Thursday 15 June 2023

বিজ্ঞানচিন্তা মে ২০২৩

 



জনসংখ্যার অনুপাতে বাংলাদেশে যতগুলি বিজ্ঞানসাময়িকী/ বিজ্ঞানপত্রিকা থাকা উচিত - তার শতাংশও নেই। বাংলাদেশের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীর মোট সংখ্যা পৃথিবীর অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার চেয়েও বেশি। আমাদের এই বিশাল সংখ্যা বিশাল সম্ভাবনার নির্দেশক। আমি যখন স্কুলে পড়তাম – তখন একটি বিজ্ঞানসাময়িকী প্রকাশিত হতো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের অধ্যাপক মোহাম্মদ ইব্রাহিমের সম্পাদনায়। বাংলা একাডেমির একটি বিজ্ঞানপত্রিকা ছিল – যা বছরে দু’বার বের হবার কথা থাকলেও নিয়মিত প্রকাশিত হতো না। আর সেখানে যে প্রবন্ধগুলি প্রকাশিত হতো সেগুলির ভাষা ছিল মারাত্মক রকমের শক্ত। পরে অবশ্য বুঝতে পেরেছি – লেখকদের অনেকেই ইংরেজি থেকে সরাসরি অনুবাদ করতেন কঠিন বাংলায়।

তখন অবশ্য জাতীয় দৈনিকগুলিতে প্রতি সপ্তাহে পুরো একটি পাতা বরাদ্ধ থাকতো বিজ্ঞানের জন্য। দৈনিক সংবাদ এর বিজ্ঞানের পাতায় নিয়মিত প্রকাশিত হতো আবদুল্লাহ আল মুতী, শুভাগত চৌধুরি, তপন চক্রবর্তী, এ এম হারুন অর রশীদ প্রমুখ প্রথিতযশা বিজ্ঞানলেখকদের লেখা।

ক্রমে আমাদের জনসংখ্যা বেড়েছে, স্কুল-কলেজ বেড়েছে, অর্থনৈতিক সামর্থ্যও বেড়েছে, স্কুল-কলেজে বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী বেড়েছে – কিন্তু পত্রিকার পাতা থেকে বিজ্ঞানের জায়গা ক্রমশ ছোট হতে হতে একেবারে বন্ধই হয়ে গেছে অনেক ক্ষেত্রে। আগে ঈদসংখ্যাগুলিতে কমপক্ষে একটি লেখা থাকতো বিজ্ঞানবিষয়ে। পশ্চিমবঙ্গ থেকে প্রকাশিত শারদীয় সংখ্যায় এখনো এক বা একাধিক লেখা প্রকাশিত হয় বিজ্ঞান বিষয়ে। কিন্তু আমাদের ঈদসংখ্যায় বিজ্ঞানের স্থান নেই। প্রথম আলোর গত কত কয়েকটি ঈদসংখ্যার কোনটিতেই কোন বিজ্ঞান জায়গা পায়নি।

তবে সাত বছরেরও বেশি সময় ধরে প্রথম আলো প্রতি মাসে বিজ্ঞানপত্রিকা ‘বিজ্ঞানচিন্তা’ প্রকাশ করছে। বাংলাদেশে গণিত অলিম্পিয়াডের সূচনা হয়েছিল প্রথম আলোর পাতায় ২০০১ সালে – যা আজ পুষ্পপত্রপল্লবে বিকশিত হয়েছে। বিজ্ঞানচিন্তা আমাদের স্কুল কলেজের শিক্ষার্থীদের জন্য বৈজ্ঞানিক কৌতূহল পুরোপুরি মেটাতে পারছে কি না – তবে বিজ্ঞান বিষয়ে চিন্তা করতে শেখাচ্ছে তা নির্দ্বিধায় বলতে পারি।

বছর পাঁচেক আগে আগ্রাবাদের ফুটপাতে বসা হকারের কাছে বিজ্ঞানচর্চা চোখে পড়ে। দেশে নিয়মিত না থাকার কারণে বিজ্ঞানচিন্তার প্রকাশনার খবরটা আমার অজানা ছিল। খুবই ভালো ভালো লেখাসমৃদ্ধ বিজ্ঞানচিন্তার একটি সংখ্যা পড়েই আমার ভালো লেগে যায়।

তার পরের ঘটনাটি খুবই কাকতালীয়। আমি ভাবছিলাম  বিজ্ঞানচিন্তার সংশ্লিষ্ট সবাইকে ধন্যবাদ দিয়ে একটি ইমেইল করবো। কিন্তু তার আগেই আমি বিজ্ঞানচিন্তার নির্বাহী সম্পাদক আবুল বাসারের কাছ থেকে একটি ম্যাসেজ পেলাম। এরপর থেকে যখনই সুযোগ পাচ্ছি – বিজ্ঞানচিন্তা পড়ছি, এবং কিছু কিছু লিখছি।

বাসারভাই আমাকে বলেছিলেন বিজ্ঞানচিন্তা মূলত স্কুলপড়ুয়াদের জন্য। কিন্তু বিজ্ঞানচিন্তার লেখাগুলি যখন পড়ি, আমার কিন্তু একবারও মনে হয় না যে এই লেখাগুলি আমার জন্যও নয়। ভালো লাগে এই ভেবে যে আমার ভেতরের বিজ্ঞানশিশুটা বড় হয়ে যায়নি।

এই মে মাসের সংখ্যাটি অনলাইনে আসার পরপরই মলাট থেকে মলাট (from cover to cover) পড়ে ফেললাম। প্রত্যেকটি লেখা চিত্তাকর্ষক। বাংলাদেশে বিজ্ঞানচর্চা যে ক্রমশ উৎসবে পরিণত হয়েছে – তার ক্রমবিবর্তনের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস জানা গেলো এবারের মলাট কাহিনি থেকে। পাঠকদের চিঠিপত্রগুলি পড়ে খুশি লাগলো যে – ষষ্ঠ শ্রেণির শিক্ষার্থীরাও বিজ্ঞানচিন্তা পড়ার আনন্দে বিভোর হবার কথা লিখে জানাচ্ছে।

বিখ্যাত রম্যলেখক আহসান হাবীব ‘বিজ্ঞানীদের বিয়ে’ নিয়ে ছোট্ট চমৎকার লেখায় বিজ্ঞানীদের বিয়ের অনিশ্চয়তার কথা লিখতে গিয়ে বিজ্ঞানী হাইজেনবার্গের অনিশ্চয়তার সূত্র যে বিবাহের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য তা সুন্দরভাবে উপস্থাপন করেছেন। তবে মজার ব্যাপার হলো বিজ্ঞানী ওয়ার্নার হাইজেনবার্গের নিজের বিয়েতে কিন্তু তেমন অনিশ্চয়তা ছিল না। আইনস্টাইন বা ফাইনম্যানের মতো একাধিক বিয়ে তিনি করেননি। তিনি একবারই বিয়ে করেছিলেন এলিজাবেথ সুমেকারকে। সুখি বিবাহিত জীবন ছিল তাঁদের। সাতটি সন্তানের পিতা হয়েছিলেন তিনি।

মোহাম্মদ কামরুজ্জামানের বিজ্ঞান ছড়া পড়ে খুব মজা পেয়েছি। ছন্দে ছন্দে ত্রিভুজ বর্ণনা। তবে শেষের দিকে যেখানে আছে “জানো আমার তিন কোণে যে তিন সমকোণ হয়?// কোনোদিনও কম হবে না, বেশিও হবার নয়।“ – এখানে একটি মুদ্রণপ্রমাদ আছে। ত্রিভুজের তিন কোণে দুই সমকোণ হয়।

বিজ্ঞানউৎসব সম্পর্কিত সবগুলি লেখাই প্রাণবন্ত। রামন রিসার্চ ইন্সটিটিউটের অধ্যাপক বিখ্যাত বিজ্ঞানলেখক বিমান নাথের ‘চাঁদের কলঙ্ক’ এ সংখ্যার অন্যতম আকর্ষণ। চাঁদের উদ্ভব থেকে শুরু করে এর ধারাবাহিক প্রাকৃতিক বিবর্তনের পর্যায়গুলি সুন্দরভাবে উপস্থাপিত হয়েছে এই লেখায়।

আরেকটি লেখার কথা বিশেষভাবে উল্লেখ করে আজকের এ লেখা শেষ করবো – সেটা হলো আবুল বাসারের ‘ভর রহস্য’। ভর ব্যাপারটি আসলেই রহস্যময়। নিউটনের বলের সূত্র থেকে আমরা ভরের ক্ল্যাসিক্যাল সংজ্ঞা দিই, m = F/a . কিন্তু মাইক্রোস্কোপিক পর্যায়ে – যেখানে নিউটনিয়ান মেকানিক্স দিয়ে পুরোটা ব্যাখ্যা করা যায় না – সেখানে ভরের রহস্য গভীর হতে থাকে। নিউক্লিয়াসের ভেতর প্রোটন ও নিউট্রনকে আলাদা আলাদাভাবে যোগ করলে যে ভর পাওয়া যায়, তা গোটা নিউক্লিয়াসের ভরের চেয়ে বেশি। এই ভরের পার্থক্যকে আইনস্টাইনের ভর-শক্তির সমীকরণ দিয়ে শক্তিতে পরিণত করলে আমরা নিউক্লিয়াসের বাইন্ডিং এনার্জি বা বন্ধনশক্তি পাই। এই শক্তিতেই প্রোটন ও নিউট্রনগুলি একসাথে আবদ্ধ থাকে স্ট্রং ফোর্সের মাধ্যমে। প্রোটন কিংবা নিউট্রনের ভেতরের কোয়ার্কগুলিকে আলাদাভাবে যোগ করলেও এরকমই হয়। ‘ভর রহস্য’ রহস্যময়তার কারণেই চমৎকার।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts