Tuesday, 1 December 2020

এইসব দিনরাত্রি

 


“আশা ও আনন্দের যে অপরূপ দিন, তার উল্টো পিঠেই দুঃখ  ও বেদনার দীর্ঘ রজনী। আশা-আনন্দ, দুঃখ-বেদনা নিয়েই আমাদের এইসব দিনরাত্রি।“ - বিটিভিতে যখন এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিক শুরু হয়, তখন আমি চট্টগ্রাম কলেজে পড়ি। থাকি হোস্টেলে – শেরে বাংলা বি ব্লকে। এক পর্ব দেখার পর পরের পর্বের জন্য দুই সপ্তাহের অধীর অপেক্ষা। দর্শকদের মন জয় করতে একটুও সময় লাগেনি নাট্যকার হুমায়ূন আহমেদের। কী চমৎকার সব সংলাপ, কী সূক্ষ্ম রুচিশীল হিউমার, আর ভালোবাসা-আনন্দ-বেদনার কী অপূর্ব সমন্বয়। বিটিভি আর্কাইভের কল্যাণে এই ধারাবাহিকের সবগুলি পর্ব আবার দেখার সুযোগ হলো। শুনেছি ইদানীং অনেকেই ভারতীয় সিরিয়ালে নিয়মিত বুঁদ হয়ে থাকেন। জানি না সেইসব মোটাদাগের অতিনাটকীয় উৎকট সংলাপ ও প্রসাধনসর্বস্ব সিরিয়ালের দর্শকদের  ক্ল্যাসিক শিল্পবোধের কিছুটাও অবশিষ্ট আছে কি না। যদি থাকে, তাহলে এইসব দিনরাত্রির সামান্য অংশও যদি দেখেন, বুঝতে পারবেন টিভি নাটকের গুণগত মান কী হতে পারে। সামান্য কিছু উজ্জ্বল ব্যতিক্রম ছাড়া একথা বাংলাদেশের সাম্প্রতিক নাটকগুলির ক্ষেত্রেও খাটে। এমনকি স্বয়ং হুমায়ূন আহমেদও শেষের দিকে তাঁর নিজের কিছু নাটকের মান নিজেই নামিয়ে নিয়ে এসেছিলেন অনেকটা, কিন্তু সেটা অন্য প্রসঙ্গ।

লেখক হুমায়ূন আহমেদকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে পৌঁছে দিয়েছিল বাংলাদেশ টেলিভিশনে প্রচারিত তাঁর নাটকগুলি। তাঁর রচিত উপন্যাসগুলির জনপ্রিয়তা অন্যসব লেখকের ঈর্ষার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। এইসব দিনরাত্রি উপন্যাসটি প্রথম প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৯০ সালে, ধারাবাহিক নাটক প্রচারের বেশ কয়েক বছর পরে। নাটক ও উপন্যাসের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য আছে। এইসব দিনরাত্রি উপন্যাসের ঘটনাতেও কিছুটা পার্থক্য আছে। তবে নাটক দেখার পর উপন্যাসটি পড়লে পাঠকের কল্পনাশক্তি অনেকটাই সীমাবদ্ধ হয়ে যায়। কারণ গল্পের শফিক আর রফিকের কথা এলেই চোখে ভাসে বুলবুল আহমেদ ও আসাদুজ্জামান নূরের মুখ। এইসব দিনরাত্রি ধারাবাহিকের শেষের পর্বগুলিতে সারা দেশের দর্শক কেঁদেছে টুনীর জন্য। নাট্যকার চাইলেই টুনীকে বাঁচিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু হুমায়ূন আহমেদের যুক্তিবোধ প্রবল। তিনি বলেছেন, টুনীকে জার্মানিতে নিয়ে গিয়ে চিকিৎসায় সুস্থ করে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হলে দর্শকদের অনেকের মনে একটা ধারণা তৈরি হতে পারতো যে – বিদেশে নিয়ে যেতে পারলেই ক্যান্সার রোগী সুস্থ হয়ে যায়। তাতে যাদের সামর্থ্য নেই – তারা ভাববেন, শুধুমাত্র দারিদ্র্যের কারণে তাদের প্রিয়জনকে বাঁচানো গেল না।

এইসব দিনরাত্রিতে হুমায়ূন আহমেদ কবীর মামার চরিত্রটি তৈরি করেছিলেন যুক্তিবাদী হিসেবে। নাটকের কোথায় উল্লেখ করেননি, কিন্তু উপন্যাসে সরাসরিই বলেছেন – কবীর মামা নাস্তিক। অথচ মানুষের জন্য কী নিঃস্বার্থ ভালোবাসা তাঁর। টুনীর অসুখের সময় কবীর মামার মুখে তিনি অত্যন্ত দরকারি একটি প্রশ্নের অবতারণা করেছিলেন – আমাদের দেশের ধনীরা সহজেই ভালো চিকিৎসার জন্য বিদেশের হাসপাতালে চলে যেতে পারেন। কিন্তু যাদের সামর্থ্য নেই – তাদের জন্য বিশ্বমানের কোন হাসপাতাল কি দেশে তৈরি করা সম্ভব নয়? আশির দশকের সেই প্রশ্ন – তিরিশ বছর পরেও আজো প্রশ্নই রয়ে গেছে।

হুমায়ূন আহমেদ খুব অল্প শব্দে এমন কিছু কথা বলেন – যা মানুষের মনের ভেতর ঢুকে বসে থাকে। যেমন - ভালোবাসার মানুষ পাশে থাকাটাই বিশ্বের সবচেয়ে বড় ম্যাজিক। আমরা ভালোবাসাময় ম্যাজিকের জগতে বাস করতে পারছি আমাদের ভালোবাসার মানুষ আমাদের পাশে আছে বলেই।

“কিছু কিছু গল্প আছে যা কখনো শেষ হয় না। এইসব দিন-রাত্রির গল্প তেমনি এক শেষ না হওয়া গল্প। এই গল্প দিনের পর দিন বৎসরের পর বৎসর চলতেই থাকে। ঘরের চার দেয়ালে সুখ-দুঃখের কত কাব্যই না রচিত হয়। কত গোপন আনন্দ কত লুকানো অশ্রু। শিশুরা বড় হয়। বৃদ্ধ-বৃদ্ধারা যাত্রা করে অনির্দিষ্টের পথে। আবার নতুন সব শিশুরা জন্মায়।“  নতুন প্রজন্মের দর্শকদের বলবো – যদি হাতে সময় থাকে, কোরিয়ান সিরিয়াল, জাপানী কার্টুন ইত্যাদি দেখার পরেও যদি কিছুটা সময় ম্যানেজ করা যায় – তাহলে ‘এইসব দিনরাত্রি’ দেখার জন্য। ধ্রুপদী শিল্প কখনো পুরনো হয় না।


No comments:

Post a Comment

Latest Post

কৃত্রিম স্নায়ুতন্ত্র ও যন্ত্রের লেখাপড়া

  মানুষ যখন থেকে বুঝতে পেরেছে যে তাদের মগজে বুদ্ধি আছে এবং বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চার মাধ্যমে বুদ্ধির পরিমাণ এবং তীক্ষ্ণতা বাড়ানো যায় – তখন থেকেই ...

Popular Posts