Sunday 10 July 2022

বিশ্ববীণা বাজে যেথায় - ৪

 



আলীবাবা ও চল্লিশ চোরের কাহিনি নিশ্চয়ই মনে আছে তোমার। চোরদের গুপ্ত গুহায় ঢুকে ধনরত্ন হীরা-জহরতের পাহাড় দেখে আলীবাবার ভাই কাসেমের যে অবস্থা হয়েছিল, এখানে লাইব্রেরিগুলির বইয়ের সমুদ্রে ঢুকে আমার সেই অবস্থা হচ্ছে বলা যায়। রবীন্দ্রনাথ লাইব্রেরি প্রবন্ধে যা যা বলেছেন মনে হচ্ছে এতদিনে তা উপলব্ধি করতে পারছি - “লাইব্রেরির মধ্যে আমরা সহস্র পথের চৌমাথার উপরে দাঁড়াইয়া আছি। কোনো পথ অনন্ত সমুদ্রে গিয়াছে, কোনো পথ অনন্ত শিখরে উঠিয়াছে, কোনো পথ মানবহৃদয়ের অতলস্পর্শে নামিয়াছে। যে যে-দিকে ধাবমান হও, কোথাও বাধা পাইবে না।“

গত কয়েক সপ্তাহ ধরে আমি বাধাহীনভাবে ঘুরে বেড়াচ্ছি একটার পর একটা লাইব্রেরিতে। বিষয়ভিত্তিক গবেষণায় ‘পথ হারাবো বলেই আমি পথে নেমেছি’ বলার সুযোগ নেই। সেখানে স্বেচ্ছাচারিতার সুযোগ আছে, কিন্তু নিলেই বিপদ। লাইব্রেরির সহস্র পথের চৌমাথায় দাঁড়িয়ে পথ চিনতে ভুল করলে অহেতুক সময় নষ্ট হবে। এসব জানা থাকা সত্ত্বেও আমি মুক্তপাঠের আনন্দে মেতে উঠেছি, যে আনন্দ পুরোপুরি পাবার জন্য কিছুটা লক্ষ্যবিহীন স্বেচ্ছাচারীও হতে হয়। এক্ষেত্রে এখন আমি পুরোপুরি স্বেচ্ছাচারী হয়ে উঠেছি। লাইব্রেরি থেকে এক সাথে ষাটটা বই ধার করে বাসায় নিয়ে যাওয়া যাবে জেনে পুস্তকনির্বাচনে প্রয়োজনের চেয়েও ভালো লাগাকে প্রশ্রয় দিতে শুরু করেছি। ভ্রমণ, মনস্তত্ত্ব, সমাজবিজ্ঞান, ইতিহাস এসবের সাথে নিউক্লিয়ার ফিজিক্সের দূরতম সম্পর্কও নেই, কিন্তু আমি হাত ভর্তি করে ফেলেছি এ ধরনের বইতে। ব্যাইলিউ লাইব্রেরির উপরের তলার একদিক থেকে শুরু করে মাঝামাঝি পর্যন্ত আসতেই হাত ভর্তি হয়ে গেছে। সামনে আরো শত শত তাকে সারি সারি বই চোখ পাকিয়ে তাকিয়ে আছে।

এই ক্যাম্পাসে অনেকগুলি লাইব্রেরি। প্রত্যেকটি ডিপার্টমেন্টেই আছে বিষয়ভিত্তিক রিসার্চ লাইব্রেরি। ফিজিক্স বিল্ডিং-এর ছয় তলায় আমাদের ফ্লোরেই ফিজিক্স রিসার্চ লাইব্রেরি। ওখানে ফিজিক্সের দরকারি সব জার্নালের সবগুলি সংখ্যা পাওয়া যায়। আমার অন্য কোনো লাইব্রেরিতে যাওয়ারই দরকার নেই। কিন্তু দরকারের গন্ডিতে বন্দী থাকতে কি ভালো লাগে? ফিজিক্স লাইব্রেরিতে দিনরাত চব্বিশ ঘন্টা যে কোনো সময়েই ঢুকতে পারি ইলেকট্রনিক কার্ড দিয়ে। কিন্তু অন্য লাইব্রেরিগুলিতে নির্ধারিত সময়ের বাইরে আমার প্রবেশাধিকার নেই। তাই যখনই সুযোগ পাচ্ছি – একটার পর একটা লাইব্রেরিতে ঢু মেরে দেখছি কী কী বিষয়ের বই আছে সেখানে। কম্পিউটারে লাইব্রেরির ক্যাটালগ থেকেই জানা যায় কোথায় কী বই আছে। কিন্তু বইয়ের গায়ে হাত দিয়ে দেখার যে আনন্দ তা থেকে নিজেকে বঞ্চিত করি কেন।

এই কাজটি আমি বাংলাদেশে যে ক’টা লাইব্রেরিতে ঢুকতে পেরেছি – সব জায়গায় করেছি। সবগুলি বইয়ের তাক ঘুরে ঘুরে দেখেছি কোথায় কী বই আছে। পুরো চট্টগ্রাম শহরে যতগুলি লাইব্রেরি আছে তার চেয়ে অনেক বেশি লাইব্রেরি আছে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির এই পার্কভিল ক্যাম্পাসে। গত তিন সপ্তাহে আমি সবগুলো লাইব্রেরিতে ঢু মেরেছি। এদের মধ্যে অনেকগুলি লাইব্রেরিতে আমার আর না গেলেও চলবে। যেমন আমাদের বিল্ডিং থেকে বের হয়ে ওল্ড জিওলজি বিল্ডিং-এর সামনে আর্কিটেকচার বিল্ডিং-এর দোতলার লাইব্রেরিতে সব বিল্ডিং ডিজাইনের বই – আর যেতে হবে না সেখানে। কেমিস্ট্রি, ম্যাথস, বায়োলজি ওসবেও আর যেতে হবে না। কেমিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং-এর পেছনে লাল রঙের পুরনো মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিল্ডিং-এর ইঞ্জিনিয়ারিং লাইব্রেরিতেও আর যেতে হবে বলে মনে হয় না।

গ্র্যাটান স্ট্রিট পার হয়ে ইউনিভার্সিটি স্কোয়ারের সামনে মেলবোর্ন বিজনেস স্কুল। এটা নাকি পৃথিবীর প্রথম পাঁচটি বিজনেস স্কুলের একটি। পৃথিবীর অনেক বড় বড় কোম্পানির এক্সিকিউটিভরা এখানে আসে এমবিএ করার জন্য। মেডিসিনের টিউশন ফি’র চেয়েও বেশি বিজনেস স্কুলের টিউশন ফি। এখানেও একটি খুব হাই ফাই লাইব্রেরি আছে। সেই লাইব্রেরিতেও ঘুরে এসেছি। খটখটে বিজনেস পেপারে ভর্তি। আমার আর যেতে হবে না ওখানে।

বিভিন্ন ডিপার্টমেন্টের ভেতরের লাইব্রেরিগুলি ছাড়াও আলাদা আলাদা সম্পূর্ণ বিল্ডিং নিয়ে যে তিনটি বিশাল লাইব্রেরি আছে এই ক্যাম্পাসে সেগুলি হলো ইস্টার্ন রিসোর্স সেন্টার বা ই-আর-সি লাইব্রেরি, ব্যাইলিউ লাইব্রেরি আর বায়োমেডিক্যাল লাইব্রেরি। এগুলিতে একবার করে ঢুকেই বুঝতে পেরেছি বার বার যেতে হবে।

ব্যাইলিউ লাইব্রেরিতে আজকের আগেও কয়েকবার এসেছি। প্রথমবার এসেছিলাম এখানে পার্টটাইম কাজের জন্য। কাজ হয়নি। আজ এসেছি বই দেখার জন্য। কত লাখ বই যে এখানে আছে!

মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি এই ব্যাইলিউ লাইব্রেরি। অস্ট্রেলিয়ান ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ উইলিয়াম ব্যাইলিউর টাকায় এই লাইব্রেরি তৈরি হয়েছে। বিশাল পাঁচতলা এই লাইব্রেরি বিল্ডিংটি তৈরি হয়েছে ১৯৫৮ সালে। দেখে মনে হয় না যে এই বিল্ডিং-এর বয়স চল্লিশ হয়ে গেছে। পাঁচ তলা বিল্ডিং-এর দোতলা পর্যন্ত মাটির নিচে। একেবারে নিচের তলায় আছে দুষ্প্রাপ্য সব ছবি, গানের রেকর্ড, পত্রিকা। লিটল ম্যাগাজিনে ভর্তি এর পরের তলা। সব ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে এলাম পঞ্চম তলায়। এখানেই মূল সংগ্রহশালা।

ঘুরে ঘুরে দেখতে দেখতে অনেকগুলি বই হাতে উঠে এলো। ইস্যু করে নিয়ে যেতে হবে। আরো বই দেখতে দেখতে ইংরেজি ছাড়া অন্য ভাষায় লেখা বইয়ের অংশে এলাম। ফরাসি, জার্মানের কাছাকাছি রাশিয়ান আর চায়নিজ ভাষায় লেখা বইও পাওয়া গেল। আমার চোখ দ্রুত ঘুরছে, ক্ষীণ একটা আশা মনে জেগে উঠেছে। আশাতীতভাবে পরের সারিতেই দেখা দিলেন রবীন্দ্রনাথ। “শঙ্খের মধ্যে যেমন সমুদ্রের শব্দ শুনা যায়, তেমনি এই লাইব্রেরির মধ্যে কি হৃদয়ের উত্থানপতনের শব্দ শুনিতেছ?” কী এক আশ্চর্য সুখে হৃদয় আন্দোলিত হয়ে উঠলো। রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উপলক্ষে ১৯৬১ সালে বিশ্বভারতী থেকে প্রকাশিত রবীন্দ্র রচনাবলির সবগুলি খন্ডই আছে এখানে। তার পাশে অন্নদাশংকর রায়ের সত্যাসত্য উপন্যাসের চার খন্ড, বিভূতিভূষণের পথের পাঁচালী, সুবোধ ঘোষের ভারত প্রেমকথা, আর ত্রৈলোক্যনাথ রচনাবলীর এক খন্ড। মাত্র এই ক’টা বাংলা বই – তাতেই মনে হচ্ছে আমি সোনার খনি পেয়ে গেছি। এখানে এই বই কীভাবে এলো তার ইতিহাস আমি জানি না। নিশ্চয় কোন বাঙালি শিক্ষাবিদ এই বইগুলি আনার ব্যবস্থা করেছেন। আমি কৃতজ্ঞ তাঁর কাছে। এতক্ষণ যেসব বই হাতে নিয়েছিলাম সেগুলি রেখে দিলাম লাইব্রেরির ট্রলিতে। রবীন্দ্র রচনাবলীতে হাত দিলাম। ভীষণ ভারী এক এক খন্ড। এক সাথে পাঁচ খন্ডের বেশি নেয়া গেল না। কাল আবার আসতে হবে। সবগুলি বই বাসায় নিয়ে গিয়ে পড়তে হবে। বাংলা থেকে দূরে না গেলে বোঝা যায় না বাংলার জন্য কেমন তৃষ্ণা জাগে। 




No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts