Thursday 26 September 2024

অলিভিয়া নিউটন-জন

 



কাজের সুবাদে মাঝে মধ্যে যেতে হয় অস্টিন হাসপাতালে। ডিপার্টমেন্টের শিক্ষার্থীদের কেউ কেউ সেখানে ক্লিনিক্যাল কাজকর্ম শেখে, আবার অনেকেই পাস করে সেখানে কাজ করছে। হাইডেলবার্গে অনেকগুলি বিশাল বিশাল ভবনজুড়ে এই হাসপাতালের কর্মযজ্ঞ। যতবারই হ্যারোল্ড স্টক্‌স বিল্ডিং-এর নিউক্লিয়ার মেডিসিন ডিপার্টমেন্টের বাংকার থেকে বের হয়ে রেডিওথেরাপি ডিপার্টমেন্টের দিকে যাই – অলিভিয়া নিউটন-জন বিল্ডিং-এ ঢুকে যাই। মুগ্ধ হয়ে দেখি সেখানকার কার্যক্রম। ২০১৫ সাল থেকে ঝকঝকে নতুন বহুতল দৃষ্টিনন্দন ভবনে চালু হয়েছে অলিভিয়া নিউটন-জন ক্যান্সার ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার। চালু হবার মাত্র নয় বছরের মধ্যেই এখন দেড়শোর মতো ক্যান্সার গবেষণা প্রকল্প চলছে এই সেন্টারে, চলছে দুই শতাধিক ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল – যেখানে ক্যান্সার রোগের চিকিৎসার পদ্ধতি এবং প্রয়োগ নিয়ে নতুন নতুন উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে। অবাক হবার পাশাপাশি শ্রদ্ধা আর কৃতজ্ঞতায় মাথা আপনাআপনিই নত হয়ে যায় অলিভিয়া নিউটন-জনের প্রতি – যাঁর উদ্যোগেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এই ক্যান্সার রোগীদের সেবা ও  চিকিৎসার গবেষণা প্রতিষ্ঠান।


অলিভিয়া নিউটন-জন ক্যান্সার ওয়েলফেয়ার অ্যান্ড রিসার্চ সেন্টার

অস্ট্রেলিয়ান গায়িকা ও অভিনেত্রী হিসেবে অলিভিয়া নিউটন-জনকে আমরা অনেকেই চিনি। কিন্তু তিনি যে তাঁর সারাজীবনের অর্জিত সমস্ত ধন সম্পদ দিয়ে ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তা হয়তো অনেকেরই জানা নেই।

১৯৪৮ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর ইংল্যান্ডের কেমব্রিজে জন্ম অলিভিয়ার। তাঁর মা আইরিন ছিলেন জার্মান। আইরিনের বাবাকে আমরা সবাই চিনি – নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স বর্ন। ম্যাক্স বর্নের নাতনি অলিভিয়া। অলিভিয়ার বাবা ব্রিনলি নিউটন-জন ছিলেন ব্রিটিশ। মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটিতে অধ্যাপনার জন্য অলিভিয়ার পাঁচ বছর বয়সে ইংল্যান্ড থেকে মেলবোর্নে চলে আসেন তাঁরা। মেলবোর্নেই অলিভিয়ার শৈশব কৈশোর লেখাপড়া বেড়ে ওঠা।


অলিভিয়া নিউটন-জন


ছোটবেলা থেকেই সংগীতের প্রতি আগ্রহ। মেলবোর্নের কফি বারে গান করা শুরু করেছিলেন কৈশোরের শুরুতে। ১৯৬৫ সালে ১৭ বছর বয়সে ট্যালেন্ট কনটেস্ট জিতে ইংল্যান্ডে যান গানের রেকর্ড করতে। ১৯৭১ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর গানের প্রথম অ্যালবাম। ১৯৭৩ সাল থেকে শুরু হয় তাঁর গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জেতা। ক্যারিয়ারে বারো বার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ডের জন্য মনোনয়ন পেয়েছেন,  চার বার গ্র্যামি অ্যাওয়ার্ড জিতেছেন (১৯৭৪, ১৯৭৫ (২), ১৯৮৩) অলিভিয়া নিউটন-জন। এছাড়াও আরো সতেরটি পুরষ্কার জিতেছেন তিনি সংগীতের জন্য।


গ্রিজ মুভিতে অলিভিয়া নিউটন-জন



হলিউডে অভিনেত্রী হিসেবে তাঁকে বিপুল জনপ্রিয়তা এনে দেয় ১৯৭৮ সালে মুক্তি পাওয়া মিউজিক্যাল মুভি গ্রিজ। জন ট্রিভোল্টার বিপরীতে অলিভিয়া নিউটন-জন ছিলেন অনবদ্য। এরপর আরো কয়েকটি মুভিতে অভিনয় করলেও তেমন সাড়া ফেলতে পারেনি।

১৯৮৪ সালে তিনি বিয়ে করেন তাঁর দীর্ঘদিনের বয়ফ্রেন্ড ম্যাট ল্যাটানজিকে। ১৯৮৬ সালে তাঁদের প্রথম সন্তান ক্লোয়ির জন্ম হয়। মেয়েকে সময় দেয়ার জন্য তিনি সংগীত জগত থেকে বিরতি নেন কয়েক বছর। ১৯৯৫ সালে ম্যাটের সাথে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাঁর।

১৯৯২ সালে তিনি আবার পুরোপুরি সঙ্গীতাঙ্গনে ফিরে আসেন। ২০১৬ সাল পর্যন্ত তিনি তাঁর সঙ্গীত চালিয়ে গেছেন পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে।

১৯৯২ সালে অলিভিয়ার স্তনক্যান্সার ধরা পড়ে। প্রাথমিক পর্যায়ে ধরা পড়ার কারণে তাঁকে চিকিৎসা করে রোগমুক্ত করা সম্ভব হয় পরবর্তী এক বছরের মধ্যে। সার্জারি ও কেমোথেরাপির মাধ্যমে তিনি সুস্থ হয়ে উঠেছিলেন। কিন্তু তখন থেকেই তিনি কাজ করে দিয়েছিলেন মেলবোর্নে একটি ক্যান্সার গবেষণাকেন্দ্র গড়ে তোলার। নিজের সঞ্চয় এবং তহবিল সংগ্রহের কাজ শুরু করেছিলেন।


অলিভিয়া ও আমাজন


২০০৮ সালে অলিভিয়া নিউটন-জন আবার বিয়ে করেন আমাজন জন এস্টারলিংকে। ক্যান্সার রোগীদের সহায়তা ও ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার জন্য দিনরাত পরিশ্রম করেছেন অলিভিয়া, আর তাঁর পাশে থেকে অবিরাম সহযোগিতা করেছেন আমাজন।

২০১৭ সালে তাঁর ক্যান্সার আবার ফিরে আসে। এবার শরীরের বিভিন্ন জায়গায় ছড়িয়ে পড়ে। ক্যান্সারের সাথে যুদ্ধ করতে করতেও তিনি ক্যান্সার গবেষণার জন্য কাজ করে গেছেন। ২০২২ সালের ৮ আগস্ট ক্যালফোর্নিয়ায় জীবনাবসান হয় অলিভিয়া নিউটন-জনের।

ক্যান্সার গবেষণা প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলায় তাঁর অবদানের স্বীকৃতি দিয়েছে ইংল্যান্ড, অস্ট্রেলিয়া এবং আমেরিকা। ২০১৯ সালে তিনি পেয়েছেন কম্প্যানিয়ন অব দ্য অর্ডার অব অস্ট্রেলিয়া খেতাব, ২০২০ সালে হয়েছেন অস্ট্রেলিয়ান অব দ্য ইয়ার, ২০১৬ সালে পেয়েছেন আমেরিকার লাইফটাইম অ্যাচিভমেন্ট অ্যাওয়ার্ড।


ক্যান্সার গবেষকদের সাথে অলিভিয়া


ক্যান্সার রোগের কাছে মানুষ এখনো ভীষণ অসহায়। এই অসহায় মানুষদের প্রকৃত সহায় হচ্ছে তাদেরকে সেবা এবং চিকিৎসা দেয়ার মানুষ এবং প্রতিষ্ঠানগুলি। এরকম সেবামূলক প্রতিষ্ঠান যারা গড়ে তোলেন, গড়ে তোলার মানসিকতা যাদের থাকে – তাদের সম্মানে মাথা নত হয়ে আসাটাই তো স্বাভাবিক।

অলিভিয়া নিউটন-জন, আপনাকে সালাম।

শুভ জন্মদিন। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

বিজ্ঞানী গীতাঞ্জলি রাও

  পানি-দূষণের মাত্রা নির্ধারণের দ্রুততম বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ‘টেথিস’ উদ্ভাবন করে গীতাঞ্জলি রাও যখন   ২০১৭ সালে আমেরিকার শ্রেষ্ঠ তরুণ বিজ্ঞানীর শ...

Popular Posts