Monday 17 April 2023

লিওনার্দো দা ভিঞ্চি

 



যে দুটি চিত্রকর্মকে সর্বকালের সেরা চিত্রকর্ম বলে মনে করা হয় তাদের প্রথমটি হলো ‘মোনালিসা’, আর দ্বিতীয়টি ‘দ্য লাস্ট সাপার’। দুটোরই চিত্রকর ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। শুধু চিত্রশিল্পী নন, তিনি ছিলেন শিল্পকলার নতুন প্রথার তাত্ত্বিক পথপ্রদর্শক, স্থপতি, মঞ্চসজ্জাবিদ, প্রকৌশলী, গণিতজ্ঞ, পদার্থবিদ, ভূগোলবিদ, ভূতত্ত্ববিদ, শরীরতত্ত্ববিদ। চতুর্দশ শতাব্দীর ইওরোপের রেনেসাঁ যুগের ইতিহাসের সবচেয়ে প্রতিভাশালী মানুষ ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। 

ইতালির ফ্লোরেন্স শহরের কাছাকাছি ভিঞ্চি নামক উপশহরে জন্ম বলেই লিওনার্দোর নাম হয়ে গেছে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। ইওরোপে নামের সাথে পারিবারিক নাম যোগ করার নিয়ম তখনো চালু হয়নি। সুনির্দিষ্ট পরিচিতির উদ্দেশ্যে অনেকে নামের সাথে জন্মস্থানের নাম জুড়ে দিতেন – যেমন ভিঞ্চি শহরের লিওনার্দো হলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। অনেকে নামের সাথে যোগ করে নিতেন তাঁদের পেশা; যেমন মাইকেল শুমেইকার – অর্থাৎ জুতার কারিগর মাইকেল ইত্যাদি। 

ভিঞ্চি শহরের তরুণ নোটারি পাবলিক  পিয়েরো  ভালোবেসেছিলেন এক চাষীর মেয়ে ক্যাটেরিনাকে। সামাজিক ও অর্থনৈতিক ব্যবধানের কারণে পিয়েরো ও ক্যাটেরিনার প্রণয় পরিণয়ে গড়ায়নি। কিন্তু তাদের ভালোবাসার সন্তান লিওনার্দোর জন্ম হয়েছে ১৪৫২ সালের ১৫ এপ্রিল। বিবাহবহির্ভূত সন্তানের সামাজিক মর্যাদা খুব একটা ছিল না তখন। লিওনার্দোর শৈশব ছিল গ্লানিকর। ক্যাটারিনার বিয়ে হয়ে যায় একজন চাষীর সাথে, যিনি লিওনার্দোর দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেন। পিয়েরোও বিয়ে করেছেন অন্য একজন সম্ভ্রান্ত রমণীকে। শিশু লিওনার্দোকে আদর দেয়ার কোন দায়িত্বই তাঁর ছিল না। পিয়েরো তাঁর সন্তান লিওনার্দোকে কিছু মাসোহারা দিয়ে পিতার দায়িত্ব পালন করেছিলেন। হাতের কাজ শেখার ব্যবস্থা করেছিলেন যেন কাজ করে খেতে পারে লিওনার্দো। 

সারাজীবন নতুন নতুন কাজ শিখেছেন এবং কাজ করেছেন লিওনার্দো। পনের বছর বয়সে ফ্লোরেন্সের নামকরা চিত্রশিল্পী আন্দ্রিয়া ডেল ভেরোচ্চিওর সহকারী নিযুক্ত হয়ে পরবর্তী দশ বছর ধরে কাজ শেখেন তাঁর কাছে। শিখলেন কীভাবে ছবি আঁকতে হয়, মূর্তি বানাতে হয়, শিখলেন ধাতু গলিয়ে বিভিন্ন ধরনের অলংকার প্রস্তুতির কাজ, আর নতুন নতুন স্থাপত্যবিদ্যা। 

১৪৭৭ সাল থেকে স্বাধীনভাবে কাজ শুরু করার পর মিলান শহরের ডিউক লুদোভিকো স্ফোরজার নজরে আসেন। স্ফোরজা লিওনার্দোকে শহরের অনেক কাজ দেন। ১৪৮২ থেকে ১৪৯৯ পর্যন্ত লিওনার্দো অনেকগুলি ছবি আঁকেন, যেগুলি পরবর্তীতে খুবই বিখ্যাত হয়েছে। এসময় তিনি অনেক মঞ্চ, সরকারি ভবন, নগর পরিকল্পনা, সামরিক অস্ত্র, কলকারখানার যন্ত্রপাতি ইত্যাদি অনেককিছুর বিস্তারিত নকশা তৈরি করেন। শতাধিক নোটবইয়ের পাতার পর পাতা ভরে ওঠে তাঁর করা নকশায়। এর বেশিরভাগই লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে যায় পরবর্তী চারশ বছর। 

মিলানের ডিউকের জন্য কাজ করার সময়েই তিনি আঁকেন ‘দ্য লাস্ট সাপার’ – যা আঁকতে কয়েক বছর সময় লেগে যায়। লিওনার্দো অনেক ধরনের কাজ শুরু করতেন একই সাথে, যার বেশিরভাগই শেষ করা হতো না। 

১৪৯৯ সালে ফ্রান্স মিলান দখল করে নিলে মিলানের ডিউক লুদোভিকো ক্ষমতা হারালো, ফলে লিওনার্দোও কর্মহীন হয়ে পড়েন। পরবর্তী সতেরো বছর ধরে তিনি ইতালির বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়িয়েছেন কাজের সন্ধানে এবং বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছেন বিভিন্ন প্রভাবশালীর অধীনে। প্রভাবশালী শাসক, নির্মম মিলিটারি শাসক, পোপ, ব্যবসায়ী অনেকের জন্যই নানারকম কাজ তাঁকে করতে হয়েছে। ১৫০৩ সালে তিনি শুরু করেছিলেন তাঁর মোনালিসা ছবির কাজ। ১৫০৬ সালে এই ছবির কাজ শেষ হয়। লিওনার্দো অবশ্য ভাবতেও পারেননি যে এই ছবিটি একদিন পৃথিবীবিখ্যাত হবে। ১৫০৬ সালে ৫৪ বছর বয়সে তিনি এনাটমি বিষয়ে পড়াশোনা শুরু করেন এবং এনাটমিক্যাল স্কেচ করতে শুরু করেন। সেগুলি এতটাই নিখুঁতভাবে এঁকেছিলেন যে পরবর্তী শত বছর ধরে চিকিৎসাবিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা এই স্কেচগুলি থেকে এনাটমি শিখেছেন। 

১৫১৬ সালে ফ্রান্সের রাজা লিওনার্দোকে ফ্রান্সের প্রধান চিত্রকর, প্রকৌশলী এবং স্থপতির পদে নিয়োগ দেন। এই পদে কাজ করতে করতে ফ্রান্সের রাজা ফ্রান্সিসের প্রিয়পাত্র হয়ে ওঠেন লিওনার্দো। দিনরাত কাজ করতে করতে শরীর ভেঙে পড়েছে লিওনার্দোর। শরীরের ডানভাগ অসাড় হয়ে পড়েছে। কিন্তু তারপরেও কাজ করে যাচ্ছেন অবিরাম। এভাবে কাজ করতে করতেই ১৫১৯ সালের ২ মে মৃত্যু হয় লিওনার্দো দা ভিঞ্চির। লিওনার্দো দা ভিঞ্চি কখনো বিয়ে করেননি, কারো সাথে তাঁর ঘনিষ্ঠতা ছিল কি না তাও জানা যায়নি। জীবিত অবস্থায় যতটা পরিচিতি তিনি পেয়েছিলেন – তার চেয়ে হাজারগুণ পরিচিতি তিনি পেয়েছেন তাঁর মৃত্যুর পর। যত দিন যাচ্ছে তাঁর কাজের নতুনভাবে মূল্যায়ন হচ্ছে। সময়ের সাথে তিনি হয়ে উঠছেন আরো প্রাসঙ্গিক।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts