Friday, 31 March 2023

বাবা - ৩

 



বাহুল্য কী জিনিস সেটা আমাদের বাড়িতে ছোটবেলায় আমি কখনো দেখিনি। প্রয়োজন এতই সীমিত ছিল, অভাব বোধ করিনি কোনোকিছুরই। সেই ছোটবেলাতেই কীভাবে যেন বুঝে গিয়েছিলাম, বাবা দিনরাত খেটেখুটে আয় করেন সামান্যই। মনে আছে, একবার চৈত্রসংক্রান্তির দিনে আমাদের দুই ভাইকে মেলা দেখাতে নিয়ে গিয়েছিলেন বাবা – মাইল তিনেক দূরের একটা গ্রামে। সকালে যাবার সময় উৎসাহে টগবগ করতে করতে হেঁটে যেতে কোন সমস্যাই হয়নি। লালসালুতে মোড়া একটি লম্বা বাঁশের সামনে বসে অনেকে পাগলের মতো মাথা ঝাঁকাচ্ছে দেখতে দেখতে, আর কাঠি-লাগানো বরফের আইসক্রিম চুষতে চুষতে দুপুর হয়ে গেল। ফেরার সময় মাথার উপর প্রচন্ড রোদ। বাবা ছাতা খুলে ধরেছেন আমাদের দুই ভাইয়ের মাথায়, নিজে ঘামছেন দরদর করে। 

“আর হাঁটতে পারছি না বাবা, রিকশা …”

তখন রিকশার সংখ্যা খুব বেশি ছিল না। অনেকক্ষণ রাস্তার পাশে গাছতলায় দাঁড়ানোর পর একটা রিকশা দেখা গেল। বাবা এগিয়ে গিয়ে কথা বললেন। কাঁধ ঝাঁকিয়ে চলে গেলেন রিকশাওয়ালা। রিকশায় প্যাডেল মারার সময় রিকশাওয়ালা ঘাড় ফিরিয়ে কেমন যেন তাচ্ছিল্যের হাসি হেসেছিলেন আমাদের দিকে চেয়ে। সেই হাসিটা আমি কখনো ভুলতে পারবো বলে মনে হয় না। রিকশা তখন বড়লোকের বাহন ছিল। সামর্থ্যহীনরা তখন মাইলের পর মাইল হেঁটে যেতো। 

বাবা আমার কাছে এসে বললেন, “আমার পিঠে উঠ।“ 

আমার তখন পাঁচ বছর বয়স। আমি তখন স্কুলে পড়ি। যুদ্ধ শেষ হয়েছে বছরখানেক আগে। যুদ্ধে বাবা সর্বস্বান্ত হয়েছেন। স্বাধীনতার সংগ্রাম শেষ হবার পর বাবার সংগ্রাম শুরু হয়েছে পোড়াঘরের ছাইভস্ম থেকে আবার উঠে দাঁড়ানোর। যুদ্ধ মানুষের মানসিক বয়স বাড়িয়ে দেয়। নিজের অজান্তেই আমরা বুঝতে শিখে গিয়েছি অনেক কিছু। আমি বুঝতে পারি – বাবার পিঠ পেতে দেয়ার কারণ কী। আমার পায়ের ব্যথা চলে যায়। আমরা হাঁটতে থাকি বাবার ধরা ছাতার ছায়ায়। 

সন্তানের একটু সুখের জন্য মা-বাবা জীবনপাত করে ফেলে। তাতেও না কুলোলে দার্শনিক কথাবার্তা বলেন। “টাকা-পয়সা ধন-সম্পদ মান-মর্যাদা কোনকিছুই চিরস্থায়ী নয়। যেকোনোদিন যে কোনো কারণেই এসব চলে যেতে পারে। এই যে আমার সবকিছু লুট করেছে, পুড়িয়ে দিয়েছে। কিন্তু যে জিনিস কখনো নষ্ট হয় না, চুরি হয় না, কিংবা কেউ কেড়েও নিতে পারে না, সেটা হলো শিক্ষা। টাকা-পয়সা, ধন-সম্পদ, মান-মর্যাদা কিছুই হয়তো আমি তোদের দিয়ে যেতে পারবো না। আমি তো লেখাপড়া করতে পারিনি, কিন্তু তোরা যদি লেখাপড়া করিস, সেটা কোনোদিন কেউ কেড়ে নিতে পারবে না।“

সেদিন সেই বয়সে এসব কথা শুনে কী মনে হয়েছিল আমার মনে নেই। কিন্তু এখন কথাগুলি যতবারই মনে পড়ে, অবাক হয়ে ভাবি – অভাব থেকেই কি খাঁটি দর্শনের সৃষ্টি হয়? 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Enigmatic quantum theory

  “ ‘There is actually no such thing as a quantum world. The quantum state exists only inside my head, something I use to do calculations. Q...

Popular Posts