Thursday, 30 October 2025

হেনরি ক্যাভেন্ডিস: অদ্ভুত মানুষ, অসাধারণ বিজ্ঞানী


বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উন্নতির যে সিঁড়ি ধরে পৃথিবীর মানুষ এত উপরে উঠে এসেছে সেই সিঁড়ির ভিত্তি তৈরি হয়েছে যেসব গবেষণাগারে, সেসব গবেষণাগারের নাম লিখতে হলে প্রথমেই লিখতে হবে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবের নাম। এই একটি মাত্র গবেষণাগার থেকে উদ্ভূত গবেষণা এপর্যন্ত অর্জন করেছে একত্রিশটি নোবেল পুরষ্কার। এই গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ১৮৭৪ সালে। সেই সময় কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের চ্যান্সেলর ছিলেন ডেভনশায়ারের সপ্তম ডিউক স্যার উইলিয়াম ক্যাভেন্ডিস। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এই বিখ্যাত গবেষণাগার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্যাভেন্ডিস পরিবারের টাকায়- যার বেশিরভাগই এসেছিল তাঁদের পূর্বপুরুষ অষ্টাদশ শতাব্দীর ব্রিটিশ বিজ্ঞানী হেনরি ক্যাভেন্ডিসের কাছ থেকে। হেনরি ক্যাভেন্ডিসের টাকায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে বলেই শুধু নয়, উনবিংশ শতাব্দীর অসাধারণ প্রতিভাবান বিজ্ঞানীর প্রতি যথাযথ সম্মান দেখানোর উদ্দেশ্যেও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় এই গবেষণাগারের নাম রেখেছে ‘ক্যাভেন্ডিস ল্যাব’। শুধু তাই নয়, ক্যাভেন্ডিস পরিবারের দেয়া টাকা থেকে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞান বিভাগে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ‘ক্যাভেন্ডিস প্রফেসর অব ফিজিক্স’ পদ। পৃথিবীবিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক ম্যাক্সওয়েল ছিলেন এই পদের প্রথম প্রফেসর।

কে ছিলেন এই হেনরি ক্যাভেন্ডিস? তিনি ছিলেন একাধারে অসাধারণ রসায়নবিজ্ঞানী। তিনিই প্রথম বাতাসের উপাদানগুলি আলাদা করেছিলেন। তিনিই প্রথম আবিষ্কার করেছিলেন হাইড্রোজেন গ্যাস। পদার্থবিজ্ঞানেও তাঁর অবদান ছিল সীমাহীন। পৃথিবীর ভর এবং ঘনত্ব নির্ণয় করেছিলেন – সেই আঠারো শতকে নিজের তৈরি যন্ত্রপাতি দিয়ে। বিদ্যুৎ প্রবাহের ধর্ম সম্পর্কে এমন সব গবেষণা করেছিলেন – যেগুলি যথাসময়ে প্রকাশিত হলে পদার্থবিজ্ঞানে আলোড়ন পড়ে যেতো। কিন্তু অদ্ভূত রকমের নিভৃতচারি ছিলেন বলে হেনরি ক্যাভেন্ডিস তাঁর গবেষণার এক শতাংশও প্রকাশ করেননি। তাঁর মৃত্যুর অনেক বছর পর বিজ্ঞানী ম্যাক্সওয়েল হেনরি ক্যাভেন্ডিসের গবেষণার রাশি রাশি কাগজপত্র দেখে বুঝতে পেরেছিলেন কী অসাধারণ সব গবেষণার ফলাফল লোকচক্ষুর আড়ালে রেখে দিয়েছেন হেনরি ক্যাভেন্ডিস। ক্যাভেন্ডিসের বৈদ্যুতিক কাজের গবেষণার কিছুটা সম্পাদনা করে প্রকাশ করেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। সেখান থেকে বিজ্ঞানীরা বুঝতে পেরেছেন ঠিক সময়ে প্রকাশিত হলে কুলম্ব, ফ্যারাডে কিংবা ওহমের মতো যুগান্তকারী কাজের মর্যাদা পেতেন তিনি।

হেনরি ক্যাভেন্ডিস প্রচারবিমুখ ছিলেন বললে খুবই কম বলা হয়। তিনি সারাজীবন একাকী নিভৃতে বসবাস করেছেন। একাকী গবেষণা করেছেন। বিজ্ঞান ছাড়া অন্য কোনো বিষয়ে কারো সাথে কোন কথা বলেননি। কোথাও কোন বক্তৃতা দেননি। কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ে চার বছর পড়াশোনা করার পর ডিগ্রি ছাড়াই বের হয়ে গেছেন শুধুমাত্র অন্যদের সাথে কথা বলতে হবে বলে। বিংশ শতাব্দীতে পদার্থবিজ্ঞানী পল ডিরাককে আমরা অসম্ভব স্বল্পভাষী অসামাজিক ধরনের বিজ্ঞানী হিসেবে চিনেছি। তবুও পল ডিরাক অধ্যাপনা করেছেন, নোবেল বক্তৃতা দিয়েছেন, এমনকি বিয়ে করে ঘরসংসারও করেছেন। কিন্তু  হেনরি ক্যাভেন্ডিস ছিলেন চরম মাত্রায় অসামাজিক। সারাজীবন একা কাটিয়েছেন। নিজের মায়ের মৃত্যুর পর অন্য কোন মহিলার সাথে কোনোদিন কোনো বাক্যবিনিময় তো দূরের কথা, দৃষ্টি বিনিময়ও করেননি।

হেনরি ক্যাভেন্ডিসের বাবা লর্ড চার্লস ক্যাভেন্ডিস ছিলেন ডেভনশায়ারের দ্বিতীয় ডিউকের তৃতীয় পুত্র। হেনরির মা অ্যানি গ্রে ছিলেন কেন্টের ডিউক হেনরি গ্রের চতুর্থ কন্যা। নিজের বাবার নামেই তিনি তাঁর প্রথম সন্তানের নাম রেখেছিলেন – হেনরি। হেনরি ক্যাভেন্ডিসের জন্মের সময় তাঁর মা-বাবা ছিলেন ফ্রান্সের নিস শহরে। সেখানেই ১৭৩১ সালের ১০ অক্টোবর হেনরি ক্যাভেন্ডিসের জন্ম। দু’বছর পর দ্বিতীয় পুত্র ফ্রেডেরিকের জন্মদানের কিছুদিনের মধ্যেই মৃত্যু হয় অ্যানি গ্রের। মায়ের মৃত্যুর পর বাবার দায়িত্বেই বড় হতে থাকে হেনরি ও ফ্রেডেরিক। পরিচারকদের তত্ত্বাবধানে কেটেছে হেনরির শৈশব। তখন থেকেই প্রচন্ড লাজুক স্বভাব নিয়ে বেড়ে উঠেছেন হেনরি।

বড়লোকের ছেলে হিসেবে লন্ডনের নামকরা প্রাইভেট স্কুল হেকনি একাডেমি থেকে হাইস্কুলের পড়া শেষ করেন হেনরি। ১৭৪৮ সালে ১৭ বছর বয়সে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটির সেন্ট পিটারস কলেজে ভর্তি হন। রসায়ন ও পদার্থবিজ্ঞানের মেজর সাবজেক্ট নিয়ে তিন বছর পড়াশোনা করার পরও ফাইনাল পরীক্ষা না দিয়ে কোন ধরনের ডিগ্রি ছাড়াই ১৭৫৩ সালে কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি ত্যাগ করেন হেনরি ক্যাভেন্ডিস।

