করছে।


সাইবার বুলিইং এর বিরুদ্ধে সোচ্চার গীতাঞ্জলি।

শ্রেষ্ঠ তরুণ উদ্ভাবক হবার পর থেকেই পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের শিশুকিশোর তরুণ গীতাঞ্জলির কাছ থেকে জানতে চাচ্ছে কীভাবে বিজ্ঞানের গবেষণা শুরু করা যায়। গীতাঞ্জলি অনলাইনে তাদের সাথে কথা বলা শুরু করে নিয়মিত। তার অনলাইন ক্লাসে এখন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে আশি হাজারেরও বেশি শিক্ষার্থী বিজ্ঞান গবেষণার অনুশীলন করছে। এত শিক্ষার্থীর চাপ সামাল দেয়ার জন্য গীতাঞ্জলি ইতোমধ্যে দুটি বই লিখে প্রকাশ করেছে। ২০২২ সালে প্রকাশিত হয়েছে ‘ইয়ং ইনোভেটরস গাইড টু স্টেম’, এবং অতি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে ‘ইয়ং ইনোভেটরস গাইড টু প্ল্যানিং ফর সাকসেস’। আফ্রিকার বেশ কয়েকটি হতদরিদ্র দেশে গীতাঞ্জলি তার নিজের বই এবং আসবাবপত্র দান করেছে যেন ওরা নিজেদের মতো করে বিজ্ঞান গবেষণা শুরু করতে পারে।


গীতাঞ্জলির দ্বিতীয় বই


গীতাঞ্জলির তৃতীয় বই


২০২১ সালে গীতাঞ্জলি পেয়েছে ন্যাশনাল জিয়োগ্রাফিকের ইয়ং এক্সপ্লোরার পুরষ্কার। পুরষ্কারের সব টাকা দিয়ে গীতাঞ্জলি কেনিয়ার এক স্কুলে তৈরি করে দিয়েছে বিজ্ঞান গবেষণাগার – যেখানে শিক্ষার্থীরা শিখছে কীভাবে সমস্যার সমাধান করতে হয়, উদ্ভাবনের চিন্তা করতে হয় এবং তা বাস্তবায়ন করতে হয়।

বিজ্ঞান গবেষণায় আগ্রহ জন্মার পর থেকেই গীতাঞ্জলির স্বপ্ন এমআইটিতে পড়ার। গীতাঞ্জলি তার নিজের যোগ্যতায় সতের বছর বয়সে ২০২২ সালে ভর্তি হয়েছে এমআইটিতে। ইঞ্জিনিয়ারিং বায়োলজিতে মেজর আর শিল্পোদ্যোগ তার মাইনর সাবজেক্ট।

গীতাঞ্জলির মতো উদীয়মান প্রতিভাকে যথাযোগ্য সম্মান, স্বীকৃতি, অনুপ্রেরণা দিয়ে উৎসাহিত করার পাশাপাশি তাদের মেধা বিকাশে সহায়তা করার অনেক প্রতিষ্ঠান আছে আমেরিকায়। তাই সেখানে মেধার বিকাশ হয় সবচেয়ে বেশি। গীতাঞ্জলি রাওকে আমেরিকার প্রেসিডেন্টের অফিস থেকে বিশেষ সম্মাননা দেয়া হয় সম্প্রতি। ফার্স্ট লেডি জিল বাইডেন গীতাঞ্জলিকে হোয়াইট হাউজে আমন্ত্রণ জানিয়ে ‘গার্লস লিডিং চেঞ্জ’ পুরষ্কার তুলে দেন।


ফার্স্টলেডি জিল বাইডেনের সাথে গীতাঞ্জলি

গীতাঞ্জলি শুধুমাত্র বিজ্ঞান গবেষণার পেছনেই যে সব সময় লেগে থাকে তা নয়। আঠারো বছর বয়স হবার পর সম্প্রতি সে এভিয়েশান লাইসেন্স পেয়ে ছোট্ট বিমান চালানো শুরু করেছে।

এমআইটির উজ্জ্বল ছাত্রী গীতাঞ্জলির কাছ থেকে আরো নতুন নতুন কী কী উদ্ভাবন ঘটে তা দেখার জন্য বিজ্ঞানজগৎ অধীর আগ্রহ নিয়ে অপেক্ষা করছে।

 

তথ্যসূত্র:

১। লরেন সারকি ও মনজিত থাপ, রেজিস্টারস, রেন অ্যান্ড রুক, লন্ডন, ২০১৯।

২। www. Gitanjalirao.net

৩। time.com/5916772/kid-of-the-year-2020

৪। www.3m.com

৫। ইউনাইটেড স্টেটস প্যাটেন্ট অ্যান্ড ট্রেডমার্ক অফিস

৬। এমআইটি web.mit.edu

৭। ইউনিসেফ https://www.unicef.org/innovation/kindly

__________________

বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২৪ সংখ্যায় প্রকাশিত






2 comments:

  1. Unbelievable tallent she is! May God long live!!💐🙏

    ReplyDelete
  2. বিস্ময়কর!

    ReplyDelete

Latest Post

Macroscopic Quantum Tunnelling: The Science Behind the 2025 Nobel Prize in Physics

  Even though physicists do not believe in ghosts, they have no way of denying the strange, almost ghost-like behaviour of quantum mechanics...

Popular Posts