Thursday, 3 August 2023

নীল ডিগ্রাস টাইসনের সাথে এক সন্ধ্যা

 




বিজ্ঞানী মাত্রেই যে সুবক্তা হবেন এমন কোনো কথা নেই। অস্কার পাওয়া সিনেমাগুলির বেশিরভাগ যেমন সাধারণ মানুষের কাছে কিছুটা দুর্বোধ্য ঠেকে, একাডেমি পুরষ্কারপ্রাপ্ত বইগুলিও যেমন ভরা থাকে জটিলতার জালে, তেমনি বেশিরভাগ নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীদের কথাবার্তা ও গবেষণা সাধারণ মানুষের কাছে অবোধ্যই ঠেকে। 

 পৃথিবীর বিজ্ঞানীদের মধ্যে হাতেগোনা কয়েকজন মাত্র বিজ্ঞানী আছেন যাঁরা দুর্দান্ত সব গবেষণা করেছেন, আবার একই সাথে সাধারণ মানুষের কাছেও অত্যন্ত আকর্ষণীয় বোধগম্য ভাষায় তাঁদের গবেষণার ফলাফল ব্যাখ্যা করতে পারেন। জটিল বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধ যেমন লেখেন, সমান দক্ষতায় সহজ ভাষায় লিখতে পারেন সাধারণ পাঠকের জন্যও – এরকম সব্যসাচী বিজ্ঞানীর সংখ্যা খুব বেশি নয়। পদার্থবিজ্ঞানের অতীত বর্তমান খুঁড়লে আলবার্ট আইনস্টাইন, জর্জ গ্যামো, রিচার্ড ফাইনম্যান, কার্ল স্যাগান, স্টিফেন হকিং, পল ডেভিস, মিশিও কাকু, জিম আল খলিলি, ব্রায়ান কক্স, নীল ডিগ্রাস টাইসন – এরকম হাতেগোনা কয়েকজনের নাম উঠে আসে – যাঁরা একাধারে দুর্দান্ত বিজ্ঞানী, আবার একই সাথে চমৎকার লেখক এবং বিজ্ঞানবক্তা। 

বিজ্ঞানাকাশের এসব নক্ষত্রের মধ্যে সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক ব্যক্তির নাম নীল ডিগ্রাস টাইসন। আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এক অনুষ্ঠানে তাঁকে উপাধি দেয়া হয়েছে “sexiest astrophysicist ever”। বাংলায় এর যুৎসই শব্দ নেই। খুব কাছাকাছি যে শব্দগুলি আছে তার কোনোটাই সঠিক অর্থ প্রকাশ করে না। আক্ষরিক অনুবাদ করলে তা ভালো শোনাবে না। সারাপৃথিবীর জ্যোতির্বিজ্ঞানপ্রেমীদের কাছে তিনি ভীষণ জনপ্রিয়। শুধুমাত্র তাঁর দৈহিক গঠন কিংবা ভরাট বাচনভঙ্গির কারণে নয়, তাঁর যুৎসই শব্দচয়ন এবং সেন্স অব হিউমারের জন্যও। 

নীল টাইসনের বই এবং বক্তৃতার সাথে পরিচয় ছিল আগেই। টেলিভিশন এবং ইউটিউবের দৌলতে তাঁর বিজ্ঞানবক্তৃতা এখন সহজলভ্য। সরাসরি তাঁর আলোচনা শোনার একটা সুযোগ যখন এলো তা হাতছাড়া হতে দিলাম না। 




এখানে জনপ্রিয় বিজ্ঞানীদের বিজ্ঞানবক্তৃতার টিকেটের দাম পেশাদার থিয়েটারের টিকেটের দামের চেয়েও বেশি। কিন্তু পাঁচহাজার সিটের মেলবোর্ন কনভেনশান সেন্টারের প্লেনারি অডিটোরিয়াম যখন কানায় কানায় পূর্ণ হয়ে যায়, তখন সত্যিই ভালো লাগে। বিজ্ঞানের প্রতি মানুষের ভালোবাসা এখনো নিঃশেষ হয়ে যায়নি – অন্তত কোনো কোনো দেশে। দেড়শো দু’শ ডলার খরচ করে মানুষ ঘন্টাখানেকের বিজ্ঞান আলোচনা শুনতে আসে এখনো – দেখতে ভালোই লাগে। 

বিজ্ঞান-বক্তৃতার আয়োজনকারী প্রতিষ্ঠানও এখানে ক্রমশ লাভজনক প্রতিষ্ঠানে পরিণত হচ্ছে। অস্ট্রেলিয়ান তরুণী সুজি জামিলের নেতৃত্বে গড়ে উঠেছে থিংক ইনকরপোরেটেড। ২০১৭ সাল থেকে তারা বিশ্ববিখ্যাত ব্যক্তিত্বদের বক্তৃতার আয়োজন করেই মিলিয়নিয়ার হয়ে গেছে। অনুষ্ঠান শুরু হলো সুজি জামিলের মিনিটখানেক ঝড়ো বক্তৃতার মাধ্যমে। ঠিক বক্তৃতা নয়, বিজ্ঞাপন বলা চলে। 




পাঁচ হাজার বিজ্ঞানপ্রেমীর জোরালো হাততালির শব্দের ভেতর দিয়ে মঞ্চে এলেন অ্যাডম স্পেন্সার। খুবই জনপ্রিয় অস্ট্রেলিয়ান রেডিও-টেলিভিশন স্টেজ উপস্থাপক। গণিত ও বিজ্ঞানের অনেকগুলি বইও লিখেছেন তিনি। অনুষ্ঠানের পরিকল্পনা হলো -  জ্যোতির্বিজ্ঞানী  নীল ডিগ্রাস টাইসনের সাথে তিনি মঞ্চে বসে বিভিন্ন বিষয় নিয়ে ঘন্টাখানেক আলোচনা করবেন। 

ঘন্টাখানেক আলোচনা হলো বিভিন্ন বিষয়ে। আলোচনায় তাঁর ব্যক্তিগত জীবনেরও কিছুটা উঠে এসেছে। আমেরিকায় নীল টাইসনকে বর্ণপ্রথার কদর্য দিক দেখতে হয়েছে। তিনি বিখ্যাত হয়ে যাবার পরেও অনেকেই তাঁর মেধা ও অবিরাম চেষ্টার বদলে কৃষ্ণাঙ্গ বলে আলাদাভাবে সুযোগ পেয়েছেন অপবাদ দিয়েছেন। ক্লাস নাইনে থাকতেই তিনি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছিলেন কার্ল স্যাগানের। সেদিন অবশ্য তিনি কিংবা কার্ল স্যাগান কেউই ভাবেননি যে কার্ল স্যাগানের বিখ্যাত ‘কসমস’ নতুনভাবে উপস্থাপন করবেন নীল টাইসন। 





প্লটোকে শ্রেনিচ্যুত করে গ্রহের সারি থেকে নামিয়ে দেয়ার জন্য অনেকেই নীল টাইসনকে দায়ি করেন। একথা সত্যি যে প্লুটোর গ্রহত্ব হারানোর পেছনে নীল টাইসন খুব জোরালো ভূমিকা পালন করেছিলেন। 
আলোচনার মধ্যে আমার জন্য নতুন কিছু ছিলো না। আমি কিছুটা আশাহতও হয়েছি। প্রশ্নোত্তর পর্ব ছিল না। ব্যবস্থা ছিল নীল টাইসনকে প্রশ্ন করতে হলে আরো উচ্চমূল্যের আলাদা টিকেট কিনতে হবে – যেখানে নীলের সাথে ছবিও তোলা যাবে। এরকম বাণিজ্যিক ব্যবস্থায় আয়োজক এবং নীলসহ সংশ্লিষ্ট কেউ কেউ লাভবান হয়েছেন নিসন্দেহে। কিন্তু এখানেই একাডেমিক পরিবেশের সাথে বাণিজ্যিক পরিবেশের পার্থক্য। ইউনিভার্সিটিতে যখন নোবেলজয়ী বিজ্ঞানীরাও একাডেমিক কিংবা জনপ্রিয় বক্তৃতা দেন – কোন প্রবেশমূল্য তো থাকেই না, প্রশ্নের উত্তরেও কোন কার্পণ্য থাকে না। এজন্যই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কোন বিকল্প নেই। 

৩/৮/২৩


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Chetan Bhagat's Thriller '400 Days'

  Among the Indian authors who have gained popularity by writing novels in English, Chetan Bhagat is one of the most notable. In fact, calli...

Popular Posts