পারিবারিকভাবে অর্থনৈতিক সচ্ছলতা ও আভিজাত্য থাকার কারণে ক্যারিয়ার নিয়ে কখনোই ভাবতে হয়নি হেনরি ক্যাভেন্ডিসকে। তিনি ভাবেনওনি। বিজ্ঞানের গবেষণার প্রতি প্রচন্ড ভালোবাসা জন্মেছে সেই স্কুল থেকেই। কেমব্রিজে লেখাপড়া করার সময় শিখেছেন কীভাবে বিজ্ঞানগবেষণা করতে হয়। একেবারেই নির্বান্ধব স্বতন্ত্র স্বভাবের হেনরি কারো সাথেই সরাসরি কোনো কথাবার্তা বলতেন না। নিজের বাড়িতে যন্ত্রপাতি নিয়ে নানারকমের গবেষণায় ব্যস্ত থাকতেন তিনি সবসময়।

হেনরির বাবা চার্লস ক্যাভেন্ডিস ডিউকের সন্তান হিসেবে লর্ডের মর্যাদা পেয়ে আসছিলেন। নিজেও বৈজ্ঞানিক সমিতির সাথে যুক্ত থাকতেন। রয়েল সোসাইটির মেম্বার ছিলেন তিনি। ১৭৫৮ সাল থেকে তিনি তাঁর ছেলে হেনরিকে রয়েল সোসাইটিতে নিয়ে পরিচয় করিয়ে দিলেন অন্যান্য সদস্যদের সাথে। হেনরি সামাজিক কথাবার্তা পছন্দ না করলেও বৈজ্ঞানিক আলোচনাগুলি মনযোগ দিয়ে শুনতেন। রয়েল সোসাইটির বিভিন্ন কমিটির কাজকর্ম করতে পছন্দ করতেন। এভাবে কাজ করতে করতে ১৭৬৫ সালে তিনি নিজেও রয়েল সোসাইটির সদস্যপদ লাভ করেন।

ততদিনে তিনি নিজের বাড়িতে তাঁর নিজস্ব গবেষণাগার তৈরি করেছেন। ১৭৬৪ সালে গবেষণা শুরু করলেন আর্সেনিকের প্রভাব সম্পর্কে। এরপর কয়েক বছর ধরে করলেন তাপ সংক্রান্ত গবেষণা। তরল ও গ্যাসের ঘনীভবন নিয়ে ধারাবাহিক পরীক্ষণের মাধ্যমে তিনি তৈরি করলেন আপেক্ষিক তাপের তালিকা। কিন্তু এই গবেষণার কিছুই তিনি প্রকাশ করলেন না। ১৭৮৩ সালে এই গবেষণার কিছু অংশ প্রকাশিত হবার পর জানা যায় তিনিই প্রথম বিভিন্ন গ্যাসের আপেক্ষিক তাপ নির্ণয় করেছিলেন পরীক্ষণের মাধ্যমে।

বছরের পর বছর দিনরাত গবেষণায় ব্যস্ত থাকলেও – গবেষণার ফলাফল প্রকাশের ব্যাপারে তেমন কোন উৎসাহ ছিল না তাঁর। পঞ্চাশ বছরের গবেষণাজীবনে মাত্র বিশটির মতো গবেষণাপত্র প্রকাশ করেছিলেন তিনি। তাঁর প্রথম গবেষণাপত্র প্রকাশিত হয় ১৭৬৬ সালে রয়েল সোসাইটির ফিলোসফিক্যাল ট্রানিজেকশানে। রাসায়নিক বিক্রিয়ার ফলে যে গ্যাস বের হয় – তাদের ধর্ম সংক্রান্ত এই গবেষণাপত্রের জন্য তিনি লাভ করেন রয়েল সোসাইটির কোপলে মেডেল।

