Sunday, 28 September 2025

তেজস্ক্রিয় সুপারহিরো: কল্পনা ও বিজ্ঞান

 




নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ডক্টর রবার্ট ব্রুস ব্যানারকে আমরা অনেকেই চিনি। তাঁর চেয়েও বেশি চিনি তাঁর দ্বিতীয় সত্ত্বা হাল্ক-কে যিনি রেগে গেলে মানুষ থেকে প্রচন্ড শক্তিশালী ‘দৈত্য’ হয়ে ওঠেন এবং সবকিছু ভেঙে তছনছ করে ফেলেন। দুটো চরিত্রই কাল্পনিক; একটুখানি বিজ্ঞানের সাথে অনেকখানি কল্পনার মিশেলে তৈরি। এরকম আরো অনেক সুপারহিরো-সুপারভিলেনের চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে কমিক বইতে, গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমায় টেলিভিশনে।

কার্টুনের মাধ্যমে গল্প বলার নতুন ধারা কমিক বইয়ের প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৯৭ সালে “দ্য ইয়েলো কিড ইন ম্যাকফ্যাডেন্স ফ্ল্যাটস”প্রকাশের মাধ্যমে। কল্পবিজ্ঞানের প্রথম সুপারহিরো সুপারম্যান। ১৯৩৮ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যালাইড পাব্লিকেশান্স থেকে প্রকাশিত ‘অ্যাকশান কমিক্স’-এর প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছিল সুপারম্যানের যাত্রা।

সেইসময় পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নভোযান প্রস্তুত করছিলেন মহাকাশে অভিযান শুরু করার লক্ষ্যে। তারই প্রতিফলন ঘটছিলো অ্যাকশান কমিক্সের চরিত্রগুলোতে। সুপারম্যানের জন্ম ক্রিপটন নামক এক কাল্পনিক গ্রহে – যে গ্রহ লাল নক্ষত্র রাও-এর চারপাশে ঘুরে। ক্রিপটনের বিজ্ঞানী দম্পতি জর-এল এবং লারা-এল যখন দেখলেন তাঁদের গ্রহ ক্রিপটন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে – তখন তাঁরা ছোট্ট একটি মহাকাশযান তৈরি করে তাঁদের একমাত্র সন্তান ক্যাল-এলকে সেখানে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর ক্রিপটন গ্রহ ধ্বংস হয়ে যায়। কাল-এল নানারকম মহাকাশ পেরিয়ে এসে পৌঁছায় পৃথিবী নামক গ্রহে। এখানেই কাল-এল পেয়ে যায় প্রচন্ড শক্তি, প্রচন্ড গতি, উড়ার ক্ষমতা, এক্স-রের মতো দৃষ্টিক্ষমতা। হয়ে ওঠে আমাদের সুপারম্যান।

সুপারম্যানের জনপ্রিয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একের পর এক তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন সুপারহিরো – সুপারভিলেন। ব্যাটম্যান, জোকার, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ওয়ান্ডার ওম্যান, সুপারগার্ল, স্পাইডারম্যান, হাল্ক, থর, এক্স-ম্যান, আয়রন-ম্যান – সবাই শারীরিকভাবে প্রচন্ড শক্তিশালী – প্রচলিত প্রমাণিত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের অনেক নিয়মই এদের ক্ষেত্রে খাটে না। এরা মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে কাজ করতে পারে, নিউটনের গতির সূত্র কিংবা শক্তির সংরক্ষণশীলতার ক্ষমতা নেই এদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করার। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ কিংবা সার্বিক কোন আইনই এরা মানে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তাত্ত্বিক টানেলিং কিংবা এন্টেঙ্গেলমেন্ট-এর অসম্ভবকে এরা বাস্তবেই কাজে লাগাচ্ছে অবলীলায়। বাস্তব বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ঘুচিয়ে দিয়েছে কল্পনার এই চরিত্রগুলো।

সুপারহিরোদের অনেকের ভেতরের অফুরন্ত শক্তির উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে। কল্পবিজ্ঞানের গল্প তৈরি করতে গিয়ে বিকিরণ বিজ্ঞানের অপব্যবহার করা হয়েছে সবক্ষেত্রেই। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।

(১) দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক: আমেরিকার একটি সরকারি গবেষণাগারের নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী ব্রুস ব্যানার ছিলেন নিখুঁত ভদ্রলোক। খুবই দায়িত্বশীল মানবিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন এই বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে একটি ‘গামা বোমা’ তৈরি করছিলেন। বোমা তৈরির পর ওটার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করার সময় তিনি দেখতে পেলেন বিপদসীমার মধ্যে হঠাৎ এসে পড়েছে একজন তরুণ। রিক জোন্স নামের এই তরুণকে বাঁচাতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন ব্রুস ব্যানার। তেজস্ক্রিয় গামা রশ্মির প্রভাবে তার শরীরের কোষ এবং স্নায়ুকোষের ডিএনএ এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় যে – যদি তিনি কোনোভাবে রেগে যান – তাহলে তাঁর শরীরের সবগুলি পেশী এমনভাবে ফুলে উঠে যে তিনি প্রচন্ড শক্তিশালী সবুজ দৈত্য – হাল্ক-এ রূপান্তরিত হয়ে যান। রাগ যত বাড়তে থাকে তাঁর বিধ্বংসী ক্ষমতাও তত বাড়তে থাকে।

বিজ্ঞানের বাস্তবতার সাথে এই গল্প মেলাতে গেলে সমস্যা হবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে শরীরের ডিএনএর পরিবর্তন ঘটতে পারে এটা সত্য। বিকিরণের মাত্রা বেশি হলে শরীরের সবগুলি ডিএনএর গঠন ভেঙে গিয়ে বেশিরভাগ কোষ মরে গিয়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু বিকিরণের ফলে ওরকম দৈত্যে পরিণত হওয়ার মধ্যে কোনো প্রমাণযোগ্য বিজ্ঞান নেই।

(২) স্পাইডারম্যান: স্কুলছাত্র পিটার পার্কার গিয়েছিল একটি বিজ্ঞান প্রদর্শনী দেখতে। সেখানে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটি প্রদর্শনীতে একটি মাকড়শা হঠাৎ তেজস্ক্রিয় কণার প্রবাহের মাঝখানে চলে আসে এবং নিজেই তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সেই মাকড়শাটি পিটার পার্কারকে কামড় দেয়ার সাথে সাথে তেজস্ক্রিয় মাকড়শার পরিবর্তিত ডিএনএ পিটার পার্কারের শরীরে প্রবেশ করে। তাতে পিটার পার্কারের ভেতর প্রচন্ড শক্তির সঞ্চার হয়। তীব্র দৈত্যাকার মাকড়শার মতো সে খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে পারে, জাল তৈরি করে সেখানে ঝুলে থাকতে পারে – ইত্যাদি।

এই গল্পেও বিজ্ঞানের মারাত্মক অপব্যবহার করা হয়েছে। মারাত্মক বিষধর মাকড়শার কামড়ে বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে – কিন্তু মানুষ মাকড়শায় পরিণত হতে পারে না।

(৩) রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান: চায়নিজ নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী চেন লু নিজেকে জীবন্ত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটরে পরিণত করার লক্ষ্যে গবেষণাগারে নিজের উপর পরিকল্পিতভাবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটান। প্রচুর নিউক্লিয়ার বিকিরণ শোষণ করে নিজেই ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন তেজস্ক্রিয়তার উৎসে পরিণত হন এবং হয়ে ওঠেন রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান। যখন খুশি তিনি নিজের শরীর থেকে রেডিয়েশান নির্গমন করে যাকে খুশি ধ্বংস করে দিতে পারেন রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান। আবার অন্য কোন উৎস থেকে রেডিয়েশান নির্গত হলে তা  শোষণও করতে পারেন।

এই গল্পের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যে কীরকম অতিরঞ্জন তা একটু ভাবলেই বোঝা যায়। একটি ছোটখাট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর তৈরি করতেও যে পরিমাণ জটিল অবকাঠামো তৈরি করতে হয়, তার সবকিছু একজন মানুষের শরীরের ভেতরই হয়ে যাবে?

