প্রথম
অধ্যায়
ভয়ঙ্কর মঙ্গল
"এই
ছবি তুই এঁকেছিস?" - সুব্রত'র চোখে অবিশ্বাসের চাউনি। আমি বুঝতে পারছি না
আমার আঁকা ছবি দেখে এত আশ্চর্য হবার কী আছে।
"হ্যাঁ আমি এঁকেছি। তাতে কী
হয়েছে?"
"এত্তো ভাল ছবি তুই কেমনে
আঁকলি?"
"কেন? তুই ছাড়া বুঝি আর কেউ ভালো
ছবি আঁকতে পারবে না?" - সুব্রত'র প্রশ্ন শুনে ফুঁসে ওঠে নয়ন। সুব্রত ক্লাসের
সবার ওপর খবরদারি করলেও নয়নকে খুব ভয় পায়। সে মিনমিন করে বললো, "না, মানে
ছবিটা এমন জীবন্ত"
"যে ছবি স্বাতী এঁকেছে সেই ছবি
জীবন্ত হবে না তো কি তোর মতো মরন্ত হবে?"
নয়নের গলার স্বর চড়ে যাচ্ছে। তাতে অবশ্য
কোন সমস্যা নেই। নয়নের চড়া গলার সাথে ক্লাসের সবাই পরিচিত। ক্লাস শুরু হবার
আগপর্যন্ত এরকম চিৎকার চেঁচামেচি আমাদের ক্লাসে চলতেই থাকে।
লুনা ফিসফিস করে আমার কাছে জানতে চাইলো,
"মরন্ত শব্দটি কি সঠিক?"
আমি বললাম, "নয়ন যেহেতু বলেছে সেহেতু
সঠিক।"
"নয়ন, তুই কিছু না বুঝেই বেহুদা
চিল্লাইতেছিস।" পেছনের বেঞ্চ থেকে অর্ক উঠে এসে সুব্রতর পাশে দাঁড়ায়। কিছুদিন
আগেও সুব্রত অর্ককে দুই চোখে দেখতে পারতো না। সিক্স থেকে সেভেনে ওঠার সময় অর্ক
তেমন ভালো রেজাল্ট করেনি। আর সুব্রত এখনো পর্যন্ত কোনদিন ফার্স্ট ছাড়া সেকেন্ড
হয়নি। ক্লাসের ফার্স্টবয় হিসেবে প্রতি ক্লাসেই সে মনিটরের দায়িত্ব পালন করেছে।
দায়িত্ব নয়, আসলে ক্ষমতা। ক্ষমতার দম্ভে সে ক্লাসের কাউকেই তোয়াক্কা করতো না।
স্যার-ম্যাডামদের চোখে সুব্রত হিরের টুকরো ছেলে। কিন্তু আফতাব স্যার ক্লাসটিচার হয়ে
আসার পর সুব্রতর আধিপত্য কিছুটা খর্ব হয়ে পড়েছে। কারণ আফতাব স্যার ক্লাসে কাউকেই
আলাদা করে পাত্তা দেন না, অথবা বলা চলে সবাইকে সমান পাত্তা দেন। সবার মর্যাদা যদি
সমান হয়ে যায় - তাহলে তো যারা এতদিন আলাদা মর্যাদা পেতো তাদের খারাপ লাগবে তাই না?
আফতাব স্যার বিজ্ঞান পড়াতে এসে আস্তে আস্তে আমাদের সবার ভেতর বিজ্ঞানের প্রতি এক
ধরনের ভালোবাসা তৈরি করে ফেলেছেন। পরীক্ষার জন্য আলাদা করে বিজ্ঞানের প্রশ্নের
উত্তর মুখস্থ করার যে দরকারই নেই তা আমরা কিছুদিন আগেই বুঝতে পেরেছি। অর্ধবার্ষিক
পরীক্ষায় বিজ্ঞানে আমরা সবাই ভালো করেছি। ক্লাসের লাস্টবয় আবদুর রহমান পর্যন্ত
বিজ্ঞানে একশ'র মধ্যে আশি পেয়েছে, অর্ক পেয়েছে ১০০। ফারজানা, নয়ন, সুব্রত,
ইয়াসমিন, চিত্রা এবং আরো অনেকে পেয়েছে ৯৫। সেজন্য সুব্রতর খুবই মনখারাপ। এতদিন
মার্কের দিক থেকে সে ছিল অনেকটা ধরাছোঁয়ার বাইরে। এখন তাকে অনেকেই ধরে ফেলেছে।
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো লুনাও বিজ্ঞানে
১০০'র মধ্যে ১০০ পেয়েছে। লুনা আমাদের ক্লাসে এসেছে মাত্র দু'মাস আগে। তার বাবার
বিদেশে পোস্টিং থাকার কারণে সে এতদিন চীনে ছিল। তার কাছ থেকে আমরা বেশ কিছু চীনা
শব্দও শিখে ফেলেছি। হাসিখুশি লুনা খুব দ্রুতই আমাদের বন্ধু হয়ে গেছে। আমি, ফারজানা,
চিত্রা, আর নয়ন একেবারে কেজি-ওয়ান থেকে ঘনিষ্ঠ বন্ধু। অর্ক আমাদের নাম দিয়েছে
চতুরঙ্গ। কিন্তু এখন লুনাকে নিয়ে আমরা পাঁচ-জন হয়ে গিয়েছি। নয়ন অর্ককে জিজ্ঞেস
করেছিল, 'এবার কী বলবি আমাদের?'
অর্ক একটুও সময় না নিয়ে বলেছিল, 'তোরা
এখন পঞ্চভূত।'
"কী বললি? আমাদের তুই ভূত বললি?
নয়ন, দ্যাখ অর্ক আমাদের ভূত বলছে।" আমি প্রতিবাদ করেছিলাম। আমি আশা করেছিলাম
নয়ন অর্কের দিকে তেড়ে যাবে। কিন্তু নয়ন আমার উপর রেগে গেলো - "চুপ কর তো
স্বাতী। তুই পঞ্চভূতের অর্থ জানিস না?"
আমি চুপ করে গিয়েছিলাম। পঞ্চভূতের অর্থ আমি জানি না।
অর্ক যখন আগে চতুরঙ্গ বলেছিল তখন আমি ভেবেছিলাম রঙ্গ-রসিকতার কথা বলছে। এখন
পঞ্চভূত বলাতে মনে হয়েছে ভূত বলেছে। নয়ন পরে বলেছে পঞ্চভূত হলো - মাটি, পানি,
আগুন, বাতাস, আর আকাশ। আমার মনে হয়েছে অর্ক আমাদের গ্রুপের সঠিক নামই দিয়েছে। অর্ক
অনেক জানে। সারাক্ষণই বই পড়ে সে। বিজ্ঞানে তার উৎসাহই সবচেয়ে বেশি। আমরা অনেকগুলো
গ্রহ-উপগ্রহ সম্পর্কে অনেককিছু জেনে ফেলেছি এর মধ্যে। আফতাব স্যার আমাদের ক্লাসে
বিজ্ঞান ক্লাব তৈরি করে দিয়েছেন। আমাদের সবার মত নিয়ে ক্লাবের নাম রাখা হয়েছে
জগদীশচন্দ্র বসু বিজ্ঞান ক্লাব। ক্লাবের সভাপতি কে হতে চায় জিজ্ঞেস করেছিলেন আফতাব
স্যার। আমরা সবাই হাত তুলেছিলাম। স্যার তখন ক্লাসের রোল নম্বর অনুসারে সুব্রতকে
সভাপতি, ফারজানাকে সহ-সভাপতি, ইয়াসমিনকে সাধারণ সম্পাদক, চিত্রাকে সহ-সম্পাদক
ঘোষণা করেছিলেন। আর বাকিরা সবাই সদস্য। সুব্রত সভাপতি হলে কী হবে, এখন ক্লাবের কাজ
সবচেয়ে বেশি করছে অর্ক। সুব্রত এখন অর্কের সাথে বন্ধুত্ব করেছে সেজন্যই। অর্ক
সুব্রতর পাশে এসে বললো, "আসলে স্বাতীর আঁকা ছবি তো আমরা আগে দেখিনি, তাই।
তাছাড়া স্বাতী - তুই তো ক'দিন আগেই ক্যারাতের ব্ল্যাক বেল্ট পেয়েছিস। যে হাত দিয়ে
এরকম মারপিট করিস, সেই হাত দিয়ে এমন সুন্দর ছবিও আঁকিস - ওয়াও বস - জটিল।"
পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে চলে
এলো। যে ছবির কথা বলা হচ্ছে সেটা আমি এঁকেছি আমাদের ক্লাসরুমের জন্য। কিছুদিনের
মধ্যেই স্কুলে পরিদর্শক টিম আসবে। আফতাব স্যার আমাদের জিজ্ঞেস করেছিলেন ক্লাসরুম
কীভাবে সুন্দর করা যায়। তখন আমরা সবাই বলেছি - ক্লাসরুমের দেয়ালে আমরা বিজ্ঞানের
বিভিন্ন বিষয়ের ছবি টাঙিয়ে দেবো। ইতোমধ্যে আমরা সূর্য, পৃথিবী, চাঁদ, বুধ ও
শুক্রের পোস্টার তৈরি করে ফেলেছি। আমাদের মঙ্গল প্রজেক্টের কাজ শুরু হবে কয়েকদিনের
মধ্যে। ক্লাসরুমের জন্য আমি কোন বিখ্যাত বিজ্ঞানীর ছবি আঁকতে চাচ্ছিলাম। আমার
প্রিয় বিজ্ঞানী মেরি কুরি। আফতাব স্যার প্রতি বৃহস্পতিবার থার্ড ও ফোর্থ পিরিয়ডে
বিজ্ঞান ও বিজ্ঞানীদের কাহিনি বলেন। তিনি বলেছেন মেরি কুরি ও তার পরিবারের কথা।
মেরি কুরি পদার্থবিজ্ঞানে প্রথম নারী তিনি যিনি নোবেল পুরষ্কার পেয়েছিলেন। ১৯০১ থেকে
২০১৯ পর্যন্ত মোট ২১৩ জন বিজ্ঞানী পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন, তাঁদের
মধ্যে মাত্র তিন জন নারী। ১৯০৩ সালে মেরি কুরির পর ষাট বছর আর কোন নারী
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পাননি। ১৯৬৩ সালে মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ার
পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পান। তারপর আবার ৫৫ বছর অপেক্ষার পর ২০১৮ সালে
নোবেলবিজয়ী তৃতীয় নারী পদার্থবিজ্ঞানী হলেন ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড। আমি একই
ক্যানভাসে মেরি কুরি, মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ার ও ডোনা স্ট্রিকল্যান্ডের ছবি এঁকে
এনেছি আজ। সুব্রত ছবিটা দেখেই প্রশ্ন করেছে, "এই ছবি তুই এঁকেছিস?"
আফতাব স্যার ক্লাসে আসার পর ছবিটা দেখে
খুব খুশি হয়ে বললেন, "চমৎকার ছবি হয়েছে। মেরি কুরির কথা আমরা অনেকে জানলেও
মারিয়া গোয়েপার্ট-মেয়ারের কথা তেমন কেউ জানে না। আর ডোনা স্ট্রিকল্যান্ড তো মাত্র
গতবছর নোবেল পুরষ্কার পেলেন। তোমরা যে বিজ্ঞানীদের খোঁজখবর রাখো তা বোঝাই যাচ্ছে।
এই ছবি কে এঁকেছো?"
আমি হাত তুলে বললাম, "আমি একেঁছি
স্যার।"
"ভেরি গুড ভেরি গুড সাথী। অত্যন্ত
চমৎকার।"
"স্যার, আমার নাম সাথী নয়,
স্বাতী।"
"তোমার নাম সাথী নয়? ছাতি? মানে
আমব্রেলা?"
স্যারের কথা শুনে ক্লাসের সবাই হো হো
করে হেসে উঠলো। স্যারের উচ্চারণ ভয়াবহ রকমের খারাপ। চ ছ স শ এগুলো সব গুলিয়ে যায়
স্যারের কথায়। আমরা হো হো করে হাসলে স্যারও হাসেন। আফতাব স্যারকে ক্লাসে গম্ভীর
হয়ে থাকতে আমরা দেখিনি কখনো। তাই স্যারকে আমরা একটুও ভয় পাই না। বললাম,
"স্যার, ছাতি নয়, স্বাতী - স্বাতী একটি নক্ষত্র স্যার।"
"অবশ্যই। তুমি আমাদের উজ্জ্বল
নক্ষত্র শাথি।" - স্যারের ত আর থ ঠিক হবার নয়।
"তোমাদের এবারের প্রজেক্ট
কী?"
"স্যার মঙ্গল" - সুব্রতর ঝটপট
উত্তর।
"মঙ্গল বলতে কী বুঝ তোমরা?"
আফতাব স্যারের এরকম প্রশ্নে আমরা এতদিনে
অভ্যস্ত হয়ে গিয়েছি। বিজ্ঞানের কোন প্রসঙ্গ অবতারণা করার আগে স্যার এরকম অনেক প্রশ্ন
করেন। আমরা স্বতস্ফূর্তভাবে তার উত্তর দিই। অনেক সময় আমরা দুষ্টুমি করে অপ্রাসঙ্গিক
উত্তরও দিই। স্যার তাতেও রাগ করেন না। মঙ্গল বলতে আমরা সবাই এখন মঙ্গল গ্রহ বুঝলেও
অনেকে ইচ্ছে করে বিভিন্ন রকমের উত্তর দিতে শুরু করলো।
"মঙ্গলবার"
"মঙ্গলদীপ"
আমাদের
ক্লাসের সঘোষিত সঙ্গীতবিশারদ জয়নাল আবেদিন বিদ্যুৎ বেসুরো গলায় গেয়ে উঠলো,
"মঙ্গলদীপ জ্বেলে অন্ধকারে দুচোখ আলোয় ভরো প্রভু"। আমরা আবার সবাই হেসে
উঠলাম।
"আমরা বাঙালীরা মঙ্গল বলতে ভালো
কিছু বুঝি - তাই না? যেমন বলে থাকি, তোমার মঙ্গল হোক, সবার মঙ্গল হোক। মঙ্গলদীপ,
মঙ্গল শোভাযাত্রা এরকম অনেককিছু আমাদের সংস্কৃতিতে আছে। মঙ্গল গ্রহকে আমাদের
সংস্কৃতিতে খুবই ভালো শুভ একটা গ্রহ হিসেবে ধরে নেয়া হয়। অথচ এই মঙ্গল গ্রহ বা
মার্স যার নামে নামকরণ করা হয়েছে সে কিন্তু খুবই ভয়ঙ্কর দেবতা।"
আমরা আগ্রহ নিয়ে শুনি মঙ্গল গ্রহ
সম্পর্কে প্রাচীন মানুষের কী কী ধারণা ছিল। প্রাচীন মিশরীয়রা মঙ্গল গ্রহের লাল রঙ
দেখে তার নাম দিয়েছিল 'হর দেখের' বা 'লাল রঙের'। ব্যাবিলনের মানুষের কাছে মঙ্গল
গ্রহের নাম ছিল নের্গাল। নের্গাল ছিল তাদের যুদ্ধ ও ধ্বংসের দেবতা। যা কিছু
ক্ষতিকর ও ধ্বংস ডেকে আনে - তার জন্য মঙ্গল গ্রহকে দায়ী করতো ব্যাবিলনের মানুষ। প্রাচীন
গ্রিকদের যুদ্ধের দেবতার নাম ছিল অ্যারিস। তারা মঙ্গল গ্রহের নাম দিয়েছিল অ্যারিস।
রোমানদের যুদ্ধের দেবতার নাম মার্স। রোমানরা মার্সকে খুবই ভয় ও মান্য করে। মঙ্গল
গ্রহের নাম মার্স রেখেছে রোমানরা। পশুবলি দিয়ে পূজা করে তারা মার্স দেবতার। মার্স
দেবতার এক হাতে বর্শা ও অন্য হাতে বর্ম। মঙ্গল গ্রহের প্রতীক নির্ধারণ করা হয়েছে
মার্স দেবতার বর্শার ফলকের অনুকরণে।
চিত্র: মঙ্গল গ্রহের প্রতীক
হিন্দুদের
যুদ্ধের দেবতা মঙ্গল, সংস্কৃত ভাষায় মঙ্গালা। আমাদের মঙ্গলবার এসেছে মঙ্গল গ্রহের
নাম অনুসারে। ইংরেজি টুইস ডে শব্দটির উৎপত্তি টিউজ (Tiw's) থেকে। প্রোটো-ইন্দো-ইওরোপিয়ান ভাষায় দেবতা টিউজ হলো মঙ্গল গ্রহের দেবতা। গ্রহ-নক্ষত্রগুলোকে
বিভিন্ন সংস্কৃতিতে দেবতাজ্ঞানে ভক্তি করেই থেমে থাকলে কোন বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারই
হতো না। কিন্তু বিজ্ঞানে সবচেয়ে পুরনো শাখা হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞান। খালি চোখে
শুধুমাত্র দেখে দেখেই জ্যোতির্বিজ্ঞানের চর্চা শুরু হয়েছিল। দূরবীক্ষণ যন্ত্র
আবিষ্কারের পর জ্যোতির্বিজ্ঞানে বিপ্লব ঘটে যায়।
১৬১০ সালে ইতালিয়ান জ্যোতির্বিজ্ঞানী গ্যালিলিও
গ্যালিলি তাঁর নিজের তৈরি টেলিস্কোপ তাক করলেন আকাশে। তিনি সূর্যের বুকের কালো
কালো দাগ দেখলেন, চাঁদের পাহাড় দেখলেন, শুক্র গ্রহের বিভিন্ন দশা দেখলেন,
বৃহস্পতির চাঁদ দেখলেন, আর দেখলেন মঙ্গল গ্রহ। কিন্তু গ্যালিলিওর দূরবীক্ষণ
যন্ত্রটি তেমন শক্তিশালী ছিল না বলে মঙ্গল গ্রহের কোন দশা তিনি দেখতে পাননি।
সময়ের সাথে টেলিস্কোপ প্রযুক্তির উন্নতি
হচ্ছিলো। যাদের সামর্থ্য আছে তাদের অনেকেই দূরবীণে চোখে রেখে আকাশের তারা দেখতে
শুরু করলো। ইতালির আইনজীবী ফ্রান্সিসকো ফনটানা একটি দূরবীণ কিনে মঙ্গল গ্রহের দিকে
তাক করলেন। গ্যালিলিওর টেলিস্কোপের চেয়েও
উন্নত ছিল তাঁর টেলিস্কোপ। নেপল্স শহর থেকে মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ করে ১৬৩৬ সালে
মঙ্গল গ্রহের একটি চিত্র আঁকেন ফান্সিসকো ফনটানা। ওটাই ছিল মঙ্গল গ্রহের প্রথম
স্কেচ। ফনটানা গোলাকার বৃত্তের মাঝখানে একটি গাঢ় কালো চাকতি এঁকেছিলেন। নেদারল্যান্ডের
জ্যোতির্বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান হাইগেনস ১৬৫৯ সালে তিনি মঙ্গল গ্রহের স্কেচ
এঁকেছিলেন বৃত্তাকার গ্রহটির মাঝখানে ইংরেজি ভি অক্ষরের মত কালো কালো দাগ দিয়ে। মনে
করা হয়েছিল সেগুলো মঙ্গলের সমুদ্র। ক্রিস্টিয়ান হাইগেন মঙ্গল গ্রহের নিজের অক্ষে
ঘূর্ণনের সময়কাল হিসেব করেছিলেন। হাইগেনের হিসেবে নিজের অক্ষের উপর একবার ঘুরতে
মঙ্গল গ্রহের সময় লাগে ২৪ ঘন্টা, যা পৃথিবীর ঘূর্ণন কালের সমান। পরে দেখা গেছে সেই
সময়ে করা হাইগেনের হিসাব সঠিক হিসেবের খুব কাছাকাছি ছিল। মঙ্গল গ্রহ নিজের অক্ষে
একবার ঘুরতে সময় নেয় ২৪ ঘন্টা ৩৭ মিনিট ২৩ সেকেন্ড। অর্থাৎ মঙ্গলের এক দিন পৃথিবীর
এক দিনের চেয়ে ৩৭ মিনিট ২৩ সেকেন্ড লম্বা। হাইগেন মঙ্গল গ্রহের ব্যাসও নির্ণয়
করেছিলেন যা ছিল পৃথিবীর ব্যাসের ৬০%।
সেই সময় ফ্রান্সে মানমন্দির প্রতিষ্ঠিত
হয়েছিল। অবজারভেটরি অব প্যারিসের প্রথম পরিচালক নিযুক্ত হয়েছিলেন ইতালিয়ান বংশোদ্ভূত
জ্যোতির্বিদ জিওভান্নি দোমেনিকো ক্যাসিনি। ক্যাসিনি মঙ্গল গ্রহ পর্যবেক্ষণ করতে
শুরু করেছিলেন ১৬৬০ সালে। ক্যাসিনি মঙ্গলের দিনের দৈর্ঘ্য হিসেব করে বের করেছিলেন
- ২৪ ঘন্টা ৪০ মিনিট, যা সঠিক হিসেবের খুবই কাছাকাছি। ১৭৭৭ সালে ইংরেজ জ্যোতির্বিদ
উইলিয়াম হার্সেল মঙ্গল গ্রহকে আরো সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করেন। তিনি খুবই সঠিকভাবে
মঙ্গল গ্রহের দিনের দৈর্ঘ্য হিসেব করেন ২৪ ঘন্টা ২৯ মিনিট ২১ সেকেন্ড।
উনবিংশ শতাব্দীতে অনেক
জ্যোতির্বিজ্ঞানীর অক্লান্ত প্রচেষ্টায় মঙ্গল গ্রহের সঠিক ও বিস্তারিত মানচিত্র
তৈরি করা সম্ভব হয়েছে। মঙ্গল গ্রহের
মানচিত্র তৈরির সময় জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের সবাই একমত হন যে মঙ্গলের কালো গাঢ় দাগগুলো
হলো সমুদ্র, আর হালকা দাগগুলো হলো মহাদেশ। মঙ্গল গ্রহের বিভিন্ন জায়গার নাম দেয়া
হয় প্রয়াত জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের নামে। যেমন, ক্যাসিনি ল্যান্ড, হারসেল স্ট্রেইট,
মারাল্ডি সি, মাড়লার কন্টিনেন্ট ইত্যাদি। ১৮৬৯ সালে ইংল্যান্ডে জ্যোতির্বিজ্ঞানী
রিচার্ড প্রক্টর একটি বিস্তারিত ম্যাপ প্রকাশ করেন যেখানে মঙ্গলে সমুদ্র ও নদীর
অবস্থান দেখানো হয়েছে।
১৮৭৭ সালে ইউ এস নেভাল অবজারভেটরির
টেলিস্কোপের সাহায্যে মঙ্গল গ্রহের দুইটি উপগ্রহের সন্ধান পেলেন আমেরিকান
জ্যোতির্বিজ্ঞানী আসাফ হল। উপগ্রহ দুটোর নাম দেয়া হলো ফোবোস ও ডিমোস। ফোবোস শব্দের
অর্থ ভয় ও ডিমোস শব্দের অর্থ আতঙ্ক। একই বছর ইতালিতে অবজারভেটরি অব ব্রেরার
পরিচালক জিওভান্নি শিয়াপারেল্লি ২৫ সেন্টিমিটার ব্যাসের একটি শক্তিশালী টেলিস্কোপ
দিয়ে মঙ্গল পর্যবেক্ষণ করেন এবং আরো বিস্তারিত ম্যাপ তৈরি করেন। মঙ্গলের ভূমিতে
বিদ্যমান বিভিন্ন প্রতিবেশের বিভিন্ন জায়গার নাম দেয়ার সময় তিনি ল্যাটিন শব্দ এবং
বিভিন্ন পৌরাণিক কাহিনি ও বাইবেলের চরিত্রের নাম ব্যবহার করেন। যেমন, উত্তর
গোলার্ধের সবচেয়ে উজ্জ্বল বিন্দুটির নাম দেন নিক্স অলিম্পিকা, অর্থাৎ অলিম্পিকের
তুষার। পরে দেখা যায় এটা মঙ্গল গ্রহের সবচেয়ে বড় আগ্নেয়গিরি। এটার বর্তমান নাম
অলিম্পাস মোন্স। অনুজ্জ্বল কালো দাগগুলোকে বিবেচনা করা হয় সমুদ্র, আর উজ্জ্বল
অংশগুলোকে ধরা হয় কঠিন ভূমি। শিয়াপারেল্লি মঙ্গলে সাগর, উপসাগর, হ্রদ ইত্যাদির
পাশাপাশি কালো কালো লম্বা সমান্তরাল অনেকগুলো রেখাকে মনে মনে করলেন চ্যানেল -
ল্যাটিন ভাষায় যার নাম ক্যানালি। সেই ম্যাপ প্রকাশিত হবার পর ইংরেজি ভাষার
সাংবাদিকরা ক্যানালি (cannale)-কে অনুবাদ করলেন ক্যানাল (canals) - যার অর্থ হলো খাল।
মঙ্গল গ্রহের গবেষণায় বোস্টনের বিজ্ঞানী
পারসিভ্যাল লাওয়েলের অবদান অনেক। খুবই ধনী পরিবারে জন্ম পারসিভ্যাল লাওয়েলের। মঙ্গলের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে নিজের ইচ্ছেমতো গ্রহ
পর্যবেক্ষণ করার জন্য তিনি নিজস্ব একটি মানমন্দির তৈরি করলেন আরিজোনার
ফ্ল্যাগস্টাফে। নিজের নামে নাম দিলেন মানমন্দিরের - লাওয়েল অবজারভেটরি। ১৮৯৪ সাল
থেকে পরবর্তী অনেক বছর ধরে তিনি তাঁর মানমন্দিরে সেই সময়ের সবচেয়ে উন্নত
টেলিস্কোপের সাহায্যে মহাকাশের গ্রহ পর্যবেক্ষণ করেছেন।
১৯২৪ সালে আমেরিকান জ্যোতির্বিজ্ঞানী
উইলিয়াম কোবলেন্টজ ও কার্ল ল্যামপ্ল্যান্ড মঙ্গল গ্রহের তাপমাত্রা মাপতে সক্ষম হন।
তাঁরা হিসেব করে বের করেছেন- মঙ্গল গ্রহের দিনের তাপমাত্রা +১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস,
আর রাতের তাপমাত্রা -৭০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই তাপমাত্রার পার্থক্যের কারণ হিসেবে
ধরে নেয়া হলো যে মঙ্গল গ্রহে পানি আছে বলেই বাতাসে প্রচুর জলীয় বাষ্প আছে। আর পানি
আছে যেখানে প্রাণীও নিশ্চয় আছে। পরবর্তী চল্লিশ বছর পর্যন্ত মঙ্গল গ্রহে তরল পানি
আছে কি নেই সে প্রশ্নের নিশ্চিত সমাধান পাওয়া যায়নি। ১৯৬০-এর দশকে শুরু হয়ে গেলো
মহাকাশ জয়ের চেষ্টা। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন পাল্লা দিয়ে আকাশে স্যাটেলাইট
পাঠানো শুরু করলো। ১৯৬২ সালে তদানীন্তন সোভিয়েত ইউনিয়ন যখন মঙ্গলের উদ্দেশ্যে
স্যাটেলাইট মার্স-১ পাঠালো শুরু হলো নতুন অধ্যায়।
আপনার শুভ(মঙ্গল) ইচ্ছাকে অভিবাদন স্যার ।
ReplyDeleteঅনেক ধন্যবাদ। মঙ্গল গ্রহের সাথে তথাকথিত মঙ্গলের কোন সংযোগ নেই।
Delete