কোয়ান্টাম মেকানিক্স যে পদার্থবিজ্ঞানের সবচেয়ে দুর্বোধ্য
বিষয় সে ব্যাপারে কারোরই কোন সন্দেহ নেই। এই বিষয়টি যে শুধুমাত্র পদার্থবিজ্ঞান শিক্ষার্থীদেরই
আতঙ্ক তা নয়, কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞান যাঁরা আবিষ্কার করেছেন সেসব নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানীদের
কাছেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স – এই একশ বছর পরেও – দুর্বোধ্য রয়ে গেছে। কোয়ান্টাম ইলেকট্রোডায়নামিক্সের
অন্যতম স্থপতি সবচেয়ে স্মার্ট পদার্থবিজ্ঞানীদের একজন রিচার্ড ফাইনম্যান সরাসরি মন্তব্য
করেছেন, “আমার মনে হয় আমি নিশ্চিতভাবে বলতে পারি যে কোয়ান্টাম মেকানিক্স কেউই ঠিক মতো
বোঝে না। যদি কেউ দাবি করে যে সে কোয়ান্টাম তত্ত্ব বোঝে, তাহলে বুঝতে হবে সে মিথ্যা
বলছে, অথবা তার মাথা খারাপ। [১]“ শুধু ফাইনম্যান নন, আরেকজন নোবেলজয়ী পদার্থবিজ্ঞানী
স্যার উইলিয়াম ব্র্যাগ কোয়ান্টাম তত্ত্বের রহস্যময়তা সম্পর্কে অনেকটা বিদ্রুপ করে বলেছেন,
“সোম, বুধ আর শুক্রবারে তড়িৎচুম্বকত্ব চালায় ফেরেশতারা – তরঙ্গতত্ত্ব দিয়ে; আর মঙ্গল,
বৃহস্পতি ও শনিবারে তড়িৎচুম্বকত্ব চালায় শয়তানরা – কোয়ান্টামতত্ত্ব দিয়ে।[২]“
শুরু থেকে হিসেব করলে কোয়ান্টাম তত্ত্বের বয়স এবছর একশ পঁচিশ
বছর পার হলো। শুরুতে সেই সময়ের প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীদের প্রায় সবাই ভেবেছিলেন এই তত্ত্ব
কারোরই কোন কাজে লাগবে না - অব্যবহারে অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে। উনিশ শতকের শেষের
দিকে পদার্থবিজ্ঞানীরা তো ধরেই নিয়েছিলেন যে পদার্থবিজ্ঞানের সব তত্ত্বই আবিষ্কৃত হয়ে
গেছে। কারণ নিউটনের ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স আর ইলেকট্রোডায়নামিক্স ব্যবহার করে শিল্পকারখানা
চলছে, উন্নত বিশ্বে যন্ত্রের যুগ শুরু হয়ে গেছে, তাপ-আলো-শব্দ-বিদ্যুৎ-চুম্বক সবকিছুর
ধর্ম জানা হয়ে গেছে। ১৮৭১ সালে কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ভাষণে বিজ্ঞানী জেমস ক্লার্ক
ম্যাক্সওয়েল বলেছিলেন, “কয়েক বছরের মধ্যেই পদার্থবিজ্ঞানের সবগুলি ধ্রুবকের মান নির্ণিত
হয়ে যাবে। আগামী দিনের পদার্থবিজ্ঞানীদের একমাত্র কাজ হবে সেসব মানের দশমিকের পরে আর
কয়েকটি সংখ্যা যোগ করা” [৩]। অথচ তখনো পদার্থবিজ্ঞানের কিছুই দেখেনি পৃথিবী। তড়িৎচুম্বক
তরঙ্গের সমস্ত কার্যক্রম ম্যাক্সওয়েলের তত্ত্ব দিয়ে প্রকাশ করার ব্যাপার কিছুটা দেখে
যেতে পেরেছিলেন ম্যাক্সওয়েল। কিন্তু ১৮৭৯ সালে মাত্র ৪৪ বছর বয়সে ম্যাক্সওয়েলের মৃত্যু
হয়। সে বছরই আইনস্টাইনের জন্ম।
উনবিংশ শতাব্দীর শেষের কয়েক বছর থেকে শুরু করে বিংশ শতাব্দীর
পুরোটাই ছিল পদার্থবিজ্ঞানের অগ্রগতির সময়। ১৮৯৫ সালে উইলহেম রন্টগেনের এক্স-রে আবিষ্কার,
১৮৯৬ সালে হেনরি বেকোয়ারেলের রেডিওঅ্যাকটিভিটি আবিষ্কার, ১৮৯৭ সালে জে জে থমসনের ইলেকট্রন
আবিষ্কার, মেরি ও পিয়ের কুরির তেজষ্ক্রিয় মৌল আবিষ্কার – পদার্থবিজ্ঞানীদের নতুন সমস্যার
সামনে দাঁড় করিয়ে দেয়। কারণ পরীক্ষণের মাধ্যমে আবিষ্কৃত এসবের কোনটারই সঠিক তত্ত্ব
তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের প্রচলিত তত্ত্ব দিয়ে এসবের কোনটাই সঠিকভাবে
ব্যাখ্যা করা সম্ভব হচ্ছিল না।
প্রচলিত তত্ত্বের মাধ্যমে আলো এবং তাপের বিকিরণের ঘটনাগুলির
সঠিক বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে ঝামেলায় পড়ছিলেন বিজ্ঞানীরা। দৈনন্দিন জীবনের একটি
সাধারণ ঘটনার কথাই ধরা যাক। একটি লোহার শিক যদি আমরা গরম করতে থাকি – লোহা তাপ শোষণ
করে এবং তার তাপমাত্রা ক্রমশ বাড়তে থাকে। তাপমাত্রা বাড়ার সাথে তাপের বিকিরণও ঘটতে
থাকে। তাপমাত্রার সাথে এই বিকিরণের সরাসরি সম্পর্ক আছে। লোহার ক্ষেত্রে তাপমাত্রা ৩০০
থেকে ৫০০ ডিগ্রি পর্যন্ত বাড়লে লোহা ক্রমশ লাল হয়ে ওঠে। আলোর ধর্ম থেকে আমরা জানি
– কোন বস্তুর রঙ নির্ভর করে সেই বস্তু থেকে কোন্ তরঙ্গের আলো বের হচ্ছে তার ওপর। লোহা
লাল হয়ে ওঠার অর্থ হলো – সেই তাপমাত্রায় লোহা থেকে লাল রঙের আলোক তরঙ্গের বিকিরণ ঘটছে।
আমরা সাধারণ চোখে আলোর যে বর্ণালী দেখতে পাই – তাদের মধ্যে লাল রঙের আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য
সবচেয়ে বেশি। লোহার তাপমাত্রা যদি আরো বেড়ে গিয়ে ৫০০ থেকে ৮০০ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত
উঠে যায়, তখন লোহাটি আরো ঘন লাল হতে হতে কমলা রঙের দিকে চলে যায়। তাপমাত্রা আরো বেড়ে
গিয়ে ১০০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে চলে গেলে লোহার রঙ হয়ে যায় কমলা থেকে উজ্জ্বল হলুদ। হলুদ
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য লাল আলোর চেয়ে কম। দেখা যাচ্ছে তাপমাত্রা বাড়ার সাথে সাথে বিকির্ণ
আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমে যাচ্ছে। তাপমাত্রা আরো বেড়ে গিয়ে ১৩০০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে চলে
গেলে লোহার রঙ হয়ে যায় উজ্জ্বল সাদা – তখন আলোর বর্ণালীর সবগুলি রঙ এক সাথে বিকির্ণ
হতে থাকে। তাপমাত্রা আরো বেড়ে গিয়ে ১৫৩৮ ডিগ্রির কাছাকাছি চলে গেলে কঠিন লোহা গলে তরল
হয়ে যায়। তখন উজ্জ্বল সাদার সাথে গাঢ় বেগুনি রঙের আলোও দেখা যায়। অর্থাৎ তখন আমাদের
দৃশ্যমান বর্ণালির সবচেয়ে কম তরঙ্গদৈর্ঘ্যের আলো বিকির্ণ হয়। তাপমাত্রা যদি আরো বাড়তে
থাকে – তাহলে বিকির্ণ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য আরো কমতে থাকবে।
চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞান এবং তড়িতচুম্বক তরঙ্গের সূত্র প্রয়োগ
করে এধরনের বিকিরণের গাণিতিক সমীকরণ বের করেন বিজ্ঞানী লর্ড র্যালে এবং স্যার জেমস
জিনস। র্যালে-জিনস সমীকরণ অনুসারে বিকিরণের তীব্রতা বস্তুর তাপমাত্রার সমানুপাতিক
এবং বিকিরণের তরঙ্গদৈর্ঘ্যের চতুর্থ মাত্রার ব্যস্তানুপাতিক। অর্থাৎ তরঙ্গদৈর্ঘ্য যদি
অর্ধেক হয়ে যায়, বিকিরণের তীব্রতা বেড়ে যাবে ষোল গুণ। দেখা গেলো দৃশ্যমান বর্ণালির
ক্ষেত্রে র্যালে-জিনস সমীকরণ ঠিকমতোই কাজ করছে। লোহা গরম হতে হতে লাল, কমলা, হলুদ,
বেগুনি হচ্ছে। অর্থাৎ লোহার তাপমাত্রা যতই বাড়ছে বিকিরণের তীব্রতা ততই বাড়ছে এবং আলোর
তরঙ্গদৈর্ঘ্য কমছে। কিন্তু এই ব্যাপারটি যদি পুরোপুরি সঠিক হয় – তাহলে তো আমাদের ভীষণ
ক্ষতি হয়ে যাবার কথা। যে তাপমাত্রায় লোহা গলে যায় – সেই তাপমাত্রায় বিকির্ণ আলোর তরঙ্গদৈর্ঘ্য
এত ছোট হয়ে যায় – যা অতিবেগুনি রশ্মি এবং এক্স-রে’র তরঙ্গদৈর্ঘ্য। সেই তরঙ্গ আমরা দেখতে
পাই না সত্য, কিন্তু সেগুলি যদি সরাসরি এই তীব্র মাত্রায় আমাদের শরীরে এসে পড়ে – আমাদের
তো অন্ধ হয়ে যাবার কথা, আমাদের শরীর পুড়ে যাবার কথা। কিন্তু সেরকম কিছু তো হয় না। অতিবেগুনি
রশ্মির পর থেকে র্যালে-জিনস সমীকরণের ব্যর্থতার নাম দেয়া হয়েছে ‘আলট্রাভায়োলেট ক্যাটাস্ট্রফি’
বা অতিবেগুনি বিপর্যয়।
কিন্তু বিপর্যয় মেনে নিয়ে বসে থাকা তো বিজ্ঞানীদের কাজ নয়।
এই ঘটনার বৈজ্ঞানিক কারণ তো নিশ্চয় আছে। প্রশ্ন হলো – কারণটি কী? ১৯০০ সালে এই প্রশ্নের
একটি গ্রহণযোগ্য উত্তর খুঁজে বের করলেন জার্মান পদার্থবিজ্ঞানী ম্যাক্স প্ল্যাংক। চিরায়ত
পদার্থবিজ্ঞানের তড়িৎচুম্বক তত্ত্ব অনুসারে শক্তির শোষণ যেমন অনবরত ঘটে, তেমনি বিকিরণও
অনবরত ঘটে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে সেই তত্ত্ব প্রকৃত ঘটনার সাথে পুরোপুরি মিলছে না। ম্যাক্স
প্ল্যাংক যা ঘটছে তাকে তত্ত্বের সাথে মেলানোর জন্য ধারণা দিলেন যে শক্তির শোষণও অবিচ্ছিন্নভাবে
ঘটছে না, বিকিরণও অনবরত অবিচ্ছিন্নভাবে ঘটছে না। বরং তা ঘটছে গুচ্ছ গুচ্ছভাবে বিচ্ছিন্নভাবে।