হেনরি ক্যাভেন্ডিসই প্রথম ধারাবাহিকভাবে গবেষণা করেন হাইড্রোজেন, কার্বন-ডাই-অক্সাইড  এবং অন্যান্য গ্যাসের ধর্ম সম্পর্কে। হাইড্রোজেনের ধর্ম সম্পর্কে তিনি এত বেশি গবেষণা করেছেন যে তাঁকে হাইড্রোজেন গ্যাস আবিষ্কারের কৃতিত্ব দেয়া হয়। তিনি তাঁর গবেষণাগারে অনেকগুলি গ্যাস তৈরি করে বোতলে সংগ্রহ করে রাখেন। এসিডে ধাতু দ্রবীভূত করে তিনি তৈরি করেছিলেন হাইড্রোজেন গ্যাস। যদিও তিনি এই গ্যাসের নাম দেননি। এই গ্যাসের দাহ্য রূপ দেখে তিনি একে দাহ্যগ্যাস হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। ১৭৮৩ সালে ফরাসি রসায়নবিদ আন্তন ল্যাভয়সিয়ের এই গ্যাসের নামকরণ করেন হাইড্রোজেন এবং সমস্ত কৃতিত্ব নিয়ে নেন। হেনরি ক্যাভেন্ডিস এসিডে ক্ষার দ্রবীভূত করে কার্বন-ডাই-অক্সাইড তৈরি করেন। অনেক ধরনের গ্যাস তৈরি করে তাদের ধর্ম পরীক্ষা করেছিলেন তিনি। গ্যাস কেমিস্ট্রির সূচনা হয় তাঁর হাতে। যদিও পরে এর কৃতিত্বও নিয়ে নেন ল্যাভয়সিয়ের।

১৭৭০ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী কয়েক দশকে বিদ্যুৎপ্রবাহ সংক্রান্ত প্রচুর গবেষণা করেছেন তিনি। কিন্তু বেশিরভাগ গবেষণার ফলাফল তিনি প্রকাশ করেননি। পানির ভেতর দিয়ে বিদ্যুৎ-প্রবাহ চালনা করার সময় ১৭৮১ সালে তিনি আবিষ্কার করলেন যে পানি মূলত হাইড্রোজেন আর অক্সিজেনের সমষ্টি। এতদিন পানি যে যৌগিক পদার্থ তা জানা ছিল না কারো। এই গুরুত্বপূর্ণ আবিষ্কারের ফলাফল প্রকাশেও তাঁর তেমন কোন উৎসাহ দেখা যায়নি। তবে তিন বছর পর ১৭৮৪ সালে তিনি পানি যে হাইড্রোজেন ও অক্সিজেনের সম্মিলিত প্রভাব – তা রয়েল সোসাইটিতে প্রকাশ করেন। কিন্তু তাঁর আগেই একই রকম আবিষ্কারের ফলাফল প্রকাশ করেছেন জেমস ওয়াট। আগে আবিষ্কার করলেও ফলাফল দেরিতে প্রকাশ করার কারণে বিজ্ঞানীদের মধ্যে এক ধরনের সন্দেহ তৈরি হয় – হেনরি ক্যাভেন্ডিস জেমস ওয়াটের ফলাফল চুরি করেছেন কি না। কোন ধরনের কৃতিত্বের মুখাপেক্ষি ছিলেন না হেনরি ক্যাভেন্ডিস – তাই কে কী বললো তাতে তার কিছুই যায় আসেনি।

১৭৮৫ সালে হেনরি ক্যাভেন্ডিস বাতাসের উপাদানগুলির শতকরা পরিমাণ হিসেব করেন। তাঁর নিখুঁত হিসেব থেকে দেখা যায় বাতাসে অক্সিজেন এবং নাইট্রোজেনের শতকরা পরিমাণ হিসেব করার পর কিছু অংশ তখনো কম থাকে। অর্থাৎ অন্য অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন ছাড়াও অন্য কোন গ্যাস বাতাসে মিশে আছে। কিন্তু কী সেই গ্যাস তা জানা যায়নি পরবর্তী একশ বছরেও। ১৮৯০ সালে ব্রিটিশ বিজ্ঞানী উইলিয়াম রামজে এবং লর্ড রেলেই আবিষ্কার করেন যে বাতাসে অক্সিজেন ও নাইট্রোজেন ছাড়া হিলিয়াম আর্গন ইত্যাদি নিষ্ক্রিয় গ্যাস মিশ্রিত আছে। হেনরি ক্যাভেন্ডিসের কাছে নিষ্ক্রিয় গ্যাস শনাক্ত করার মতো আধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না বলেই তিনি নিষ্ক্রিয় গ্যাসের ব্যাপারে কিছু বলতে পারেননি সেই সময়।

হেনরি ক্যাভেন্ডিসের সময় নিউটনের গতিসূত্রই ছিল গবেষণার মূল ভিত্তি। নিউটনের গতিবিদ্যা কাজে লাগিয়েই হেনরি ক্যাভেন্ডিস আবিষ্কার করেছিলেন পদার্থের গতির ফলেই তাপের সৃষ্টি হয়।

১৭৮৩ সালে তিনি প্রকাশ করেন পারদের ঘনীভবনের তাপমাত্রা সংক্রান্ত গবেষণাপত্র। সেখান থেকেই প্রথম জানা যায় পদার্থের সুপ্ততাপ বা ল্যাটেন্ট হিটের ব্যাপারটি। তিনিই প্রথম হিসেব করে দেখান তাপের ক্ষেত্রে শক্তির রক্ষণশীলতার নীতি।

হেনরি ক্যাভেন্ডিস তাঁর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গবেষণার ফলাফল প্রকাশ করেন ১৭৯৮ সালে – যেখানে তিনি পৃথিবীর ঘনত্বের হিসেব করেছেন। এই গবেষণায় তিনি নিজের হাতে তৈরি করেছিলেন খুবই সংবেদী নিক্তি – যেটা এখনো কেমব্রিজের ক্যাভেন্ডিস ল্যাবে রক্ষিত আছে।

কারো সাথেই কোন ব্যক্তিগত সম্পর্ক না রেখে শুধুমাত্র বিজ্ঞানকে বেছে নিয়েছিলেন তিনি তাঁর একমাত্র আগ্রহের বস্তু হিসেবে। রয়েল সোসাইটির বেশ কয়েকটি কমিটিতে তিনি কাজ করেছেন আক্ষরিক অর্থেই নিরবে। রয়েল সোসাইটি অব আর্টের সদস্য ছিলেন তিনি। ব্রিটিশ মিউজিয়ামের ট্রাস্টি ছিলেন, এবং ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব ফ্রান্সেরও বিদেশী সদস্য ছিলেন তিনি। দাপ্তরিক কাজকর্ম তিনি করতেন একা। কমিটির কোন মিটিং-এ তিনি কোন কথা বলতেন না। নিতান্তই বলতে হলে এক শব্দ দু’শব্দে কাজ সারতেন। কারো মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি কোনদিন কথা বলেননি।

ব্যক্তিগত জীবনে তিনি এতটাই অদ্ভুত ছিলেন যে যৌবনের শুরু থেকে আমৃত্যু শুধুমাত্র এক ধরনের পোশাকই পরে গেছেন। তাঁর দর্জিকে নির্দেশ দেয়া ছিল প্রতি বছর একটি নির্দিষ্ট দিনে হুবহু একই ধরনের এক সেট পোশাক তাঁকে তৈরি করে দেয়ার। তাঁর পোট্রেট তৈরি করার অনুমতি তিনি কাউকে কোনদিন দেননি। তাঁর একটিমাত্র পোট্রেট যা ব্রিটিশ মিউজিয়ামে রাখা আছে – আঁকা হয়েছিল গোপনে তাঁকে দূর থেকে দেখে দেখে।

তিনি মেয়েদের ব্যাপারে ছিলেন ভীষণ রকমের রক্ষণশীল। দুই বছর বয়সে নিজের মায়ের মৃত্যুর পর তিনি আর কোনো মেয়ের সাথে কথা বলেননি। বাড়িতে কাজের মেয়েদের সাথে যেন দেখা না হয়ে যায় – সেজন্য তিনি তাদের জন্য আলাদা সিঁড়ি তৈরি করে দিয়েছিলেন। সহকারীদের সাথেও কথা বলতেন না, নির্দেশ দিতেন – কাগজে লিখে। তবে বিদ্যুৎ প্রবাহ সম্পর্কিত গবেষণাগুলি করার সময় তিনি শুরুতে নিজের শরীরে কম মাত্রার বিদ্যুৎ প্রবাহ চালনা করে নিজের অনুভূতি লিখে রেখেছেন। এরপর শুরু হয়েছিল তাঁর কাজের লোকদের উপর বিদ্যুৎ চালনা। অনেকে ভয়ে কাজ ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন। একবার এক আমেরিকান অনুসন্ধিৎসু বিজ্ঞানী তাঁর গবেষণাগার দেখতে এলে তিনি তাঁর উপর দিয়েও বিদ্যুৎ চালনা করার প্রস্তাব দিয়েছিলেন – অবশ্যই লিখিত প্রস্তাব। ভয় পেয়ে সেই আমেরিকান পদার্থবিজ্ঞানী পালিয়ে গিয়ে পরে মন্তব্য করেছিলেন, “কোন ব্রিটিশ বিজ্ঞানী আমেরিকায় এলে আমরা তাকে গিনিপিগ হবার প্রস্তাব করতাম না।“

সারাজীবন একা একঘেঁয়ে জীবন কাটিয়ে শেষ বেলায় তাঁর অর্থ সম্পদের পরিমাণ দাঁড়িয়েছিল সেই ১৮০০ সালে এক মিলিয়ন পাউন্ডের উপর, যার বর্তমান মূল্যমান প্রায় একশ কোটি পাউন্ড। সেই অর্থের পুরোটাই তিনি তাঁর আত্মীয়স্বজন এবং সহকারীদের উইল করে দিয়ে গিয়েছিলেন। ১৮১০ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।

 তাঁর আত্মীয়দের অংশ থেকেই একটি বড় অঙ্কের অর্থ দিয়ে তাঁর মৃত্যুর ৬৪ বছর পর প্রতিষ্ঠিত হয়েছে ক্যাভেন্ডিস ল্যাব – যা তাঁর গৌরব বয়ে চলেছে। যে ল্যাব থেকে আবিষ্কৃত হয়েছে ইলেকট্রন, নিউট্রন, ডিএনএর গঠন, পালসার, রেডিও-অ্যাস্ট্রোনমি, কসমিক রে – এবং ভবিষ্যতে আরো অনেক কিছুর সম্ভাবনা।

 

তথ্যসূত্র

১। জন ওয়েস্ট, আমেরিকান জার্নাল অব লাং সেল মলিকিউলার ফিজিওলজি, সংখ্যা ৩০৭, ২০১৪।

২। ইওয়ান জেমস, রিমার্কেবল ফিজিসিস্টস, কেমব্রিজ ইউনিভার্সিটি প্রেস, ২০০৪।

৩। রাসেল ম্যাককরমাক, দ্য পার্সোনালিটি অব হেনরি ক্যাভেন্ডিস, স্প্রিঙ্গার, ২০১৪।

__________
বিজ্ঞানচিন্তা আগস্ট ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত







Saturday, 18 October 2025

অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা

 



যেকোনো দেশেই বিজ্ঞানীদের চিন্তার জগত স্বাভাবিক সামাজিক মানুষের চিন্তার জগত থেকে কিছুটা ভিন্ন। তাঁদের চিন্তাভাবনা জুড়ে থাকে আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের নেশা, নতুন জ্ঞান অর্জনের প্রতি প্রবল আগ্রহ। অনেক সময়েই দেখা যায় তাঁদের আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের ফলাফল যেসব জার্নালে প্রকাশিত হয়, এবং যে বৈজ্ঞানিক ভাষায় সেসব লেখা হয় – তা থাকে সাধারণ পাঠকের বোধগম্যতার বাইরে। ফলে এসব আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের গুরুত্ব অনেকসময়ই অজ্ঞাত থেকে যায়। বৈজ্ঞানিক ভাষাকে সাধারণ ভাষায় রূপান্তর করে বিজ্ঞানকে সাধারণ পাঠকদের কাছে নিয়ে আসার গুরুত্বপূর্ণ কাজটি করে বিজ্ঞান পত্রিকাগুলি। যেসব দেশে বিজ্ঞানপত্রিকার চাহিদা বেশি, সেসব দেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে উন্নত। সেসব দেশের শিক্ষার্থীরা বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ বোধ করে, এবং ভবিষ্যতে বিজ্ঞানী হবার লক্ষ্যে শৈশব কৈশোর থেকে প্রস্তুত হতে থাকে। বলা যায়, কোন দেশের বিজ্ঞানচর্চার ভিত তৈরিতে প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার বাইরে প্রধান ভূমিকা রাখে বিজ্ঞানপত্রিকাগুলি। আমাদের দেশে গত নয় বছর ধরে সেই ভূমিকা রেখে চলেছে মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা। বিজ্ঞানচিন্তার দশম বর্ষপূর্তিতে বিজ্ঞানচিন্তা প্রকাশনার সাথে যাঁরা যুক্ত, লেখক এবং পাঠক সবাইকে জানাই অভিনন্দন।

বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে নামী দুটো বিজ্ঞান সাময়িকীর নাম উল্লেখ করতে হলে – প্রায় সবাই একমত হয়ে বলবেন ‘সায়েন্স’ এবং ‘ন্যাচার’-এর কথা। ব্রিটিশ বিজ্ঞান সাময়িকী ‘ন্যাচার’ যাত্রা শুরু করেছিল ১৮৬৯ সালে। আর আমেরিকান বিজ্ঞান সাময়িকী ‘সায়েন্স’ শুরু হয়েছে ১৮৮০ সাল থেকে। সেই থেকে প্রতি সপ্তাহে এই সাময়িকী দুটো প্রকাশিত হয়ে আসছে, এবং প্রতিটি সংখ্যায় তাদের গ্রহণযোগ্যতা বাড়ছে। এই সাময়িকী দুটোর যে-কোনো একটিতে কোন প্রবন্ধ প্রকাশ করতে পারলে বিজ্ঞানীদের গৌরব বেড়ে যায় তরতর করে। এই জার্নাল দুটোর বিশেষ বৈশিষ্ট্য হলো – এখানে বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার ও উদ্ভাবনের জটিল প্রক্রিয়া এবং ফলাফল যেমন প্রকাশিত হয়, তেমনি সাধারণ পাঠকদের বোঝার জন্য পপুলার সায়েন্স বা জনপ্রিয় বিজ্ঞান-প্রবন্ধও প্রকাশিত হয়। সেজন্যই বিজ্ঞানীসমাজে তো বটেই, সাধারণ পাঠক সমাজেও এই সাময়িকী দুটোর গুরুত্ব অসীম।

জনপ্রিয় বিজ্ঞানবিষয়ের ম্যাগাজিনের নাম বলতে গেলে প্রথমেই আসে সায়েন্টিফিক আমেরিকান-এর নাম। ১৮৪৫ সাল থেকে নিয়মিত প্রকাশিত হচ্ছে বিশ্বব্যাপী অত্যন্ত জনপ্রিয় এই ম্যাগাজিন। পৃথিবীর যেকোনো প্রান্তের গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভাবন ও আবিষ্কারের ফলাফল বিজ্ঞানসাময়িকীতে প্রকাশিত হলে বা কোন গবেষণাগারে গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল পাওয়া গেলে তা সাধারণ পাঠকের বোধগম্য আকারে প্রকাশিত হয় ‘সায়েন্টিফিক আমেরিকান’-এ। একই আদলে যুক্তরাজ্যের ‘নিউ সায়েন্টিস্ট’ প্রকাশিত হয়ে আসছে ১৯৫৬ সাল থেকে। সে তুলনায় আমাদের বিজ্ঞানচিন্তার দশ বছর – সবে মাত্র যাত্রা শুরু হবার সমতুল্য।

জনসংখ্যার অনুপাতে আমেরিকা ও ইওরোপে যত সংখ্যক বিজ্ঞান সাময়িকী প্রকাশিত হয়, সেই তুলনায় আমাদের দেশে বিজ্ঞান সাময়িকী নেই বললেই চলে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে আমাদের সমাজ খুবই বিজ্ঞানবিমুখ সমাজ। এর পেছনে আর্থসামাজিক কারণ যেমন রয়েছে – খুব প্রকটভাবে আছে রাজনৈতিক কারণ। আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা পুরোপুরি পরীক্ষানির্ভর। সেখানে জ্ঞান অর্জনের চেষ্টার চেয়ে পরীক্ষায় ভালো নম্বর অর্জনের কৌশল শেখার প্রতি আগ্রহ তৈরি করা হয় বেশি। তাই দেখা যায়, আমাদের দেশে উচ্চমাধ্যমিক পর্যায়ে যত সংখ্যক বিজ্ঞানশিক্ষার্থী আছে – তার সংখ্যা অনেক দেশের মোট শিক্ষার্থীর চেয়ে বেশি হলেও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা থেকে বিজ্ঞানী তৈরি হয় খুব কম। প্রাতিষ্ঠানিক বিজ্ঞান শিক্ষার সাথে সত্যিকারের বিজ্ঞান শিক্ষার মধ্যবর্তী ফাঁক পূরণ করতে পারে বিজ্ঞান সাময়িকী। মাসিক বিজ্ঞানচিন্তা চেষ্টা করে যাচ্ছে সেব্যাপারে কীভাবে আমাদের নতুন প্রজন্মকে সহায়তা করা যায়।

আমাদের দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যাঁরা নিয়মিত বিজ্ঞান পড়ান, এবং কেউ কেউ যাঁরা গবেষণা করেন, তাঁদের মধ্যে বিজ্ঞান-লেখকের সংখ্যা খুবই কম, সম্ভবত পাঠকের সংখ্যাও । যেটুকু পড়াতে হবে – তার বাইরে নিজেরাও নতুন কিছু জানার জন্য কতটুকু পড়াশোনা করেন তা আমার জানা নেই। তবে খুবই ভালো হতো – যদি তাঁরাও নিয়মিত বিজ্ঞানচর্চা করতেন, বিজ্ঞান নিয়ে চিন্তা করতেন।

বিজ্ঞানচিন্তা বিজ্ঞান সম্পর্কে প্রিন্ট মিডিয়া ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় নিয়মিত লেখা প্রকাশের পাশাপাশি সারাদেশে বিজ্ঞানের জনপ্রিয়তা বাড়ানোর লক্ষ্যেও অনেক প্রকল্প চালু রেখেছে। নানা বিষয়ে বিজ্ঞান অলিম্পিয়াড আয়োজনে সক্রিয় সহযোগিতা করছে। এসবের ভেতর দিয়ে বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণ যে তৈরি করতে পারছে তাতে বোঝা যায় যে বিজ্ঞানচিন্তা সঠিক পথেই অগ্রসর হচ্ছে।

বিজ্ঞানচিন্তার হাত ধরে আমাদের সমাজ আরো অনেক বিজ্ঞানপ্রেমী, বিজ্ঞানমনস্ক হয়ে উঠবে এ ব্যাপারে আমি আশাবাদী। অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা।

--------

বিজ্ঞানচিন্তার অনলাইনে প্রকাশিত:

অভিনন্দন বিজ্ঞানচিন্তা

Latest Post

Terry Wogan's "The Little Book of Common Sense"

  What we call common sense in English is not very common at all. If common sense could be learned by reading books, then those who have re...

Popular Posts