Tuesday 16 May 2023

ইনজি লেমান – পৃথিবীর প্রথম ভূপদার্থবিজ্ঞানী

 


ভূমিকম্পের পূর্বাভাস এখনো সঠিকভাবে দেয়া সম্ভব না হলেও, কী কারণে ভূমিকম্প হয় তা আজ আমরা জানি। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ গঠন সঠিকভাবে জানার পর ভূমিকম্পের সঠিক কারণ খুঁজে বের করা সহজ হয়েছে। পৃথিবীর অভ্যন্তরীণ পদার্থবিজ্ঞানিক কাজকর্ম নিয়ে জিওফিজিক্স বা ভূপদার্থবিজ্ঞান নামে পদার্থবিজ্ঞানের যে আলাদা একটি শাখা তৈরি হয়েছে, তার প্রধান স্থপতি ছিলেন একজন নারী পদার্থবিজ্ঞানী – ইন্‌জি লেমান (Inge Lehmann)। তিনি ছিলেন পৃথিবীর প্রথম ভূপদার্থবিজ্ঞানী। পৃথিবীর কেন্দ্রে যে কঠিন ধাতব গোলক আছে তার বাইরে একটি তরল স্তরের অস্তিত্ব যে থাকতেই হবে – সেটা প্রথম দাবি করেছিলেন ইন্‌জি লেমান। তাঁর নামানুসারে সেই স্তরের নাম দেয়া হয়েছে লেমান ডিসকন্টিনিউটি। 

ইন্‌জি লেমানের জন্ম ১৮৮৮ সালের ১৩মে ডেনমার্কের কোপেনহেগেনে। ইন্‌জির বাবা আলফ্রেড জর্জ লুদভিগ লেমান ছিলেন মনোবিজ্ঞানী, মা আইডা ছিলেন গৃহবধু। সেইসময় পৃথিবীজুড়ে মেয়েদের লেখাপড়াকে তেমন কোন উৎসাহ বা গুরুত্ব দেয়া না হলেও ইওরোপের কিছু কিছু স্কুলে মেয়েদের শিক্ষাকে বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হতো। ডেনমার্কে এরকম একটি স্কুলে লেখাপড়া করেছিলেন ইন্‌জি। সেই স্কুলের প্রধান ছিলেন হানা এডলার – যিনি ছিলেন পদার্থবিজ্ঞানী নিল্‌স বোরের খালা। ইন্‌জির লেখাপড়া এবং গবেষণায় সবচেয়ে বেশি প্রভাব রেখেছিলেন যে দু’জন মানুষ তাঁরা ছিলেন - তাঁর বাবা এবং শিক্ষক হানা এডলার। 

স্কুলের পরীক্ষায় সর্বোচ্চ র‍্যাংক নিয়ে ১৯০৭ সালে  কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হলেন ইন্‌জি। গণিত, রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞান নিয়ে স্নাতক পর্যায়ের পড়াশোনা শুরু করলেও – তাঁর শারীরিক অবস্থা ছিল খুবই দুর্বল। কেমব্রিজে গেলে কিছুটা ভালো থাকবেন এই আশায় ১৯১০ সালে কেমব্রিজের নিউন্যাম কলেজে গেলেন গণিত নিয়ে পড়তে। কিন্তু বছরখানেক পরেই তাঁকে ফিরে আসতে হলো শারীরিক দুর্বলতার কারণে। কোপেনহেগেনে ফিরে এসেও লেখাপড়া চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হলো না। একটা ইন্সুরেন্স কোম্পানিতে কেরানির চাকরি নিলেন। সেখানে কাজ করলেন ১৯১৮ সাল পর্যন্ত। এই সাত বছরে তিনি ইন্সুরেন্সের কাজ করতে করতে গাণিতিক হিসেবে বেশ দক্ষতা অর্জন করেছেন। শরীর কিছুটা সুস্থ হলে ত্রিশ বছর বয়সে আবার লেখাপড়া শুরু করলেন কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ে। বত্রিশ বছর বয়সে গণিত ও ভৌতবিজ্ঞানে স্নাতক পর্যায়ের একটি ডিগ্রি লাভ করলেন। 

এরপর পাঁচ বছর কোপেনহেগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের গণিত ও পরিসংখ্যানের অধ্যাপক জোহান স্টিফেনসেনের সহকারি হিসেবে কাজ করার পর ডেনিশ গণিতজ্ঞ নিলস এরিক নুরলুন্ডের সহকারি হিসেবে কাজ শুরু করলেন ১৯২৫ সালে। প্রফেসর নুরলুন্ড মাধ্যাকর্ষণের সাথে পৃথিবীর ঘূর্ণন এবং অন্যান্য জ্যামিতিক হিসেবের গবেষণা করছিলেন – যাকে বলা হয় জিওডেসি। ভূমিকম্পের ডাটা বিশ্লেষণ করে তাদের সাথে পৃথিবীর অন্যান্য আনুসঙ্গিক পরিবর্তনের ডাটার সম্পর্ক নির্ণয় ছিল ইন্‌জির প্রধান কাজ। এই কাজ করতে করতেই ১৯২৮ সালে চল্লিশ বছর বয়সে ইন্‌জি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করলেন। প্রফেসর নুরলুন্ডের নেতৃত্বে ডেনমার্কে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে জিওডেসিক ইন্সটিটিউট। ইন্‌জি সেই প্রতিষ্ঠানে ভূমিকম্পবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান হিসেবে যোগ দিলেন। 

১৯৩৬ সালে ইন্‌জি লেমান সর্বপ্রথম ভূমিকম্পের প্রাইমারি ওয়েভ বা পি-ওয়েভের সঠিক বৈশিষ্ট্য ব্যাখ্যা করেন। তিনি সঠিকভাবে প্রমাণ দেন যে পৃথিবীর কেন্দ্রের কঠিন ধাতব গোলকের বাইরে একটি নমনীয় স্তর আছে। ১৯২৯ সালে নিউজিল্যান্ডে ৭ দশমিক ৩ মাত্রার ভয়াবহ ভূমিকম্প হয়েছিল। সেই ভূমিকম্পের হাজার হাজার ডাটা বিশ্লেষণ করে পি-ওয়েভের বৈশিষ্ট্য এবং সেখান থেকে পৃথিবীর গঠনের অভ্রান্ত প্রমাণ দিয়েছিলেন ইন্‌জি কোন ধরনের কম্পিউটারের সাহায্য ছাড়াই। সে সময় কম্পিউটারের অস্তিত্ব ছিল না। ১৯৭১ সালে সর্বপ্রথম কম্পিউটারের সাহায্যে আধুনিক পদ্ধতিতে ডাটা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে ইন্‌জির হিসেব ছিল নির্ভুল। 

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মানি ডেনমার্ক দখল করে নেয়। ইন্‌জির গবেষণা ধরতে গেলে বন্ধই ছিল সেই সময়। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর তিনি আবার গবেষণা শুরু করেন। একটি ইন্সটিটিউটের প্রধান হওয়া সত্ত্বেও, জিওফিজিক্যাল সোসাইটির দু’বার নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট হওয়া সত্ত্বেও ইউনিভার্সিটির প্রফেসর হতে পারেননি ইন্‌জি লেমান শুধুমাত্র নারী হবার কারণে। 

১৯৫৩ সালে ৬৫ বছর বয়সে ইন্সটিটিউট থেকে অবসর গ্রহণ করলেন ইন্‌জি। তারপর বেশ কয়েক বছর তিনি আমেরিকায় গিয়ে গবেষণা করেছেন। ১৯৬৯ সালে তিনি রয়েল সোসাইটির ফেলোশিপ পান। 

ছোটবেলা থেকে শুরু করে সারাজীবনই ইন্‌জি ছিলেন প্রচন্ড লাজুক, নিজের মনে একা থাকতেই পছন্দ করতেন। প্রাতিষ্ঠানিক সহকর্মী ছাড়া ব্যক্তিগত কোন বন্ধুত্ব তিনি তৈরি করেননি কারো সাথে। ১০৪ বছর বেঁচেছিলেন তিনি – মূলত একাই। ১৯৯৩ সালের ২১ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts