Sunday, 28 September 2025

তেজস্ক্রিয় সুপারহিরো: কল্পনা ও বিজ্ঞান

 




নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী ডক্টর রবার্ট ব্রুস ব্যানারকে আমরা অনেকেই চিনি। তাঁর চেয়েও বেশি চিনি তাঁর দ্বিতীয় সত্ত্বা হাল্ক-কে যিনি রেগে গেলে মানুষ থেকে প্রচন্ড শক্তিশালী ‘দৈত্য’ হয়ে ওঠেন এবং সবকিছু ভেঙে তছনছ করে ফেলেন। দুটো চরিত্রই কাল্পনিক; একটুখানি বিজ্ঞানের সাথে অনেকখানি কল্পনার মিশেলে তৈরি। এরকম আরো অনেক সুপারহিরো-সুপারভিলেনের চরিত্র সৃষ্টি হয়েছে কমিক বইতে, গল্পে, উপন্যাসে, সিনেমায় টেলিভিশনে।

কার্টুনের মাধ্যমে গল্প বলার নতুন ধারা কমিক বইয়ের প্রথম যাত্রা শুরু হয়েছিল ১৮৯৭ সালে “দ্য ইয়েলো কিড ইন ম্যাকফ্যাডেন্স ফ্ল্যাটস”প্রকাশের মাধ্যমে। কল্পবিজ্ঞানের প্রথম সুপারহিরো সুপারম্যান। ১৯৩৮ সালে আমেরিকার ন্যাশনাল অ্যালাইড পাব্লিকেশান্স থেকে প্রকাশিত ‘অ্যাকশান কমিক্স’-এর প্রথম সংখ্যা থেকে শুরু হয়েছিল সুপারম্যানের যাত্রা।

সেইসময় পৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা নভোযান প্রস্তুত করছিলেন মহাকাশে অভিযান শুরু করার লক্ষ্যে। তারই প্রতিফলন ঘটছিলো অ্যাকশান কমিক্সের চরিত্রগুলোতে। সুপারম্যানের জন্ম ক্রিপটন নামক এক কাল্পনিক গ্রহে – যে গ্রহ লাল নক্ষত্র রাও-এর চারপাশে ঘুরে। ক্রিপটনের বিজ্ঞানী দম্পতি জর-এল এবং লারা-এল যখন দেখলেন তাঁদের গ্রহ ক্রিপটন ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে – তখন তাঁরা ছোট্ট একটি মহাকাশযান তৈরি করে তাঁদের একমাত্র সন্তান ক্যাল-এলকে সেখানে তুলে দিয়েছিলেন। এরপর ক্রিপটন গ্রহ ধ্বংস হয়ে যায়। কাল-এল নানারকম মহাকাশ পেরিয়ে এসে পৌঁছায় পৃথিবী নামক গ্রহে। এখানেই কাল-এল পেয়ে যায় প্রচন্ড শক্তি, প্রচন্ড গতি, উড়ার ক্ষমতা, এক্স-রের মতো দৃষ্টিক্ষমতা। হয়ে ওঠে আমাদের সুপারম্যান।

সুপারম্যানের জনপ্রিয়তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে একের পর এক তৈরি হতে থাকে নতুন নতুন সুপারহিরো – সুপারভিলেন। ব্যাটম্যান, জোকার, ক্যাপ্টেন আমেরিকা, ওয়ান্ডার ওম্যান, সুপারগার্ল, স্পাইডারম্যান, হাল্ক, থর, এক্স-ম্যান, আয়রন-ম্যান – সবাই শারীরিকভাবে প্রচন্ড শক্তিশালী – প্রচলিত প্রমাণিত প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানের অনেক নিয়মই এদের ক্ষেত্রে খাটে না। এরা মাধ্যাকর্ষণের বিপরীতে কাজ করতে পারে, নিউটনের গতির সূত্র কিংবা শক্তির সংরক্ষণশীলতার ক্ষমতা নেই এদের কাজকর্ম নিয়ন্ত্রণ করার। আইনস্টাইনের আপেক্ষিকতার বিশেষ কিংবা সার্বিক কোন আইনই এরা মানে না। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের তাত্ত্বিক টানেলিং কিংবা এন্টেঙ্গেলমেন্ট-এর অসম্ভবকে এরা বাস্তবেই কাজে লাগাচ্ছে অবলীলায়। বাস্তব বিজ্ঞানের সীমাবদ্ধতাকে ঘুচিয়ে দিয়েছে কল্পনার এই চরিত্রগুলো।

সুপারহিরোদের অনেকের ভেতরের অফুরন্ত শক্তির উৎস হিসেবে দেখানো হয়েছে তেজস্ক্রিয় বিকিরণকে। কল্পবিজ্ঞানের গল্প তৈরি করতে গিয়ে বিকিরণ বিজ্ঞানের অপব্যবহার করা হয়েছে সবক্ষেত্রেই। কয়েকটি উদাহরণ দেয়া যাক।

(১) দ্য ইনক্রেডিবল হাল্ক: আমেরিকার একটি সরকারি গবেষণাগারের নিউক্লিয়ার বিজ্ঞানী ব্রুস ব্যানার ছিলেন নিখুঁত ভদ্রলোক। খুবই দায়িত্বশীল মানবিক দায়িত্বজ্ঞানসম্পন্ন এই বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগারে একটি ‘গামা বোমা’ তৈরি করছিলেন। বোমা তৈরির পর ওটার কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করার সময় তিনি দেখতে পেলেন বিপদসীমার মধ্যে হঠাৎ এসে পড়েছে একজন তরুণ। রিক জোন্স নামের এই তরুণকে বাঁচাতে গিয়ে বোমার আঘাতে মারাত্মকভাবে আহত হন ব্রুস ব্যানার। তেজস্ক্রিয় গামা রশ্মির প্রভাবে তার শরীরের কোষ এবং স্নায়ুকোষের ডিএনএ এমনভাবে পরিবর্তিত হয়ে যায় যে – যদি তিনি কোনোভাবে রেগে যান – তাহলে তাঁর শরীরের সবগুলি পেশী এমনভাবে ফুলে উঠে যে তিনি প্রচন্ড শক্তিশালী সবুজ দৈত্য – হাল্ক-এ রূপান্তরিত হয়ে যান। রাগ যত বাড়তে থাকে তাঁর বিধ্বংসী ক্ষমতাও তত বাড়তে থাকে।

বিজ্ঞানের বাস্তবতার সাথে এই গল্প মেলাতে গেলে সমস্যা হবে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের ফলে শরীরের ডিএনএর পরিবর্তন ঘটতে পারে এটা সত্য। বিকিরণের মাত্রা বেশি হলে শরীরের সবগুলি ডিএনএর গঠন ভেঙে গিয়ে বেশিরভাগ কোষ মরে গিয়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে। কিন্তু বিকিরণের ফলে ওরকম দৈত্যে পরিণত হওয়ার মধ্যে কোনো প্রমাণযোগ্য বিজ্ঞান নেই।

(২) স্পাইডারম্যান: স্কুলছাত্র পিটার পার্কার গিয়েছিল একটি বিজ্ঞান প্রদর্শনী দেখতে। সেখানে জিনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং-এর একটি প্রদর্শনীতে একটি মাকড়শা হঠাৎ তেজস্ক্রিয় কণার প্রবাহের মাঝখানে চলে আসে এবং নিজেই তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়ে। সেই মাকড়শাটি পিটার পার্কারকে কামড় দেয়ার সাথে সাথে তেজস্ক্রিয় মাকড়শার পরিবর্তিত ডিএনএ পিটার পার্কারের শরীরে প্রবেশ করে। তাতে পিটার পার্কারের ভেতর প্রচন্ড শক্তির সঞ্চার হয়। তীব্র দৈত্যাকার মাকড়শার মতো সে খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠে যেতে পারে, জাল তৈরি করে সেখানে ঝুলে থাকতে পারে – ইত্যাদি।

এই গল্পেও বিজ্ঞানের মারাত্মক অপব্যবহার করা হয়েছে। মারাত্মক বিষধর মাকড়শার কামড়ে বিষক্রিয়ায় মানুষের মৃত্যু হতে পারে – কিন্তু মানুষ মাকড়শায় পরিণত হতে পারে না।

(৩) রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান: চায়নিজ নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানী চেন লু নিজেকে জীবন্ত নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটরে পরিণত করার লক্ষ্যে গবেষণাগারে নিজের উপর পরিকল্পিতভাবে তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ঘটান। প্রচুর নিউক্লিয়ার বিকিরণ শোষণ করে নিজেই ধ্বংসাত্মক ক্ষমতাসম্পন্ন তেজস্ক্রিয়তার উৎসে পরিণত হন এবং হয়ে ওঠেন রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান। যখন খুশি তিনি নিজের শরীর থেকে রেডিয়েশান নির্গমন করে যাকে খুশি ধ্বংস করে দিতে পারেন রেডিওঅ্যাকটিভ ম্যান। আবার অন্য কোন উৎস থেকে রেডিয়েশান নির্গত হলে তা  শোষণও করতে পারেন।

এই গল্পের নিউক্লিয়ার ফিজিক্স যে কীরকম অতিরঞ্জন তা একটু ভাবলেই বোঝা যায়। একটি ছোটখাট নিউক্লিয়ার রিঅ্যাকটর তৈরি করতেও যে পরিমাণ জটিল অবকাঠামো তৈরি করতে হয়, তার সবকিছু একজন মানুষের শরীরের ভেতরই হয়ে যাবে?

(৪) ডক্টর ম্যানহ্যাটন – পদার্থবিজ্ঞানী জন ওস্টারম্যান একটি বিপজ্জনক গবেষণা করার সময় দুর্ঘটনাবশত শক্তিশালী বিদ্যুৎক্ষেত্রের মধ্যে আটকা পড়েন। তাতে তাঁর সম্পূর্ণ শরীর বাষ্পীভূত হয়ে যায়। কিন্তু অদৃশ্য হয়ে গেলেও তিনি মারা যাননি। কয়েক মাস পর দেখা যায় তাঁর শরীরের সবগুলি কোষ আস্তে আস্তে আবার পুনর্গঠিত হয়ে তিনি অদ্ভুত ক্ষমতাসম্পন্ন নীল জেলির মতো দেখতে ‘ডক্টর ম্যানহাটন’-এ পরিণত হন যিনি ভর, শক্তি এবং সময় নিয়ন্ত্রণ করতে পারেন।

এখানেও বাড়াবাড়ি রকমের অতিরঞ্জিত করা হয়েছে পদার্থ ও শক্তির রূপান্তরের পদার্থবিজ্ঞানকে। পারমাণবিক বিক্রিয়ার কোন সূত্র দিয়েই এই রূপান্তর বাস্তবে সম্ভব নয়।

(৫) ফায়ারস্টর্ম – ডিসি কমিক্‌স-এর ফায়ারস্টর্মকে নিউক্লিয়ার ফিউশানের সাথে তুলনা করা হয়। গল্পে পদার্থবিজ্ঞানী মার্টিন স্টেইন এবং তার ছাত্র রনি রেমন্ড নিউক্লিয়ার পাওয়ার প্ল্যান্টে একটি বিস্ফোরণের ফলে দুজন একসাথে মিশে গিয়ে সৃষ্টি হয় ফায়ারস্টর্ম – যেখান থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি পাওয়া যায়।

এখানেও যে বিজ্ঞানের বাড়াবাড়ি রকমের বিকৃতি ঘটানো হয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখে না। দুজন মানুষের এক হয়ে নিউক্লিয়ার ফিউশান রিঅ্যাক্টর হয়ে যাওয়া অসম্ভব। 

(৬) ক্যাপ্টেন অ্যাটম – গল্পের ন্যাথানিয়েল অ্যাডম ছিলেন সামরিক বিজ্ঞানী। ভয়াবহ এক নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণে তিনি মারা যান। কিন্তু দেখা যায় অনেক বছর পর তিনি ধাতব মানুষ রূপে আবির্ভূত হন যিনি কোয়ান্টাম ফিল্ড থেকে শক্তি আহরণ করতে পারেন।

এখানে কোয়ান্টাম ফিল্ডের শক্তি ও পরমাণুর জটিল তত্ত্বের অপব্যবহার করে এমন এক  জগাখিচুড়ি তৈরি করা হয়েছে যা থেকে মনে হতে পারে ধাতব পদার্থেরও প্রাণ আছে।

(৭) দ্য লিডার – মার্ভেল কমিকস এর গল্পের স্যামুয়েল স্টার্নস ছিলেন একজন ঝাড়ুদার। রেডিয়েশান ল্যাবরেটরি থেকে নির্গত তেজস্ক্রিয়তায় আক্রান্ত হয়ে মারা যাবার বদলে তাঁর মগজের কোষের পরিবর্তন হয়। তিনি হয়ে যান অতিবুদ্ধিমান। বুদ্ধি দিয়ে তিনি হাল্ককে পরাজিত করতে চান।

 এখানেও তেজস্ক্রিয়তার ধর্মকে বিকৃত করা হয়েছে। তেজস্ক্রিয়তার প্রভাবে মস্তিষ্কের কোষের বুদ্ধিমত্তা বেড়ে যাওয়ার ঘটনা বাস্তবে অসম্ভব।

(৮) নিউক্লিয়ার ম্যান – সুপারম্যান সিরিজের চতুর্থ সিজনে নিউক্লিয়ার পদার্থবিজ্ঞানের সূত্রের এমন অপব্যবহার করা হয়েছে যে আঁৎকে উঠতে হয়। গল্পে দেখানো হয়েছে – সুপারম্যানের ডিএনএ নিয়ে তা নিউক্লিয়ার ক্ষেপণাস্ত্রের সাথে যোগ করে সূর্যের দিকে নিক্ষেপ করা হয়। সূর্যের সৌরশক্তির সাথে বিক্রিয়ার ফলে তৈরি হয় নিউক্লিয়ার ম্যান – যার ভেতর সুপারম্যানের সব গুণাবলি এবং শক্তি পাওয়া যায়। সূর্যালোক থেকে শক্তি সংগ্রহ করে প্রচন্ড শক্তিশালী হয় নিউক্লিয়ার ম্যান।

সূর্য থেকে মানুষের সৃষ্টির কথা কিছু প্রাচীন লোকগাথায় পাওয়া গেলেও বাস্তবে সেটা যে অসম্ভব তা সবাই জানে।

দেখা যাচ্ছে কল্পবিজ্ঞানের সবগুলি সুপারহিরোই কোনো না কোনো ভাবে রেডিয়েশানের দ্বারা প্রভাবিত। এই চরিত্রগুলির প্রায় সবগুলিই সৃষ্টি হয়েছে পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রতিযোগিতার ঠান্ডা যুদ্ধের সময়ে। জাপানের হিরোশিমা ও নাকাসাকি শহরের ওপর পারমাণবিক বোমা ফেলে আমেরিকা যে ধ্বংসযুগের সূচনা করেছে তারই পরোক্ষ প্রভাব পড়েছে এসব সুপারহিরো-সুপারভিলেনদের ওপর।

সমাজবিজ্ঞানীদের কেউ কেউ মনে করেন – নিউক্লিয়ার শক্তির ধ্বংসাত্মক পরিণতি বোঝানোর জন্য বিজ্ঞানকে রূপক হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে এসব ক্ষেত্রে। পারমাণবিক শক্তিধর দেশগুলি যেরকম যুদ্ধে মেতে ওঠে – তারই রূপক প্রতিফলন দেখানো হয়েছে এখানে কল্পবিজ্ঞানের আড়ালে।

সামাজিক উদ্দেশ্য থাকুক বা না থাকুক, তেজস্ক্রিয় বিকিরণের শক্তি, ধর্ম এবং ক্ষমতাকে এভাবে অতিরঞ্জিত করে এবং প্রায় সবক্ষেত্রেই ভুলভাবে উপস্থাপন করে যে সুপারহিরো এবং সুপারভিলেনের চরিত্রগুলি সৃষ্টি করা হয়েছে -তার মূল উদ্দেশ্য বিনোদন। কিন্তু এই বিনোদন পরোক্ষভাবে নিউক্লিয়ার শক্তি এবং তেজস্ক্রিয় বিকিরণ সম্পর্কে মানুষের মনে ভুল ধারণা তৈরি করতে সাহায্য করছে।

সবগুলি চরিত্রেই দেখানো হয়েছে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ থেকে শরীরের কোষের ডিএনএ পরিবর্তিত হয়ে অদ্ভূত ক্ষমতার উৎপত্তি হয়েছে। মানুষ দৈত্যের শক্তি প্রাপ্ত হচ্ছে, উড়ার ক্ষমতা অর্জন করছে, শরীর থেকে নিউক্লিয়ার শক্তি বের করে দিচ্ছে, কিংবা চোখ দিয়ে এক্স-রে নির্গমন করে সেই এক্স-রে দিয়ে সবকিছু দেখতে পাচ্ছে।

কল্পবিজ্ঞানের নামে বিজ্ঞানের যথেচ্ছ অপব্যবহার করা হয়েছে এসব কাহিনিতে। তেজস্ক্রিয় বিকিরণের সত্যিকারের বিজ্ঞান তাহলে কী?

বিকিরণ হলো শক্তির প্রবাহ। বিকিরণ প্রধানত দু’ধরনের হতে পারে – কণা প্রবাহের মাধ্যমে এবং তরঙ্গ প্রবাহের মাধ্যমে। ইলেকট্রন, প্রোটন, আলফা – এরকম কণা যখন তাদের স্থিতিশীল শক্তিস্তরে থাকার জন্য যেটুকু শক্তির দরকার হয় তার চেয়ে বেশি শক্তি বহন করে, তখন অন্য কোন পদার্থের সংস্পর্শে এলে সেই অতিরিক্ত শক্তির প্রভাবে পদার্থের আয়নাইজেশান বা আয়নায়ন ঘটায়। এরপরও যেটুকু শক্তি বাকি থাকে তা তড়িৎচুম্বক তরঙ্গের আকারে বিকীর্ণ হয়।

কোয়ান্টাম তত্ত্বের মাধ্যমে আমরা জানি কোনো তরঙ্গের শক্তি নির্ভর করে তার কম্পাঙ্কের উপর। কম্পাঙ্ক যত বেশি, শক্তিও তত বেশি। কম্পাঙ্ক যত বেশি তরঙ্গদৈর্ঘ্য তত ছোট। দৃশ্যমান আলোর সবচেয়ে ছোট তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো হলো বেগুনি। তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরো ছোট হলে হয় অতিবেগুনি। অতিবেগুনি রশ্মির চেয়েও ছোট হলো এক্স এবং গামা রশ্মি। এক্স-রে তৈরি হয় পরমাণুর ইলেকট্রনগুলির কক্ষপথ থেকে। গামা রশ্মি নির্গত হয় পরমাণুর নিউক্লিয়াস থেকে – প্রোটন কিংবা নিউট্রনের শক্তিস্তরের উত্তেজনা থেকে। তেজস্ক্রিয় মৌলগুলি স্বয়ংক্রিয়ভাবে গামা রশ্মি নির্গমন করে।

এক্স-রে কিংবা গামা-রে আমাদের শরীরে প্রবেশ করলে – তাদের কতটুকু আমাদের শরীর শোষণ করবে, কতটুকু বের করে দেবে তা নির্ভর করে এক্স-রে বা গামা-রে’র শক্তির উপর। এক্স-রে কিংবা গামা-রে শোষণ করার ফলে কোন প্রাণির শরীর কিংবা কোনো পদার্থই দীর্ঘ সময়ের জন্য তেজস্ক্রিয় বা রেডিওঅ্যাকটিভ হয়ে পড়ে না। মানুষ নিজে তেজস্ক্রিয় হয়ে পড়বে শুধুমাত্র তখনই – যখন কোন তেজস্ক্রিয় আইসোটোপ আমাদের শরীরে প্রবেশ করবে। আমাদের শরীরের ক্যালসিয়াম ও পটাশিয়াম সামান্য পরিমাণ তেজস্ক্রিয়। সে হিসেবে মানুষের শরীর থেকে কিছুটা বিকিরণ নির্গমন করে, কিন্তু তার পরিমাণ এতই কম যে তা সূর্যের আলোর বিকিরণের মাত্রা থেকেও কম।

এবার দেখা যাক – বিকিরণের প্রভাবে শরীরে কী কী ক্ষতি হতে পারে। অতিরিক্ত বিকিরণ শরীরে প্রবেশ করলে জীবকোষের নিউক্লিয়াসে যে ডিএনএ আছে তার বন্ধন ভেঙে যেতে পারে। কম পরিমাণে ভাঙলে ডিএনএগুলি নিজেদের মেরামত করে ফেলতে পারে। কিন্তু বেশি ভেঙে গেলে কোষ মরে যায়। খুব বেশি কোষ একসাথে মরে গেলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যহত হয়, অঙ্গ কার্যকারিতা হারায়। শরীরের বেশিরভাগ কোষ দ্রুত মরে গেলে মানুষ মারা যেতে পারে। কিন্তু বিকিরণের প্রভাবে মানুষ কিছুতেই নিজে নিউক্লিয়ার পাওয়ার স্টেশন হয়ে উঠতে পারে না।

কোষের ডিএনএ গুলির বন্ধন যদি ভেঙে যায়, শরীরের স্বয়ংক্রিয় মেরামত পদ্ধতির মাধ্যমে শরীর সেই ভগ্নবন্ধন জোড়া লাগানোর ব্যবস্থা করে। সেই জোড়া লাগাতে গিয়ে অনেক সময় কিছু উলটোপালটা ব্যাপার ঘটে যেতে পারে। অনেক সময় দেখা যায় তাতে ডিএনএ-র ত্রুটি নিয়ে কোষ বিভাজন ঘটে। ফলে ক্যান্সার কোষের উৎপত্তি হতে পারে। বিকিরণের প্রভাবে ক্যান্সার হবার সম্ভাবনা এখান থেকেই তৈরি হয়। কিন্তু বিকিরণের প্রভাবে কোনোভাবেই ‘হাল্ক’ বা ‘স্পাইডারম্যান’ হবার সম্ভাবনা নেই। মস্তিষ্কের কোষ যদি অতিরিক্ত বিকিরণ শোষণ করে – নিউরনের মৃত্যু ঘটে। মস্তিষ্ক কার্যক্ষমতা হারাতে পারে। কিন্তু উলটোটা হবার সম্ভাবনা নেই – অর্থাৎ বিকিরণের প্রভাবে মানুষ কখনও হঠাৎ বোকা থেকে অতিবুদ্ধিমান হয়ে উঠবে না।

কল্পনার সুপারহিরোদের কার্যক্ষমতাকে আমরা যতক্ষণ রূপকথার গল্পের জায়গায় রেখে দেবো ততক্ষণ কোন বিপদের সম্ভাবনা নেই। কিন্তু তাকে বিজ্ঞানের জায়গায় রাখতে গেলে আশা করি ভাবনাচিন্তা করে রাখবেন।

 

তথ্যসূত্র

১। বেরি ফিৎজারাল্ড, ফিজিক্স এডুকেশন, সংখ্যা ৫৪, ০১৫০১৯ (২০১৯)।

২। মার্ক ব্রেইক, দ্য সায়েন্স অব সুপারহিরোস, রেসহর্স পাবলিশিং, নিউইয়র্ক, ২০১৮।

৩। জেমস কাকালিওস, দ্য ফিজিক্স অব সুপারহিরোস, গোথাম বুকস, নিউইয়র্ক, ২০০৯।

____________

বিজ্ঞানচিন্তা জুলাই ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত






Tuesday, 9 September 2025

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি: ক্যান্সার চিকিৎসায় নতুন সম্ভাবনা

 



যে রোগের কাছে পৃথিবীর মানুষ সবচেয়ে বেশি অসহায় – তার নাম ক্যান্সার। প্রতি বছর ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা আশংকাজনক হারে বেড়েই চলেছে। ধারণা করা হচ্ছে পৃথিবীর প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন মানুষ তাঁর জীবদ্দশায় ক্যান্সারে আক্রান্ত হবেন।

পৃথিবীর সব দেশে ক্যান্সার রোগীর বিস্তারিত পরিসংখ্যান রাখার ব্যবস্থা আছে। তবুও অনেক দেশে অনেক মানুষ ক্যান্সার রোগে মারা যায় – রোগ শনাক্ত হবার আগেই। তাদের সংখ্যা পরিসংখ্যানে অন্তর্ভুক্ত হয় না। ক্যান্সার গবেষণার আন্তর্জাতিক সংস্থা – ইন্টারন্যাশনাল এজেন্সি ফর রিসার্চ অন ক্যান্সার (আইএআরসি) এর সাম্প্রতিকতম পরিসংখ্যান থেকে দেখা যাচ্ছে শুধুমাত্র ২০২২ সালে বিশ্বব্যাপী প্রায় দুই কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে। শুধুমাত্র এই এক বছরেই সাতানব্বই লক্ষেরও বেশি মানুষ মারা গেছে ক্যান্সারে [১]।

বিজ্ঞান, প্রযুক্তি এবং চিকিৎসাবিজ্ঞানের ব্যাপক উন্নতির ফলে মানুষের গড় আয়ু এখন অনেক বেড়ে গেছে। তার সরাসরি প্রভাব পড়ছে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যায়। দেখা যাচ্ছে মানুষ যত দীর্ঘজীবী হচ্ছে, বয়স্কদের মধ্যে ক্যান্সার রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনাও বেড়ে যাচ্ছে। ফলে প্রতি বছরই ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বাড়ছে লাফিয়ে লাফিয়ে। বর্তমান পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীতে ক্যান্সার রোগীর সংখ্যা বছরে দুই কোটি চল্লিশ লক্ষ হারে বাড়বে, আর ক্যান্সারে মৃত্যু হবে প্রায় এক কোটি বিশ লক্ষ ক্যান্সার রোগীর। ২০৪০ সালের মধ্যে এই হার আরো বেড়ে যাবে। তখন বছরে প্রায় তিন কোটি মানুষ ক্যান্সারে আক্রান্ত হবে, আর দেড় কোটিরও বেশি ক্যান্সার রোগি মারা যাবে। ২০৫০ সালে এই হার আরো বাড়বে। বছরে প্রায় সাড়ে তিন কোটি নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হবে – আর মৃত্যুর হার বেড়ে যাবে শতকরা পঞ্চাশেরও বেশি। তার মানে প্রতি দুই জন ক্যান্সার রোগীর মধ্যে একজন মারা যাবে। এই সংখ্যা আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের মুখে চড় মারার মতোই অপমানজনক।

এক সময় মনে করা হতো ক্যান্সার ধনীদের রোগ। গত শতাব্দীর পরিসংখ্যান থেকেও এর পক্ষে প্রমাণ পাওয়া যায়। আফ্রিকা মহাদেশের দরিদ্র কোন দেশের ক্যান্সার রোগীর চেয়ে অস্ট্রেলিয়ার ক্যান্সার রোগীর শতকরা হার অনেক বেশি। তার একটি প্রধান কারণ ছিল – আফ্রিকার জনগণের গড় আয়ু ছিল অস্ট্রেলিয়ার জনগণের গড় আয়ুর চেয়ে অনেক কম। ফলে ক্যান্সার হবার গড় বয়সে পৌঁছানোর অনেক আগেই আফ্রিকার মানুষ অন্য কোন নিরাময়যোগ্য রোগে মারা যাচ্ছিল। কিন্তু এখন পৃথিবী অনেক বদলে গেছে। বৈশ্বিক উন্নয়নের সুফল এবং পৃথিবীর আনাচে কানাচে পৌঁছে গেছে। পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই এখন মানুষের গড় আয়ু বেড়ে গেছে। এখন ক্যান্সার আর শুধুমাত্র বড়লোকের রোগ নয়।

কিন্তু সমস্যা রয়ে গেছে অন্য জায়গায়। ক্যান্সার রোগের প্রচলিত চিকিৎসাব্যবস্থা ভীষণ প্রযুক্তিনির্ভর এবং ব্যয়বহুল বলে ক্যান্সার চিকিৎসা এখনো সর্বজনীন হয়ে উঠতে পারেনি। ফলে দেখা যাচ্ছে ধনীদেশে ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হার দরিদ্রদেশের ক্যান্সার রোগীর মৃত্যুর হারের চেয়ে অনেক কম।

২০২২ সালে বাংলাদেশে নতুন ক্যান্সার রোগী শনাক্ত হয়েছে এক লক্ষ সাতষট্টি হাজার। আর একই বছর ক্যান্সারে প্রাণ হারিয়েছেন প্রায় এক লক্ষ সতের হাজার মানুষ। বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগ শনাক্ত করার ব্যাপারে নানারকম অসুবিধা আছে। আমাদের চিকিৎসাব্যবস্থা বিভিন্ন কারণে খুবই নাজুক। অনেক রোগীই ক্যান্সারে মারা যান ক্যান্সার শনাক্ত হওয়ার আগেই, অথবা একেবারে শেষ পর্যায়ে শনাক্ত হওয়ার পর। তাই বাংলাদেশে ক্যান্সার রোগীর বার্ষিক মৃত্যুর হার সত্তর শতাংশেরও বেশি।

ক্যান্সার রোগের যে কোনো চিকিৎসা নেই – তা নয়। এই রোগের বিভিন্ন ধরনের চিকিৎসা আছে এবং তাতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক রোগী সুস্থও হচ্ছে। কিন্তু এই রোগের প্রধান সমস্যা হচ্ছে – এই রোগ হবার মূল কারণ এখনো অজানা। সেজন্য ক্যান্সার প্রতিরোধ করারও সুনির্দিষ্ট কোনো উপায় এখনো চিকিৎসাবিজ্ঞানীরা খুঁজে বের করতে পারেননি। মূল কারণ অজানা বলেই – ক্যান্সারের প্রতি মানুষের প্রচন্ড ভীতি যেমন রয়েছে, তেমনি একে কেন্দ্র করে নিত্যই প্রচারিত হচ্ছে নানারকম মতামত। যে মতামতের বেশিরভাগই এখনো অমীমাংসিত।

ক্যান্সার রোগের মূল কারণ শনাক্ত করা না গেলেও ক্যান্সার রোগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে যেটুকু বলা যায় – সেটুকু হলো – ক্যান্সার কোনো জীবাণুবাহিত রোগ নয়। ক্যান্সার হলো কোষঘটিত রোগ। স্বাভাবিক কোষ শরীরের ভেতর ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হয়। এই রূপান্তরের পদ্ধতি সম্পর্কে বিজ্ঞানীরা জানতে পারলেও কোনো স্বাভাবিক কোষ কখন ক্যান্সার কোষে রূপান্তরিত হবে তা বলা যায় না। ক্যান্সার কোষের রূপান্তর বৈজ্ঞানিকভাবে অনুমান করা গেলেও – কেন এই রূপান্তর ঘটে তা এখনো অজানা।

কোষের কর্মপদ্ধতি লেখা থাকে তার ডিএনএ-তে। দেখা যায় স্বাভাবিক কোষ এবং ক্যান্সার কোষের ডিএনএ-তে পার্থক্য থাকে। কোষের ডিএনএ-র অস্বাভাবিক পরিবর্তনের ফলে স্বাভাবিক কোষের কাজকর্ম অস্বাভাবিক হয়ে ক্যান্সার কোষে পরিণত হয়। ক্যান্সার কোষ তখন দেহের স্বাভাবিক জৈবনির্দেশ মেনে চলে না। একটি স্বাভাবিক কোষ একটি নির্দিষ্ট সংখ্যক বার বিভাজনের পর স্বাভাবিকভাবে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু ক্যান্সার কোষ স্বাভাবিক মৃত্যুনির্দেশিকা মেনে চলে না। তাই ক্যান্সার কোষকে যেকোনো উপায়ে মেরে ফেলাই হলো ক্যান্সার চিকিৎসার মূল ভিত্তি।

ক্যান্সার চিকিৎসার প্রচলিত পদ্ধতিগুলির মধ্যে প্রধান পদ্ধতি হলো তেজস্ক্রিয় বিকিরণ বা রেডিয়েশান প্রয়োগ করে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করা। কীভাবে এই তেজস্ক্রিয় বিকিরণ ক্যান্সার কোষযুক্ত টিউমারে পাঠানো হবে – তার উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠেছে ক্যান্সার চিকিৎসার বিভিন্ন পদ্ধতি। 

বেশিরভাগ ক্যান্সার রোগীকে ক্যামোথেরাপি দেয়া হয়। ক্যামোথেরাপিতে রাসায়নিক তেজস্ক্রিয় পদার্থ শরীরে প্রবেশ করিয়ে ক্যান্সার কোষে পাঠানো হয়। যদি সার্জারি করে ক্যান্সার টিউমার অপসারণ করা সম্ভব হয় – তাহলে সার্জারি করা হয়। অর্ধেকের কাছাকাছি রোগীকে শরীরের বাইরে থেকে রেডিয়েশান দেয়া হয় – যাকে রেডিওথেরাপি বলা হয়। রেডিওথেরাপি ক্যান্সার চিকিৎসার দীর্ঘদিনের নির্ভরযোগ্য পদ্ধতি।

ক্যান্সার কোষকে ধ্বংস করে ক্যান্সার নির্মূল করার ব্যাপারটি কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে ক্যান্সার কোষগুলির স্বাভাবিক কোষের সাথে মিলেমিশে থাকার কারণে। সবগুলি ক্যান্সার কোষকে একসাথে ধ্বংস করে ফেলা সম্ভব হচ্ছে না – কারণ তাতে ক্যান্সার কোষের আশেপাশে থাকা স্বাভাবিক কোষগুলিও ধ্বংস হয়ে যাবে। শরীরের স্বাভাবিক কোষ যদি অতিমাত্রায় ধ্বংস হয়ে যায় – তাহলে শরীরের স্বাভাবিক কাজকর্ম ব্যাহত হয়ে রোগীর হিতে বিপরীত হবে। তাই প্রচলিত পদ্ধতিতে রেডিওথেরাপি এমনভাবে দেয়া হয় – যেন ক্যান্সার কোষগুলি ধ্বংস হয়, কিন্তু স্বাভাবিক কোষগুলির কার্যক্রম অটুট থাকে [২]।

রেডিয়েশানের ক্ষতিকর দিক থেকে স্বাভাবিক কোষগুলিকে রক্ষা করার জন্য প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে ক্যান্সার কোষ ও স্বাভাবিক কোষের কিছু জীববৈজ্ঞানিক পার্থক্যকে কাজে লাগানো হয়। যেমন স্বাভাবিক কোষ স্বয়ংক্রিয়ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ডিএনএ-কে সারিয়ে তুলতে পারে যদি তাদের পর্যাপ্ত সময় দেয়া হয়। প্রচলিত রেডিওথেরাপি পদ্ধতিতে তাই একসাথে অধিক মাত্রায় রেডিয়েশান প্রয়োগ করার পরিবর্তে নির্দিষ্ট সময় পরপর কম মাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগ করা হয়। একবার রেডিয়েশান দেয়ার পর থেকে আরেকবার রেডিয়েশান দেয়ার আগ পর্যন্ত যে সময় (সাধারণত চব্বিশ ঘন্টা) – সেই সময়ে ক্যান্সার কোষের সাথে যেসব স্বাভাবিক কোষ রেডিয়েশানের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে – তারা নিজেদের সুস্থ করে নিতে পারে (ডিএনএ সংশোধন)। ক্যান্সার কোষগুলির সাধারণত সেই ক্ষমতা থাকে না।

ক্যান্সার কোষগুলিতে সাধারণত অক্সিজেন প্রবাহের পরিমাণ থাকে স্বাভাবিক কোষগুলির চেয়ে কম। অক্সিজেন প্রবাহ কম থাকলে রেডিয়েশানের কার্যকারিতা কমে যায়। ফলে হাইপোক্সিক বা কম অক্সিজেনযুক্ত ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে গেলে যে মাত্রার রেডিয়েশান দিতে হবে – সেই মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষগুলি অনেক বেশি ধ্বংসপ্রাপ্ত হবে বলে রেডিয়েশানের মাত্রা কম রাখতে হয়। ফলে রোগীর চিকিৎসা করতে হয় দীর্ঘদিন এবং খরচ ও ভোগান্তিও বেড়ে যায়।

রেডিওথেরাপিকে আরো উন্নত করার চেষ্টা করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকে। কিছুটা সুফল পাওয়া গেলেও তেমন কোন যুগান্তকারী পরিবর্তন সেখানে ঘটেনি। কিন্তু সম্প্রতি ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি নামে এক নতুন ধরনের অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে ক্যান্সার চিকিৎসায় অস্বাভাবিক সুফল পাওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিজ্ঞানীরা [৩,৪]।

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি এমন একটি প্রযুক্তি যা অতিস্বল্প সময়ে (মিলিসেকেন্ডের মধ্যে) অতি উচ্চ মাত্রার রেডিয়েশন (সেকেন্ডে চল্লিশ গ্রের অধিক) শরীরে প্রয়োগ করে। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে মাত্র কয়েক গ্রে রেডিয়েশান দিতে যেখানে কয়েক মিনিট সময় লাগে,  সেখানে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি মাত্র এক সেকেন্ডেরও কম সময়ে নির্ধারিত ডোজ প্রয়োগ করে। আশ্চর্যের ব্যাপার হচ্ছে এই দ্রুতগতির অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশন স্বাভাবিক কোষের ক্ষতি কমিয়ে ক্যান্সার কোষ ধ্বংসে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। প্রশ্ন হলো -  কীভাবে? যেখানে খুব কম মাত্রার রেডিয়েশানে স্বাভাবিক কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়, সেখানে অতিউচ্চমাত্রার রেডিয়েশান স্বাভাবিক কোষ কীভাবে সহ্য করবে?

ইঁদুর ও শূকরের উপর পরিচালিত গবেষণায় দেখা গেছে এটি কার্যকরভাবে ক্যান্সার কোষ ধ্বংস করতে পারে এবং স্বাভাবিক কোষ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২০১৯ সালে সুইজারল্যান্ডে প্রথমবারের মতো একজন মানুষের উপর পরীক্ষামূলকভাবে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করা হয়েছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ক্লিনিক্যাল ট্রায়াল চলছে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিত কার্যকারিতা যাচাইয়ের জন্য। বিজ্ঞানীরা বিভিন্ন মতবাদ পরীক্ষা করে দেখছেন ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার সঠিক কারণ খুঁজে বের করতে।

অতি অল্প সময়ে অতিমাত্রার রেডিয়েশান প্রয়োগে স্বাভাবিক কোষ বেঁচে যাবার ব্যাপারে সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য যে তত্ত্ব বিজ্ঞানীরা দিচ্ছেন সেটা হলো অক্সিজেন হ্রাস তত্ত্ব বা অক্সিজেন ডিপ্লেশান হাইপোথিসিস। 

প্রচলিত কম মাত্রার রেডিওথেরাপিতে রেডিয়েশান জৈবকোষে রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটিয়ে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করে। কোষে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে এই ফ্রি র‍্যাডিক্যাল ক্ষতিকর পার-অক্সাইডে পরিণত হয় যা ডিএনএর ক্ষতি করে। কোষে উপস্থিত অক্সিজেন ডিএনএর এই ক্ষতিকে স্থায়ী ক্ষতে পরিণত করে – ফলে কোষ স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে না। কিন্তু কোষে যদি অক্সিজেন কম থাকে বা না থাকে, এই ক্ষতিকর ফ্রি র‍্যাডিক্যালগুলি ডিএনএর স্থায়ী কোন ক্ষতি করতে পারে না। ফলে ডিএনএ ক্ষতিগ্রস্ত হলেও কোষের স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এই অস্থায়ী ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে পারে, ডিএনএ নিজে নিজে সংশোধিত হয়ে যায়।

ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপিতে মিলিসেকেন্ডের মধ্যে অনেক বেশি মাত্রার রেডিয়েশন দেয়া হয়। এই উচ্চমাত্রার রেডিয়েশন বিপুল পরিমাণে ফ্রি র‍্যাডিক্যাল তৈরি করে, যা মুহূর্তেই চারপাশের অক্সিজেন খরচ করে ফেলে। অক্সিজেন এত দ্রুত শেষ হয়ে যায় যে কোষগুলিতে সাময়িকভাবে অক্সিজেনস্বল্পতা বা হাইপোক্সিয়া তৈরি হয়। এতে স্বাভাবিক কোষে পারঅক্সাইড কম তৈরি হয় এবং ডিএনএ কম ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কিন্তু টিউমার কোষ সাধারণত আগে থেকেই কিছুটা হাইপোক্সিক থাকে, তাই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির এই অক্সিজেন কমিয়ে ফেলার প্রভাবে তারা খুব একটা প্রভাবিত হয় না।

ইঁদুরসহ অন্যান্য কিছু প্রাণির উপর পরীক্ষা করে এর সত্যতা পাওয়া গেছে। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি নতুন বিপ্লব ঘটার সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে। কিন্তু সেদিনে পথ এখনো অনেক বাকি। কারণ বিভিন্ন কোষে অক্সিজেনের শোষণ করার ক্ষমতা এবং পদ্ধতি ভিন্ন। মানুষের কোষের সাথে রেডিয়েশান যেভাবে মিথষ্ক্রিয়া করে, অন্যান্য প্রাণির কোষের সাথে সেই মিথষ্ক্রিয়া হুবহু এক নয়। ভিন্ন ভিন্ন কোষের রেডিয়েশান সংবেদনশীলতাও ভিন্ন। তাই অক্সিজেন হ্রাসের এই তত্ত্ব এখনো সন্দেহাতীতভাবে গ্রহণযোগ্য নয়।

তাছাড়া এই তত্ত্ব প্রমাণিত হলেও চিকিৎসাক্ষেত্রে এই ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি প্রয়োগ করতে গেলে এখনো বেশি কিছু চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে। এত উচ্চ হারে রেডিয়েশান প্রয়োগ করার ক্ষমতাসম্পন্ন প্রযুক্তি এখনো তৈরি হয়নি। প্রচলিত রেডিওথেরাপিতে যে লিনিয়ার এক্সিলারেটর ব্যবহার করা হয় – তা দিয়ে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি অসম্ভব। দ্বিতীয় প্রধান সমস্যা হলো – এত উচ্চ হারের রেডিয়েশান মাপার মতো বিশ্বাসযোগ্য ডোসিমিটার এখনো তৈরি হয়নি। ডোসিমিটার ছাড়া কোনো রোগীকেই সুনির্দিষ্ট পরিমাণ রেডিয়েশান দেয়া সম্ভব নয়। প্রযুক্তিগত খরচ হিসেবে ধরলে ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপির চিকিৎসায় খরচ পড়বে প্রচলিত রেডিওথেরাপির চেয়ে অনেক বেশি। ফলে ক্যান্সার চিকিৎসা আবারো ধনীদের হাতেই সীমাবদ্ধ রয়ে যাবে।

এই সীমাবদ্ধতাকে স্বীকার করে নিয়েও বলা যায় ফ্ল্যাশ রেডিওথেরাপি ভবিষ্যতের ক্যান্সার চিকিৎসায় একটি বিপ্লব ঘটাতে পারে, বিশেষ করে যেসব ক্যান্সার শরীরের সংবেদনশীল অঙ্গে হয় (যেমন: মস্তিষ্ক, ফুসফুস)। গবেষণা সফল হলে এটি দ্রুত সময়ে, কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ায়, কার্যকর চিকিৎসার সুযোগ সৃষ্টি করবে।

 

তথ্যসূত্র

১। গ্লোবাল ক্যান্সার অবজারভেটরি, ক্যান্সার টু ডে, ২০২৪।

২। প্রদীপ দেব, রোগনির্ণয় ও চিকিৎসায় পদার্থবিজ্ঞান, প্রথমা, ঢাকা ২০২৩।

৩। ফ্রনটিয়ার্স ইন অনকোলজি, ভল্যুম ৯, আর্টিক্যাল ১৫৬৩, জানুয়ারি ২০২০।

৪। অনকোলজি লেটারস, ভল্যুম ২৮, সংখ্যা ৬০২, ২০২৪।

________________

বিজ্ঞানচিন্তা জুন ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত







Latest Post

অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা

  যেকোনো দেশেই বিজ্ঞানীদের চিন্তার জগত স্বাভাবিক সামাজিক মানুষের চিন্তার জগত থেকে কিছুটা ভিন্ন। তাঁদের চিন্তাভাবনা জুড়ে থাকে আবিষ্কার ও উদ্ভ...

Popular Posts