শক্তির গুচ্ছে কী পরিমাণ শক্তি থাকবে তা বোঝাতে তিনি ব্যবহার করলেন ল্যাটিন ভাষার একটি
শব্দ ‘কোয়ান্টা’ – যার অর্থ ‘কী পরিমাণ’। চিরায়ত পদার্থবিজ্ঞানের অবিচ্ছিন্নতাকে ছোট
ছোট শক্তিগুচ্ছ ‘কোয়ান্টা’য় রূপান্তরিত করার জন্য তিনি একটি ধ্রুবকের প্রচলন করলেন
– যাকে h দিয়ে চিহ্নিত করা হয় (যা তাঁর নামেই প্লাংক ধ্রুবক নামে বিখ্যাত হয়েছে)। প্ল্যাংক
প্রমাণ করলেন বিকিরণের শক্তি (E) তড়িতচুম্বক তরঙ্গের কম্পাঙ্কের (n) সমানুপাতিক। সমীকরণের ধ্রুবক ব্যবহার করে প্ল্যাংকের সমীকরণ
দাঁড়ায় E = hn, যেখানে h
= 6.62607015 x 10-34 জুল-সেকেন্ড। দেখাই যাচ্ছে প্ল্যাংক ধ্রুবক অত্যন্ত
ক্ষুদ্র একটি সংখ্যা। কিন্তু এই ক্ষুদ্র সংখ্যাটিই যে পদার্থবিজ্ঞানের পুরো ভবিষ্যত
বদলে দেবে তা সেদিন স্বয়ং ম্যাক্স প্ল্যাংকও ভাবতে পারেননি। এই কাজের জন্য ম্যাক্স
প্ল্যাংক পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯১৮ সালে।
ম্যাক্স প্ল্যাংকের ‘কোয়ান্টা’ থেকে শুরু হলো কোয়ান্টাম তত্ত্বের
যাত্রা। কিন্তু ১৯০০ সাল থেকে ১৯৩০ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনার মাধ্যমে কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে
জায়গা করে নিতে হয়েছে পদার্থবিজ্ঞানে। ১৯০০ সালের ১৪ ডিসেম্বর জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটির
প্রসিডিংস-এ যখন ম্যাক্স প্ল্যাংকের শক্তির কোয়ান্টাম সমীকরণের গবেষণাপত্র প্রকাশিত
হলো – অনেক প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞানীই ভেবেছিলেন এই ঘটনাটি একটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা। কিছুদিন
পরেই সবাই ভুলে যাবে এই পেপারের কথা। কিন্তু ঘটনা ঘটলো অন্যরকম।
সেই সময় একুশ বছরের তরুণ আলবার্ট আইনস্টাইন জুরিখ পলিটেকনিক
থেকে পাস করে একটি সাদামাটা চাকরি পাবার জন্য সংগ্রাম শুরু করেছেন। দীর্ঘ দুবছর বেকার
থাকার পর অবশেষে ১৯০৩ সালে তিনি প্যাটেন্ট অফিসে কেরানির কাজ শুরু করেছেন। ম্যাক্স
প্ল্যাংকের পেপারটি তাঁর হাতে এসেছে। প্যাটেন্ট অফিসের কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি চিন্তা
করছেন আলোর কণার শক্তি শোষণ ও বিকিরণের তত্ত্ব নিয়ে। আমরা এখন সবাই জানি ১৯০৫ সালে
আলবার্ট আইনস্টাইন একের পর এক চারটি গবেষণাপত্র প্রকাশ করে কীভাবে পদার্থবিজ্ঞানে বিপ্লব
ঘটিয়ে ফেলেছেন [৪]।
ম্যাক্স প্ল্যাংক তাপের বিকিরণের ক্ষেত্রে E = hn সমীকরণ প্রয়োগ করেছেন। আইনস্টাইন ভাবলেন তাপ শক্তির ক্ষেত্রে
যা কাজ করে, আলোর ক্ষেত্রেও তা কাজ করার কথা। তিনি আলোর কণা ‘ফোটন’ এর কথা চিন্তা করলেন।
এর আলোকে তিনি গাণিতিক ব্যাখ্যা দিলেন ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্টের। আলোর কোয়ান্টা বা ফোটনের
ধারণার ওপর ভিত্তি করে আইনস্টাইন দেখান যে, কোন বস্তুর উপর আলো পড়ার পর সে বস্তু থেকে
কিছু ইলেকট্রন নির্গত নয়। কিন্তু আলো পড়লেই যে ইলেকট্রন নির্গত হবে এমন কোন কথা নেই।
কিছু শর্ত মানলে তবেই ইলেকট্রন নির্গমন ঘটবে। ইলেকট্রন বেরিয়ে আসার জন্য কমপক্ষে একটা
নির্দিষ্ট পরিমাণ শক্তির দরকার হয়। আলো যেহেতু তড়িৎচুম্বকীয় তরঙ্গ, বস্তুর ওপর আলোকপাতের
ফলে বস্তু থেকে ইলেকট্রন নির্গত হবার ঘটনাকে বলা যায় একধরনের তড়িৎচুম্বকীয় বিকিরণ।
এই বিশেষ ধরনের বিকিরণের নাম ফটো-ইলেক্ট্রিক ইফেক্ট। ম্যাক্স প্ল্যাংকের শক্তির বিকিরণের
সূত্র অনুযায়ী পদার্থের ভেতর ইলেকট্রনগুলোকে পদার্থ একধরনের আকর্ষণ বল দ্বারা ধরে রাখে।
পদার্থ থেকে ইলেকট্রন বের করতে আনতে হলে এই আকর্ষণ বলের চেয়ে বেশি বল প্রয়োগ করতে হবে।
আইনস্টাইন হিসেব করে দেখান যে এই শক্তির পরিমাণ আলোর কম্পাঙ্কের সমাণুপাতিক। আরো সুনির্দিষ্টভাবে
বললে বলা যায়, শক্তি = প্ল্যাংকের ধ্রুবক x কম্পাঙ্ক। অর্থাৎ আলোর ক্ষেত্রেও প্ল্যাংকের
সূত্র সমানভাবে কাজ করে। আইনস্টাইন দেখান যে ইলেকট্রন নির্গত হবার জন্য যে ন্যূণতম
যে শক্তির দরকার হয় তা যদি আপতিত আলোর না থাকে, তাহলে ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্ট ঘটবে না।
যেমন, লাল আলোর একটি ফোটনের শক্তি খুবই কম। ফলে লাল আলো যদি
কোন পরমাণু দ্বারা শোষিত হয়, সেই পরমাণু থেকে ইলেকট্রন বের হবে না। কিন্তু যদি বেগুনি
ফোটন শোষিত হয়, সেক্ষেত্রে ইলেকট্রন বের হয়ে যেতে যে পরিমাণ শক্তি লাগবে তা বেগুনি
আলোর থাকে, ফলে ইলেকট্রন সেই শক্তি শোষণ করে পরমাণু থেকে বের হয়ে যায়। ইলেকট্রন কী
বেগে কী শক্তি নিয়ে বের হবে তা নির্ভর করবে সে কী পরিমাণ শক্তি ফোটন থেকে শোষণ করেছে
তার ওপর। আইনস্টাইন এই কাজের জন্য ১৯২১ সালের নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন। ফটো-ইলেকট্রিক
ইফেক্ট ব্যাখ্যা করার মাধ্যমে আইনস্টাইন কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ভিত্তিকে আরো অনেক শক্ত
করে দিলেন। কিন্তু তখনো অনেক কিছু বাকি। পরমাণুর তত্ত্ব তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এমনকি
পরমাণুর নিউক্লিয়াস, প্রোটন, নিউট্রন কিছুই আবিষ্কৃত হয়নি তখনো। তাই পরমাণু থেকে ইলেকট্রন
কীভাবে নির্গত হয় তা আরো ভালোভাবে বোঝার জন্য অপেক্ষা করতে হয়েছে ১৯১৩ সাল পর্যন্ত
যখন নিলস বোর পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। অবশ্য তার আগেই আরো অনেক যুগান্তকারী
ঘটনা ঘটে গেছে।
জার্মান জৈবরসায়নবিদ ওয়ালথার নার্নস্ট গবেষণা করছিলেন তাপগতিবিদ্যা
নিয়ে। তাপ বিকিরণের প্ল্যাংকের তত্ত্বকে তিনিও শুরুতে খুব একটা পাত্তা দেননি। কিন্তু
যখন দেখলেন আইনস্টাইনের ফটো-ইলেকট্রিক ইফেক্টের ব্যাখ্যায় শক্তির কোয়ান্টাম তত্ত্ব
আসলেই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে – তিনি নড়েচড়ে বসলেন। এই তত্ত্বকে বিজ্ঞানের সব রথিমহারথিদের
কাছে পৌঁছে দেয়ার জন্য তিনি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিজ্ঞান সম্মেলনের আয়োজন করলেন তাঁর
বন্ধু বিজ্ঞানী ও শিল্পপতি আরনেস্ট সলভের সহায়তায়। আমাদের মনে রাখতে সেই সময় ১৯১০-১১
সালে কোন ধরনের ইলেকট্রনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ছিল না। কোথাও কিছু আবিষ্কৃত হলে তা সাথে
সাথে সবার কাছে গিয়ে পৌঁছাতো না। বিজ্ঞানীদেরই উদ্যোগ নিয়ে চিঠি লিখে জানাতে হতো।
১৯১১ সালের ৩০ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ব্রাসেলস-এ
অনুষ্ঠিত হলো প্রথম সলভে কনফারেন্স। আরনেস্ট সলভে ছিলেন বেলজিয়ামের রসায়নবিদ এবং শিল্পপতি।
তাঁর রাসায়নিক উদ্ভাবনকে শিল্পে পরিণত করে তিনি প্রচুর ধনসম্পদের মালিক হয়েছেন এবং
বিজ্ঞানের উন্নতির কাজে সেই ধনসম্পদ উদারভাবে খরচ করছিলেন। ওয়ালথার নার্নস্ট আরনেস্ট
সলভেকে বোঝাতে সক্ষম হয়েছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের গুরুত্ব। প্রথম সলভে কনফারেন্স ছিল
শুধুমাত্র আমন্ত্রিত বিজ্ঞানীদের জন্য। ইওরোপের বিখ্যাত বিজ্ঞানীরা সেদিন একসাথে বসে
ঠিক করেছিলেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের ভবিষ্যৎ। প্রথম সলভে কনফারেন্সে উপস্থিত বিজ্ঞানীদের
প্রায় প্রত্যেকেই সেইসময় কিংবা পরবর্তীতে নোবেল
পুরষ্কার পেয়েছেন।
প্রথম সলভে কনফারেন্সে উপস্থিত বিজ্ঞানীরা |
সলভে কনফারেন্সের প্রভাবে কোয়ান্টাম তত্ত্বের পাখায় বাতাস
লাগলো। যাঁরা অংশ নিয়েছিলেন তাঁরা কোয়ান্টাম
তত্ত্বের প্রায়োগিক ভবিষ্যৎ আন্দাজ করতে পারলেন – শুধু পদার্থবিজ্ঞানে নয়, বিজ্ঞানের
অন্যান্য শাখাতেও। আর যেসব নবীন বিজ্ঞানী এই কনফারেন্সে যোগ দেয়ার আমন্ত্রণ পাননি
– তাঁরাও আগ্রহ নিয়ে জানলেন এই কনফারেন্সের প্রসিডিংস থেকে।
ডেনমার্কের তরুণ পদার্থবিজ্ঞানী নিলস বোর তখন গবেষণা করছিলেন