(৪) ডক্টর ম্যানহ্যাটন – পদার্থবিজ্ঞানী জন ওস্টারম্যান একটি বিপজ্জনক গবেষণা করার সময় দুর্ঘটনাবশত শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্রের মধ্যে আটকা পড়েন। তাতে তাঁর সম্পূর্ণ শরীর বাষ্পীভূত হয়ে যায়। কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেলেও তিনি মারা যাননি। কয়েক মাস পর দেখা যায় তাঁর শরীরের সবগুলি কোষ আস্তে আস্তে আবার পুনর্গঠিত হয়ে তিনি অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন নীল জেলির মতো দেখতে ‘ডক্টর ম্যানহাটন’-এ পরিণত হন যিনি ভর, শক্তি এবং সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

এখানেও বাড়াবাড়ি রকমের অতিরঞ্জিত করা হয়েছে পদার্থ ও শক্তির রূপান্তরের পদার্থবিজ্ঞানকে। পারমাণবিক বিক্রিয়ার কোন সূত্র দিয়েই এই রূপান্তর বাস্তবে সম্ভব নয়।

(৫) ফায়ারস্টর্ম – ডিসি কমিক্‌স-এর ফায়ারস্টর্মকে নিউক্লিয়ার ফিউশানের সাথে তুলনা করা হয়। গল্পে পদার্থবিজ্ঞানী মার্টিন স্টেইন এবং তার ছাত্র রনি রেমন্ড নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে একটি বিস্ফোরণের ফলে দুজন একসাথে মিশে গিয়ে সৃষ্টি হয় ফায়ারস্টর্ম – যেখান থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি পাওয়া যায়।

এখানেও যে বিজ্ঞানের বাড়াবাড়ি রকমের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুজন মানুষের এক হয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশান রিঅ্যাক্টর হয়ে যাওয়া অসম্ভব। 

(৬) ক্যাপ্টেন অ্যাটম – গল্পের ন্যাথানিয়েল অ্যাডম ছিলেন সামরিক বিজ্ঞানী। ভয়াবহ এক নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে তিনি মারা যান। কিন্তু দেখা যায় অনেক বছর পর তিনি ধাতব মানুষ রূপে আবির্ভূত হন যিনি কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে শক্তি আহরণ করতে পারেন।

এখানে কোয়ান্টাম ফিল্ডের শক্তি ও পরমাণুর জটিল তত্ত্বের অপব্যবহার করে এমন এক  জগাখিচুড়ি তৈরি করা হয়েছে যা থেকে মনে হতে পারে ধাতব পদার্থেরও প্রাণ আছে।

(৭) দ্য লিডার – মার্ভেল কমিকস এর গল্পের স্যামুয়েল স্টার্নস ছিলেন একজন ঝাড়ুদার। রেডিয়েশান ল্যাবরেটরি থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার বদলে তাঁর মগজের কোষের পরিবর্তন হয়। তিনি হয়ে যান অতিবুদ্ধিমান। বুদ্ধি দিয়ে তিনি হাল্ককে পরাজিত করতে চান।

 এখানেও তেজস্ক্রিয়তার ধর্মকে বিকৃত করা হয়েছে। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে মস্তিষ্কের কোষের বুদ্ধিমত্তা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বাস্তবে অসম্ভব।

(৮) নিউক্লিয়ার ম্যান – সুপারম্যান সিরিজের চতুর্থ সিজনে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের এমন অপব্যবহার করা হয়েছে যে আঁৎকে উঠতে হয়। গল্পে দেখানো হয়েছে – সুপারম্যানের ডিএনএ নিয়ে তা নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে যোগ করে সূর্যের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। সূর্যের সৌরশক্তির সাথে বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ম্যান – যার ভেতর সুপারম্যানের সব গুণাবলি এবং শক্তি পাওয়া যায়। সূর্যালোক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে প্রচন্ড শক্তিশালী হয় নিউক্লিয়ার ম্যান।