কেমব্রিজে আর্নেস্ট রাদারফোর্ডের তত্ত্বাবধানে। নিলস বোর কনফারেন্সে আমন্ত্রণ পাননি,
কিন্তু রাদারফোর্ড কনফারেন্স থেকে ফিরে খুবই উৎসাহ নিয়ে কোয়ান্টাম তত্ত্বের বিবরণ শোনালেন
নিলস বোরকে [৫]। রাদারফোর্ড সেই সময় পরমাণুর নিউক্লিয়াস এবং প্রোটন আবিষ্কার করেছেন।
কিন্তু কার্যকর পরমাণুর মডেল তখনো আবিষ্কৃত হয়নি। রাদারফোর্ড তড়িতচুম্বক তত্ত্ব দিয়ে
পরমাণুর একটি মডেল দাঁড় করাতে চেষ্টা করলেন। পরমাণুর কেন্দ্রে ধনাত্মক চার্জের প্রোটন
সম্বলিত নিউক্লিয়াসের চারপাশে ঋণাত্মক চার্জের ইলেকট্রনগুলি সৌরজগতের মতো ঘুরছে। ক্লাসিক্যাল
ফিজিক্স অনুযায়ী এভাবে যদি ঘুরতে থাকে – তাহলে ঘোরার জন্য ইলেকট্রনগুলির যে শক্তি খরচ
হবে – তাতে তো ঘুরতে না ঘুরতেই শক্তি হারিয়ে সবগুলি ইলেকট্রন পরমাণুর নিউক্লিয়াসের
সাথে ধাক্কা খেয়ে মরবে। কিন্তু তা তো হচ্ছে না। শুধুমাত্র হাইড্রোজেন পরমাণুর হিসেব
করলেই দেখা যাচ্ছে একটি হাইড্রোজেন পরমাণুর ইলেকট্রন ও প্রোটন মিশে গিয়ে চার্জহীন হয়ে
যাবার জন্য যে সময় লাগবে তার চেয়ে ১০৪০ গুণ বেশি সময় বেঁচে থাকছে [১]। এর
ব্যাখ্যা কী? ক্লাসিক্যাল মেকানিক্স এই ব্যাখ্যা দিতে ব্যর্থ।
সমস্যার সমাধানে এগিয়ে এলেন নিলস বোর – যিনি প্রথম সলভে কনফারেন্সে
দাওয়াতও পাননি। তিনি পরমাণুর কোয়ান্টাম তত্ত্ব আবিষ্কার করলেন। পরমাণুর কেন্দ্রে নিউক্লিয়াস
থাকে। ইলেকট্রনগুলি তার চার পাশে কুলম্ব বল এবং কেন্দ্রাতিগ বলের সমন্বয়ে ঘুরতে থাকে।
কিন্তু ইলেকট্রনগুলি যেভাবে খুশি সেভাবে থাকতে পারে না। তাদের প্রত্যেকেরই নির্দিষ্ট
শক্তিস্তর আছে, এবং একেকটি শক্তিস্তরে কতটি ইলেকট্রন থাকতে পারবে তা নির্দিষ্ট। ইলেকট্রনগুলি
একই পরমাণুর ভেতর এক শক্তি স্তর থেকে অন্য শক্তিস্তরে যেতে পারে – তবে তার জন্য খুবই
কঠিন শর্ত মানতে হয়। একই পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলি শুধুমাত্র উচ্চ শক্তিস্তর থেকে
নিম্নশক্তিস্তরে যেতে পারে যদি সেখানে জায়গা খালি থাকে। যেমন নিউক্লিয়াসের সবচেয়ে কাছের
শক্তিস্তর হলো সর্বনিম্ন শক্তিস্তর। এখানে সর্বোচ্চ দুইটি ইলেকট্রনের জায়গা আছে। এই
ইলেকট্রনগুলি যদি কোনভাবে অতিরিক্ত শক্তি পায়ও তাদের যেহেতু পরমাণুর ভেতর আর কোথাও
যাবার জায়গা নেই – তাদেরকে পরমাণু থেকে বের হয়ে আসতে হয়। তখন তাদের ফেলে আসা জায়গায়
উপরের শক্তিস্তর থেকে অন্য একটি ইলেকট্রন এসে ঢুকতে পারে। যেহেতু এই শক্তিস্তরে থাকার
জন্য কম শক্তির দরকার হয়, উচ্চ শক্তিস্তর থেকে আসা ইলেকট্রন সেই তার অতিরিক্ত শক্তি
বিকিরণ আকারে বের করে দেয়। এজন্যই পরমাণুর শক্তির বিকিরণ অবিচ্ছিন্ন নয়, বরং বিচ্ছিন্ন
– কোয়ান্টাম।
বোরের কোয়ান্টাম তত্ত্ব পদার্থবিজ্ঞানের জগতে আরো ঝড় তোলে।
পরমাণুর নিউক্লিয়াস এবং সেখান থেকে তেজষ্ক্রিয় বিকিরণ নির্গত হবার তত্ত্ব বের করার
একটা উপায় জানা গেলো। পরমাণুর ভেতর থেকে এক্স-রে কীভাবে নির্গত হয় – তারও ব্যাখ্যা
পাওয়া গেল। পরমাণুর ভেতর ইলেকট্রনগুলি উচ্চ শক্তিস্তর থেকে নিম্ন শক্তিস্তরে প্রবেশ
করলে অতিরিক্ত শক্তি এক্স-রের আকারে বের হয়ে যায়।
এদিকে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়েও এসে পৌঁছেছে ইওরোপের কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের খবর। মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসু তখন সবেমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়েছেন
পদার্থবিজ্ঞানের লেকচারার হিসেবে। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সব গবেষণাপত্রই তখন জার্মান
ভাষায় লেখা। সেই জার্মান ভাষা থেকে প্রধান প্রধান গবেষণাপত্রগুলি ইংরেজিতে অনুবাদ করলেন
মেঘনাদ সাহা ও সত্যেন বসু। ১৯২৪ সালে সত্যেন বসু উদ্ভাবন করলেন কোয়ান্টাম কণার সংখ্যায়ন
পদ্ধতি। আইনস্টাইনকে চিঠি লিখে পাঠালেন তাঁর নিজের গবেষণাপত্র [৬]। আইনস্টাইন সেই গবেষণাপত্র
জার্মান ভাষায় অনুবাদ করে প্রকাশ করলেন জার্মান ফিজিক্যাল সোসাইটির জার্নালে। রচিত
হলো ইতিহাস – পাওয়া গেল বোস-আইনস্টাইন কনডেনসেশান তত্ত্ব – যা কোয়ান্টাম তত্ত্বের একটি
অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য মাইলফলক।
কোয়ান্টাম তত্ত্বে বিভিন্ন সাফল্য দেখা গেলেও তখনো পর্যন্ত
এর মূল সমীকরণ পাওয়া যায়নি। চোখে দেখা যায় এরকম যেকোন পদার্থের অবস্থান এবং গতি যেমন
নির্ণয় করা যায় – নিউটনের গতির সূত্র দিয়ে, কোয়ান্টাম মেকানিক্সের ক্ষেত্রে সেরকম কোন
সমীকরণ তখনো প্রতিষ্ঠিত হয়নি। তাহলে একটি কোয়ান্টাম কণার গতি ও অবস্থান তত্ত্বীয়ভাবে
হিসেব করা হবে কীভাবে? বিজ্ঞানীরা তখনো জানেন না সেই প্রশ্নের উত্তর।
১৯২৩ সালে তেইশ বছরের ফরাসী যুবক লুই দ্য ব্রগলি তাঁর পিএইচডি
থিসিসে আলোর মতোই পদার্থেরও কণা এবং তরঙ্গ এই দুটো সত্ত্বাই যে থাকতে পারে তা উপস্থাপন
করলেন। তিনি দেখালেন যে কোনো পদার্থের তরঙ্গদৈর্ঘ্য (l) হবে তার ভরবেগের (mv) বিপরীতানুপাতিক। যেখানে ধ্রুবক হবে
প্ল্যাংকের ধ্রুবক (h)। দ্য ব্রগলির সমীকরণ এভাবে লেখা যায়: l = h/mv. ফোটন কণা তরঙ্গ অথবা কণা উভয় আকারেই থাকতে পারে
সেটা মেনে নেয়া যায়। কারণ ফোটন কণার ভর নেই – সে অর্থে ফোটন কণা পদার্থ নয়। কিন্তু
দ্য ব্রগলি দাবি করছেন যাদের নির্দিষ্ট ভর আছে – যেমন ইলেকট্রন, প্রোটন – তারাও নাকি
স্থির তরঙ্গের মতো আচরণ করতে পারে! সরবোন ইউনিভার্সিটিতে দ্য ব্রগলির থিসিস পরীক্ষকরা
মাথা চুলকোতে শুরু করলেন। এরকম নতুন তত্ত্ব আগে দেখেননি তাঁরা। কিন্তু আগে দেখেননি
বলে বাদ দেয়ার নিয়ম বিজ্ঞানে নেই। তাঁরা দ্য ব্রগলির থিসিস পাঠালেন আইনস্টাইনের কাছে।
আইনস্টাইন তখন নোবেলবিজয়ী পৃথিবীবিখ্যাত বিজ্ঞানী। তাঁর জেনারেল থিওরি অব রিলেটিভিটি
তাঁকে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনে দিয়েছে। পদার্থবিজ্ঞানের তত্ত্বে তখন আইনস্টাইনের মতামতের
গুরুত্ব অনেক। আইনস্টাইন দ্য ব্রগলির থিসিসে
কোন ভুল পেলেন না। দ্য ব্রগলি তাঁর বস্তু-তরঙ্গের তত্ত্বের জন্য পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল
পুরষ্কার পেয়েছেন ১৯২৯ সালে।
দ্য ব্রগলির তত্ত্ব শুধু যে নোবেল পুরষ্কার এনে দিয়েছে তা
নয় – কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রধান সমীকরণ তৈরিতেও বিশেষ ভূমিকা রেখেছে। অস্ট্রিয়ার
পদার্থবিজ্ঞানী আরভিন শ্রোডিঙ্গার জুরিখ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা শুরু করেছিলেন ১৯২১
সালে। ১৯২৩ সালে দ্য ব্রগলির তত্ত্ব প্রকাশিত হবার পর তিনি কোয়ান্টাম মেকানিক্সের কোয়ান্টাম
তরঙ্গের জন্য একটি কার্যকর সমীকরণ তৈরির চেষ্টা করছিলেন। কিন্তু প্রধান সমস্যা ছিল
– তরঙ্গকে প্রকাশ করবেন কীভাবে। কণাকে ভর এবং ভরবেগ দিয়ে প্রকাশ করা যায়। কিন্তু তরঙ্গ?
এই সমস্যার একটি অভিনব সমাধান তৈরি করলেন আরভিন শ্রোডিঙ্গার – তাঁর ওয়েভ ফাংশান (Y)
এর মাধ্যমে।
১৯২৬ সালে প্রকাশিত হলো কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ
সমীকরণ – শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ [৭-১০]। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রাণভোমরা বলা যায় এই
সমীকরণকে, কারণ যেকোনো কোয়ান্টাম দশার অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যত জানা যায় এই সমীকরণের যথাযথ
সমাধানের মাধ্যমে। কিন্তু প্রধান সমস্যা হলো এর ওয়েভ ফাংশান। এই ওয়েভ ফাংশান খুবই দুর্বোধ্য
এবং জটিল ধারণা। কোন একটি কোয়ান্টাম তরঙ্গের প্রায় সবগুলি জানা তথ্যই ওয়েভ ফাংশানে
থাকে। ওয়েভ ফাংশানের শর্ত এবং সীমা থেকেই বোঝা যাবে কতটুকু সঠিকভাবে কোন একটি কোয়ান্টাম
তরঙ্গের অবস্থান ও শক্তি মাপা যাবে।
দেখা যাক শ্রোডিঙ্গার সমীকরণটিকে সাধারণভাবে কীভাবে লেখা
যায়। সবচেয়ে সংক্ষিপ্ত আকারে এই সমীকরণকে লিখতে হলে লেখা যায় এভাবে:
এখানে y হলো ওয়েভ ফাংশান। ওয়েভ ফাংশানের ধারণাটি শ্রোডিঙ্গার নিয়েছেন
দ্য ব্রগলির বস্তু-তরঙ্গের ধারণা থেকে। যেকোন বস্তুকেই যেমন ভরবেগের সাথে তরঙ্গদৈঘ্যের
সম্পর্ক দিয়ে প্রকাশ করা যায়, তেমনি কোয়ান্টাম দশাকেও ওয়েভ ফাংশানের মাধ্যমে প্রকাশ
করা যায়। কোয়ান্টাম ওয়েভ ফাংশান একটি নির্দিষ্ট মুহূর্তের নির্দিষ্ট শক্তির কোয়ান্টাম
সিস্টেমের বর্ণনা দেয়। সমীকরণের বাম দিকের অংশ বোঝাচ্ছে যে সময়ের সাথে ওয়েভ ফাংশানের
অর্থাৎ কোয়ান্টাম সিস্টেমের কী পরিবর্তন ঘটবে। সমীকরণের ডান দিকে রয়েছে এই প্রশ্নের
উত্তর। সেখানে প্ল্যাংকের ধ্রুবক আছে – যাতে বোঝা যাচ্ছে পরিবর্তন যাই হবে তা হবে কোয়ান্টাম
পদ্ধতিতে। i হচ্ছে জটিল সংখ্যা। যা গণিতে মাইনাস ওয়ানের বর্গমূলের সমান। H হচ্ছে হ্যামিলটনিয়ান।
হ্যামিলটনিয়ান এখানে সরাসরি শক্তির সাথে সম্পর্কিত – যা জানতে চায় মোট কী পরিমাণ শক্তি
আছে সেই সিস্টেমের। ১৮৩৩ সালে আইরিশ গণিতবিদ উইলিয়াম হ্যামিলটন শক্তির এই ধারণা দেন।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সে অনেক সময় H = T + V এভাবে প্রকাশ করা হয়, যেখানে T কে গতিশক্তি
এবং H কে স্থিতিশক্তি ধরা হয়।
যে কোনো ভৌত অবস্থার মডেল তৈরি করতে গেলে শুরুতেই হিসেব করতে
হবে সেই সিস্টেমের মোট শক্তি কী পরিমাণ আছে, অর্থাৎ তার হ্যামিলটনিয়ান কেমন। হিসেবটা
খুব সহজ নয়। জানতে হবে সেই সিস্টেমে কতটি কণা এবং তরঙ্গ আছে, এবং তাদের নিজেদের শক্তি
কতটুকু আছে, এবং তাদের মধ্যে পারস্পরিক মিথস্ক্রিয়ার মাধ্যমে আর কী কী শক্তি সেখানে
যোগ হতে পারে বা ক্ষয় হতে পারে। তাদের মধ্যে কী কী ধরনের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া হতে পারে
তাদের সম্ভাব্য সবগুলিরই হ্যামিলটনিয়ান হিসেব করে যোগ করতে হবে পুরো সিস্টেমের হ্যামিলটনিয়ান
পাবার জন্য। কিন্তু এই হিসেব মাইক্রোস্কোপিক পর্যায়ে এতই জটিল যে কখনোই পুরোপুরি হ্যামিলটনিয়ান
সুনির্দিষ্টভাবে পাওয়া সম্ভব হয় না, শুধুমাত্র সম্ভাবনার হিসেব করা যায়। সেই সম্ভাবনার
হিসেবে অনিশ্চয়তার পরিমাণ যত কম হবে, হিসেব ততই সুনির্দিষ্ট হবে।
যদি কোন সিস্টেমের হ্যামিলটনিয়ানের কোন পরিবর্তন না ঘটে,
অর্থাৎ শক্তি যদি স্থির থাকে, তাহলে সময়ের সাপেক্ষে সেই সিস্টেমের ওয়েভ ফাংশানের কোন
পরিবর্তন হবে না। ওয়েভ ফাংশান সিস্টেমের অনেকগুলি সম্ভাব্য অবস্থার সুপারপজিশান হতে
পারে। কোয়ান্টাম মেকানিক্স সম্ভাব্য সবগুলি অবস্থার সমন্বয় করে বলেই এটি এত জটিল।
১৯২৬ সালে শ্রোডিংগার সমীকরণ প্রকাশের পর থেকে পরবর্তী এক
শ বছরে কোয়ান্টাম মেকানিক্সের অগ্রগতি আর থেমে থাকেনি। কোয়ান্টাম মেকানিক্সকে কাজে
লাগিয়ে পুরো পৃথিবীর প্রযুক্তি বদলে গেছে। তবে কোয়ান্টাম মেকানিক্স এখনো সেই দুর্বোধ্যি
রয়ে গেছে।
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের সাহায্যে পাওয়া গেছে প্রতি-পদার্থ।
রেডিওঅ্যাকটিভির তত্ত্ব এবং নিউক্লিয়াসের ভেতরের বিপুল শক্তি সম্পর্কে জানা গেছে কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের মাধ্যমে। ফলে পৃথিবী যেমন পারমাণবিক বোমার ধ্বংসযজ্ঞ দেখেছে, তেমনি পেয়েছে
নিউক্লিয়ার শক্তির বিপুল আধার। কোয়ান্টাম মেকানিক্সের হাত ধরেই আমরা জেনেছি সেমিকন্ডাক্টরের
আশ্চর্য জগত সম্পর্কে। আমাদের হাতে হাতে এখন কম্পিউটার প্রযুক্তি – যার পুরোটাই এসেছে
কোয়ান্টাম মেকানিক্সের প্রয়োগে। এই শতাব্দীতে আমরা কোয়ান্টাম কম্পিউটার পাবার আশা করছি।
আধুনিক চিকিৎসাবিজ্ঞানের সবচেয়ে কার্যকর প্রযুক্তি – এম-আর-আই, সি-টি, লেজার সবকিছুর
মূল তত্ত্বই কোয়ান্টাম মেকানিক্স দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। কণা পদার্থবিজ্ঞান কোয়ান্টাম মেকানিক্স
ছাড়া অচল।
শুধু পদার্থবিজ্ঞান নয়, প্রাণরসায়ন এবং জীববিজ্ঞানের অনেক
কিছুই যা প্রচলিত বিজ্ঞান দিয়ে ব্যাখ্য করা যাচ্ছে না, কোয়ান্টাম বায়োলজি সেখানে বিপুল
সম্ভাবনা নিয়ে হাজির হচ্ছে। আগামী কয়েক দশকের মধ্যেই আমরা কোয়ান্টাম বায়োলজির সুফল
পেতে চলেছি। মজার বিষয় হচ্ছে সব ধরনের কোয়ান্টাম সিস্টেমের জন্যই আমাদের দরকার হয় সঠিক
ওয়েভ ফাংশান এবং হ্যামিলটনিয়ান। তারপর শ্রোডিঙ্গার সমীকরণের সমাধান করতে পারলেই হাতে
হাতে ফল।
কিন্তু ব্যাপারটি মোটেও সহজ নয়। কারণ কোয়ান্টাম মেকানিক্স
এত সূক্ষ্ম বস্তু নিয়ে কাজ করে যে তাদের সবগুলি মিথস্ক্রিয়ার সম্ভাবনা হিসেব করা ভীষণ
দুরুহ। সেজন্যই কোয়ান্টাম মেকানিক্স সবসময় সম্ভাবনার কথা বলে। একটি ইলেকট্রনের কোন
নির্দিষ্ট সময়ের অবস্থান বের করতে গেলে আমরা শুধু তার অবস্থানের সম্ভাবনাটুকু হিসেব
করতে পারবো, কিন্তু নির্দিষ্টভাবে বলতে পারবো না ঠিক কোথায় থাকবে। একটি হাইড্রোজেন
পরমাণুতে শুধুমাত্র একটি ইলেকট্রন আছে। সেই ইলেকট্রনটি তার কক্ষপথে অবিরাম ঘুরছে, আবার
নিজে নিজেও ঘুরছে। আমরা জানি সে কক্ষপথে থাকবে। কিন্তু কক্ষপথের ঠিক কোন জায়গায় থাকবে
তা বলা অসম্ভব। কারণ তা বলতে গেলে ঠিক কি ভুল দেখতে হবে – দেখতে হলে ইলেকট্রনটিকে থামিয়ে
দিতে হবে। তাহলে কীভাবে জানা যাবে থামার আগে সে কোথায় ছিল? শুধুমাত্র একটি ইলেকট্রন
নিয়েই এই সমস্যা, সেখানে একটি বড় মৌলের – ধরা যাক টাংস্টেন – যেখানে ৭৪টি ইলেকট্রন
আছে, ক্যাথোড থেকে আসা লক্ষ লক্ষ ইলেকট্রনের সাথে এই ইলেকট্রনগুলির সংঘর্ষের ফলে যে
এক্স-রে উৎপন্ন হয় এক্স-রে মেশিনে – সেখানে সবগুলি ইলেকট্রনের হ্যামিলটনিয়ান সঠিকভাবে
বের করা কি সহজ কাজ?
কিন্তু তবুও আমাদের
কাজ চলছে – আমরা পুরোপুরি না বুঝেও কোয়ান্টাম মেকানিক্স ব্যবহার করছি, কোয়ান্টাম প্রযুক্তি
ব্যবহার করছি। গত একশ বছরের কোয়ান্টাম প্রযুক্তি আমাদের যে উৎকর্ষতা দিয়েছে, সামনের
দিনের কোয়ান্টাম কম্পিউটিং এবং কোয়ান্টাম বায়োলজি আমাদের কোথায় নিয়ে যায় – এবার সেটা
দেখার পালা।
তবে একটা ব্যাপারে সাবধান করে দেয়া কর্তব্য – সেটা হলো কোয়ান্টাম
মেকানিক্সের দুর্বোধ্যতাকে পুঁজি করে অনেকেই সংঘবদ্ধভাবে মানুষকে প্রতারণা করছে। কোয়ান্টাম
সাকসেস, কোয়ান্টাম লিডারশিপ, কোয়ান্টাম হিলিং, কোয়ান্টাম ইয়োগা, কোয়ান্টাম মাইন্ড,
কোয়ান্টাম সাইকোলজি, কোয়ান্টাম হ্যাপিনেস ইত্যাদি অসংখ্য প্রতিষ্ঠান টাকা উপার্জন করছে
মানুষের সাথে প্রতারণা করে। তাঁরা কী করছে সেটা তাদের ব্যাপার – কিন্তু এটুকু নিশ্চিতভাবে
বলা যায় – এগুলির সাথে মূল কোয়ান্টাম পদার্থবিজ্ঞানের কোন সম্পর্ক নেই। এদের ওয়েভ ফাংশান
বা হ্যামিলটনিয়ান হিসেব করে শ্রোডিঙ্গার সমীকরণ সমাধানের কোন উপায় নেই।
তথ্যসূত্র
১। জেমস লিজ, ‘ফিজিক্স ইন ফিফটি মাইলস্টোন মোমেন্টস’, কোয়াড
বুক্স, ব্রাইটন, ২০১৭। পৃ ১৪৩।
২। জোয়ান ব্যাকার, ‘ফিফটি ফিজিক্স আইডিয়াস ইউ রিয়েলি নিড
টু নো’, কোয়ের্কাস, লন্ডন, ২০০৭। পৃ ১০৩।
৩। ম্যাক্স টেগমার্ক ও জন হুইলার, সায়েন্টিফিক অ্যামেরিকান,
ফেব্রুয়ারি ২০০১, পৃষ্ঠা ৬৮-৭৫।
৪। প্রদীপ দেব, ‘সবার জন্য আইনস্টাইন’, তাম্রলিপি, ঢাকা,
২০২০।
৫। রবার্ট পি ক্রিজ, ‘দ্য গ্রেট ইকুয়েশানস’, রবিনসন, লন্ডন,
২০০৯।
৬। প্রদীপ দেব, ‘সত্যেন্দ্রনাথ বসু: বোসন কণার জনক’, মীরা
প্রকাশন, ঢাকা, ২০১৯।
৭। জিম আল-খলিলি, ‘কোয়ান্টাম: আ গাইড ফর দ্য পারপ্লেক্সড’,
ওয়াইডেনফেল্ড অ্যান্ড নিকলসন, লন্ডন, ২০১২।
৮। শন ক্যারোল, ‘সামথিং ডিপলি হিডেন: কোয়ান্টা, ওয়ার্ল্ডস
অ্যান্ড দি ইমার্জেন্স অব স্পেস-টাইম’, ডাটন, আমেরিকা, ২০১৯।
৯। রিচ ককরেইন, ‘দ্য সিক্রেট লাইফ অব ইকুয়েশানস’, ক্যাসেল,
লন্ডন, ২০১৬।
১০। মনজিত কুমার, ‘কোয়ান্টাম’, আইকন বুকস লিমিটেড, লন্ডন,
২০১৪।
==========
বিজ্ঞানচিন্তা ফেব্রুয়ারি ২০২৫ সংখ্যায় প্রকাশিত