সূর্য থেকে মানুষের সৃষ্টির কথা কিছু প্রাচীন লোকগাথায় পাওয়া গেলেও বাস্তবে সেটা যে অসম্ভব তা সবাই জানে।

দেখা যাচ্ছে কল্পবিজ্ঞানের সবগুলি সুপারহিরোই কোনো না কোনো ভাবে রেডিয়েশানের দ্বারা প্রভাবিত। এই চরিত্রগুলির প্রায় সবগুলিই সৃষ্টি হয়েছে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতার ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে। জাপানের হিরোশিমা ও নাকাসাকি শহরের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে আমেরিকা যে ধ্বংসযুগের সূচনা করেছে তারই পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে এসব সুপারহিরো-সুপারভিলেনদের ওপর।

সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন – নিউক্লিয়ার শক্তির ধ্বংসাত্মক পরিণতি বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এসব ক্ষেত্রে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলি যেরকম যুদ্ধে মেতে ওঠে – তারই রূপক প্রতিফলন দেখানো হয়েছে এখানে কল্পবিজ্ঞানের আড়ালে।

সামাজিক উদ্দেশ্য থাকুক বা না থাকুক, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শক্তি, ধর্ম এবং ক্ষমতাকে এভাবে অতিরঞ্জিত করে এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই ভুলভাবে উপস্থাপন করে যে সুপারহিরো এবং সুপারভিলেনের চরিত্রগুলি সৃষ্টি করা হয়েছে -তার মূল উদ্দেশ্য বিনোদন। কিন্তু এই বিনোদন পরোক্ষভাবে নিউক্লিয়ার শক্তি এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করছে।

সবগুলি চরিত্রেই দেখানো হয়েছে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ থেকে শরীরের কোষের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে অদ্ভূত ক্ষমতার উৎপত্তি হয়েছে। মানুষ দৈত্যের শক্তি প্রাপ্ত হচ্ছে, উড়ার ক্ষমতা অর্জন করছে, শরীর থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি বের করে দিচ্ছে, কিংবা চোখ দিয়ে এক্স-রে নির্গমন করে সেই এক্স-রে দিয়ে সবকিছু দেখতে পাচ্ছে।

কল্পবিজ্ঞানের নামে বিজ্ঞানের যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়েছে এসব কাহিনিতে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সত্যিকারের বিজ্ঞান তাহলে কী?

বিকিরণ হলো শক্তির প্রবাহ। বিকিরণ প্রধানত দু’ধরনের হতে পারে – কণা প্রবাহের মাধ্যমে এবং তরঙ্গ প্রবাহের মাধ্যমে। ইলেকট্রন, প্রোটন, আলফা – এরকম কণা যখন তাদের স্থিতিশীল শক্তিস্তরে থাকার জন্য যেটুকু শক্তির দরকার হয় তার চেয়ে বেশি শক্তি বহন করে, তখন অন্য কোন পদার্থের সংস্পর্শে এলে সেই অতিরিক্ত শক্তির প্রভাবে পদার্থের আয়নাইজেশান বা আয়নায়ন ঘটায়। এরপরও যেটুকু শক্তি বাকি থাকে তা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের আকারে বিকীর্ণ হয়।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা জানি কোনো তরঙ্গের শক্তি নির্ভর করে তার কম্পাঙ্কের উপর। কম্পাঙ্ক যত বেশি, শক্তিও তত বেশি। কম্পাঙ্ক যত বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত ছোট। দৃশ্যমান আলোর সবচেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হলো বেগুনি। তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরো ছোট হলে হয় অতিবেগুনি। অতিবেগুনি রশ্মির চেয়েও ছোট হলো এক্স এবং গামা রশ্মি। এক্স-রে তৈরি হয় পরমাণুর ইলেকট্রনগুলির কক্ষপথ থেকে। গামা রশ্মি নির্গত হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে – প্রোটন কিংবা নিউট্রনের শক্তিস্তরের উত্তেজনা থেকে। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গামা রশ্মি নির্গমন করে।

এক্স-রে কিংবা গামা-রে আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে – তাদের কতটুকু আমাদের শরীর শোষণ করবে, কতটুকু বের করে দেবে তা নির্ভর করে এক্স-রে বা গামা-রে’র শক্তির উপর। এক্স-রে কিংবা গামা-রে শোষণ করার ফলে কোন প্রাণির শরীর কিংবা কোনো পদার্থই দীর্ঘ সময়ের জন্য তেজস্ক্রিয় বা রেডিওঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ে না। মানুষ নিজে তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়বে শুধুমাত্র তখনই – যখন কোন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ আমাদের শরীরে প্রবেশ করবে। আমাদের শরীরের ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয়। সে হিসেবে মানুষের শরীর থেকে কিছুটা বিকিরণ নির্গমন করে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই কম যে তা সূর্যের আলোর বিকিরণের মাত্রা থেকেও কম।

এবার দেখা যাক – বিকিরণের প্রভাবে শরীরে কী কী ক্ষতি হতে পারে। অতিরিক্ত বিকিরণ শরীরে প্রবেশ করলে জীবকোষের নিউক্লিয়াসে যে ডিএনএ আছে তার বন্ধন ভেঙে যেতে পারে। কম পরিমাণে ভাঙলে ডিএনএগুলি নিজেদের মেরামত করে ফেলতে পারে। কিন্তু বেশি ভেঙে গেলে কোষ মরে যায়। খুব বেশি কোষ একসাথে মরে গেলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হয়, অঙ্গ কার্যকারিতা হারায়। শরীরের বেশিরভাগ কোষ দ্রুত মরে গেলে মানুষ মারা যেতে পারে। কিন্তু বিকিরণের প্রভাবে মানুষ কিছুতেই নিজে নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন হয়ে উঠতে পারে না।

কোষের ডিএনএ গুলির বন্ধন যদি ভেঙে যায়, শরীরের স্বয়ংক্রিয় মেরামত পদ্ধতির মাধ্যমে শরীর সেই ভগ্নবন্ধন জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা করে। সেই জোড়া লাগাতে গিয়ে অনেক সময় কিছু উলটোপালটা ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় তাতে ডিএনএ-র ত্রুটি নিয়ে কোষ বিভাজন ঘটে। ফলে ক্যান্সার কোষের উৎপত্তি হতে পারে। বিকিরণের প্রভাবে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা এখান থেকেই তৈরি হয়। কিন্তু বিকিরণের প্রভাবে কোনোভাবেই ‘হাল্ক’ বা ‘স্পাইডারম্যান’ হবার সম্ভাবনা নেই। মস্তিষ্কের কোষ যদি অতিরিক্ত বিকিরণ শোষণ করে – নিউরনের মৃত্যু ঘটে। মস্তিষ্ক কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। কিন্তু উলটোটা হবার সম্ভাবনা নেই – অর্থাৎ বিকিরণের প্রভাবে মানুষ কখনও হঠাৎ বোকা থেকে অতিবুদ্ধিমান হয়ে উঠবে না।

কল্পনার সুপারহিরোদের কার্যক্ষমতাকে আমরা যতক্ষণ রূপকথার গল্পের জায়গায় রেখে দেবো ততক্ষণ কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তাকে বিজ্ঞানের জায়গায় রাখতে গেলে আশা করি ভাবনাচিন্তা করে রাখবেন।

 

তথ্যসূত্র

১। বেরি ফিৎজারাল্ড, ফিজিক্স এডুকেশন, সংখ্যা ৫৪, ০১৫০১৯ (২০১৯)।

২। মার্ক ব্রেইক, দ্য সায়েন্স অব সুপারহিরোস, রেসহর্স পাবলিশিং, নিউইয়র্ক, ২০১৮।

৩। জেমস কাকালিওস, দ্য ফিজিক্স অব সুপারহিরোস, গোথাম বুকস, নিউইয়র্ক, ২০০৯।

____________

বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত






No comments:

Post a Comment

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts