Wednesday 31 January 2024

দারুচিনি দ্বীপের ভিতর ১

 




এয়ারপোর্টে যাবার জন্য রেডি হয়ে উবার রাইড কনফার্ম করতে যাবো – এই সময় ফোনটি এলো। শ্রীলংকান এয়ারলাইনসের মেলবোর্ন অফিসের একজন নাকিসুরে টেনে টেনে ইংরেজিতে যা বললেন, বাংলায় গুগল ট্রান্সলেশান করলে তা শোনাবে এরকম: জনাব, আপনার আজ বিকেল পাঁচটা পঁচিশ মিনিটের শ্রীলংকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট সংখ্যা ইউ এল ছয় শূন্য পাঁচ দুই ঘন্টা পনের মিনিট বিলম্ব করা হয়েছে। শ্রীলংকান এয়ারলাইনস ফ্লাইট সংখ্যা ইউ এল ছয় শূন্য পাঁচ উড্ডয়ন করার নতুন সময় সন্ধ্যা সাতটা চল্লিশ মিনিট। আপনার সাময়িক অসুবিধার জন্য শ্রীলংকান এয়ারলাইনস অত্যন্ত দুঃখিত।

আমি কিছু বলার আগেই ফোন কেটে গেল। সম্ভবত রেকর্ডেড কল – সব প্যাসেঞ্জারকে পাঠাচ্ছে। তবুও ভালো যে রওনা দেবার আগে জানিয়েছে। ইমেইলও এলো প্রায় সাথে সাথে। মেলবোর্ন থেকে সরাসরি কলম্বো প্রায় সাড়ে দশ ঘন্টার ফ্লাইট। পৌঁছানোর কথা ছিল শ্রীলংকান সময় রাত সাড়ে দশটার দিকে। এখন সাতটা চল্লিশে ছাড়লে পৌঁছাবে মধ্যরাতের পর। হোটেল থেকে গাড়ি আসার কথা এয়ারপোর্টে। ওদেরকে জানাতে হবে ফ্লাইট ডিলের ব্যাপারটা। ওরা নিজেরাই হয়তো চেক করবে ফ্লাইট স্টেটাস, কিন্তু আমারও তো একটা দায়িত্ব আছে।

ঘন্টা দুয়েক এক্সট্রা সময় পাওয়া গেল। কিন্তু দু’ঘন্টা পর বের হলে পিক-আওয়ারে আধঘন্টার জায়গায় দু’ঘন্টা লাগবে এয়ারপোর্টে পৌঁছাতে। খ্রিস্টমাসের ছুটি শুরু হচ্ছে কাল থেকে। আজ বিকেল থেকেই মানুষ বেরিয়ে পড়বে ছুটির আনন্দে। আবার উবার ডাকতে গিয়ে বুঝতে পারলাম খ্রিস্টমাসের সুপার পিক-আওয়ারের প্রভাব। আটচল্লিশ ডলারের ভাড়া এখন হয়ে গেছে ছিয়াশি ডলার। তারপরও কয়েক মিনিট লাগলো রাইড কনফার্মড হতে।

ফ্রিওয়েতে বাম্পার টু বাম্পার ট্রাফিক থাকলেও খুব একটা দেরি হলো না এয়ারপোর্টে পৌঁছতে। যেরকম উপচে পড়া ভীড় আশা করেছিলাম – সেরকম ভীড় এখনো হয়নি। ভেবেছিলাম শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের কাউন্টার খুলতে আরো দেরি হবে। কিন্তু দেখলাম ফ্লাইট ডিলে থাকলেও ওরা ঠিক সময়েই কাউন্টার খুলে রেগুলার কাজকর্ম করছে। কাউন্টারে খুব একটা ভীড় নেই। বোর্ডিং-পাসের সাথে বিশ ডলারের একটা ফুড ভাউচারও দিলো – দেরির সামান্য ক্ষতিপূরণ। এয়ারলাইন্সের এটুকু সৌজন্য দেখে মনে হলো তারা সত্যই আন্তরিক।

হাতে সময় থাকলে এয়ারপোর্টের ভেতর-বাহির ঘুরে দেখা আমার পুরনো অভ্যেস। মেলবোর্ন এয়ারপোর্ট আয়তনে খুব একটা বড় নয়। এখন কিছুটা এক্সটেনশান হচ্ছে। কিন্তু তাতে খুব একটা দৃষ্টিনন্দন কিছু হচ্ছে বলে মনে হয় না। ইন্টারন্যাশনাল ডিপার্চার এরিয়ার ঘিঞ্জি অবস্থা দেখলে মনে হবে তৃতীয় বিশ্বের প্রচণ্ড ঘনবসতিপূর্ণ কোন দেশের এয়ারপোর্ট।

হলিউডের সিনেমায় খ্রিস্টমাসের মুভিতে যেরকম ঠাসাঠাসি ভীড় আর ক্যাওস দেখায় এয়ারপোর্টে, সেরকম কোনকিছুর কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না এখনো। দক্ষিণ গোলার্ধে অবস্থানের কারণে অস্ট্রেলিয়া নিউজিল্যান্ডে খ্রিস্টমাসের সময় বরফ-পড়া তুষারঢাকা পরিবেশ কখনোই তৈরি হয় না। তাছাড়া ইওরোপ-আমেরিকার মতো অত উল্লাসও নেই খ্রিস্টমাস উপলক্ষে। নামকাওয়াস্তে কিছু খ্রিস্টমাস ট্রি সাজানো হয়েছে শপিং-মলগুলিতে। কিন্তু এয়ারপোর্টে আলাদা কোন সাজসজ্জাই করা হয়নি।

সিকিওরিটি গেট পার হবার আগেই ফুড ভাউচারের সদ্ব্যাবহার করা দরকার। ফুডকোর্টের অবস্থা ভয়াবহ। খুব বেশি অপশন নেই। টার্মিনাল-১ আর টার্মিনাল-২ এর মাঝখানের রাস্তায় দুটো মদের দোকান, একটি ভিয়েতনামি এবং একটি গ্রিক রেস্টুরেন্ট। টার্মিনাল-৩ এর  দিকে যাবার সময় আরো কয়েকটা আছে – কিন্তু সেদিকে যেতে ইচ্ছে করলো না।  চিকেন বার্গার আর সফ্‌ট ড্রিঙ্ক নিয়ে বসলাম বারান্দায়। এখান থেকে রানওয়ে দেখা যাচ্ছে। হাতে এখনো অফুরন্ত সময়।

ফোন বাজলো।

“অর্না, কী অবস্থা?”

“বাসায় যাচ্ছি দাদা।“

“তিনটা বাজে বাসায় চলে যাচ্ছিস! তোর না পাঁচটা পর্যন্ত কাজ?”

“লাঞ্চের পরে সবাই চলে গেছে। আমিও বের হয়েছি অনেক আগে। জ্যামে বসে আছি। ভয়াবহ জ্যাম এখন প্লেনটি রোডে। তুমি কি চেক ইন করে ফেলেছো?”

“আমার ফ্লাইট দুই ঘন্টা ডিলে। এখন বসে বসে খাচ্ছি। স্পাইসি বার্গারের অর্ডার দিয়েছিলাম। মনে হচ্ছে ঘাসে মোড়ানো সিদ্ধ চিকেন খাচ্ছি। সে কোন ঝালই দেয়নি।“

“কোত্থেকে খাচ্ছো?”

“গ্রিক রেস্টুরেন্ট একটা আছে এদিকে টার্মিনাল-১ এ ঢোকার মুখে।“

“গ্রিক রেস্টুরেন্টে তুমি ঝাল কোথায় পাবে? ওরা তো লংকা খায় না। লংকা কেন, তেমন কোন মসলাই তো ওরা খায় না। ওরা …”

গ্রিকদের খাদ্যতালিকা সম্পর্কে দীর্ঘ বর্ণনা শুরু করার আগেই অর্নাকে থামিয়ে দিলাম পরে কথা হবে বলে। কিন্তু মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে লংকা শব্দটি।

পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা মরিচকে লংকা বলে। অর্না পুরোদস্তুর বাংলাদেশি, পশ্চিমবঙ্গে কখনও যায়ওনি। কিন্তু মেলবোর্নে তার পশ্চিমবঙ্গীয় সখিদের প্রভাবে তার কথাবার্তা শুনলে মাঝে মাঝে মনে হবে তার জন্ম বোলপুরের আশেপাশে। অবশ্য শান্তিনিকেতনে কি মরিচকে লংকা বলা হয়? জানি না। পশ্চিমবঙ্গের বাঙালিরা মরিচকে কেন লংকা বলে আমি আজও জানি না। হতে পারে শ্রীলংকার সাথে মরিচের কোনো ওতপ্রোত সম্পর্ক আছে। সেভাবে ধরতে গেলে তো মরিচের সাথে উথাল-পাতাল সম্পর্ক আমাদের বাংলাদেশি বাঙালিদের। বিশেষ করে সময়ে-অসময়ে কাঁচা মরিচের দাম যখন জ্বালদেয়া দুধের মতো উথলে উঠে – দামের টানাটানিতে বাজেটের কাছা খুলে গেলেও কাঁচামরিচ ছাড়ি না আমরা।

মানি এক্সচেঞ্জে একটু ঢুঁ মেরে দেখলাম শ্রীলংকান রুপির দাম কত। তাদের সাফ জবাব, সরি, উই ডোন্ট ট্রেড শ্রীলংকান রুপিজ।

হেলে দুলে ইমিগ্রেশান গেটের কাছে গিয়ে আঁৎকে উঠলাম। এত মানুষ এতক্ষণ কোথায় ছিল? গিজ গিজ করছে মানুষ। এখানে ইমিগ্রেশান পার হবার আগে সিকিউরিটি চেকিং। ঠাসাঠাসি লাইনের দৈর্ঘ্য আর এগোনোর গতি দেখে মনে হচ্ছে ঘন্টা পেরিয়ে যাবে মেটাল ডিকেক্টর পর্যন্ত পৌঁছাতে।

অনেকের ফ্লাইটে বোর্ডিং শুরু হয়ে গেছে – অথচ লাইনে আটকে আছেন। এয়ারলাইনসের লোক এসে তাদের ডেকে ডেকে নিয়ে যাচ্ছেন। যারা ম্যানেজ করছেন – তাদের কর্মতৎপরতা দেখে মনে হচ্ছে তারা ধীরে কাজ করার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। যার যতই ব্যস্ততা থাকুক – তারা তাদের কাজের গতি কিছুতেই বাড়াবে না।

প্রায় দেড় ঘন্টা লাগলো সিকিউরিটি চেকিং পার হতে। দেখলাম এরা পুরনো মেশিন সব বদলে ফেলেছে। এখন ল্যাপটপ বা এজাতীয় ইলেকট্রনিক্স আর ব্যাগ থেকে বের করতে হয় না। মেটাল ডিকেক্টরের বদলে বিশাল সাইজের বডি স্ক্যানার বসিয়েছে। কিন্তু সেগুলি যারা অপারেট করছেন তাদের ভেতর কেমন যেন একটা ঢিমেতালা ভাব।

ইমিগ্রেশান এখন পুরোটাই অটোম্যাটেড। মেশিনে পাসপোর্ট স্ক্যান করলেই গেট খুলে যাচ্ছে। অস্ট্রেলিয়া পাসপোর্টে সিল মারা বন্ধ করেছে অনেক বছর হয়ে গেল। আগে একটা বহির্গমন কার্ড পূরণ করতে হতো। সেটাও এখন আর পূরণ করতে হয় না।

ডিউটি ফ্রি শপের ভেতর দিয়ে যাবার সময় বোঝা যাচ্ছে খ্রিস্টমাসের প্রভাব। অন্যসময় এত ভীড় থাকে না এখানে।

আমার ফ্লাইটের বোর্ডিং চার নম্বর গেটে। কিন্তু সেখানে গিয়ে দেখি নিউজিল্যান্ডের ফ্লাইটের শিডিউল দেখাচ্ছে রাত আটটায়। কিন্তু তার আগের সাতটা চল্লিশের ফ্লাইটের কোন শিডিউল সেখানে নেই। হেঁটে গিয়ে জেনারেল ডিসপ্লে দেখলাম – আমাদের ফ্লাইটের গেট পরিবর্তন হয়েছে। এখন তা পাঁচ নম্বর গেটে গেছে। পাঁচ নম্বর গেট চার নম্বরের পাশাপাশি নয়, সম্পূর্ণ অন্যদিকে। গেলাম সেখানে। প্রচন্ড ভীড়। ভীড়টা কলম্বোগামী যাত্রীদের শুধু নয়, জেট স্টারের একটা ফ্লাইট যাচ্ছে ক্রাইস্টচার্চে – তাদেরও।

অনলাইনে ফ্লাইট স্ট্যাটাস দেখে বুঝতে পারলাম – অনেক ঝামেলা আছে সামনে। শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের যে বিমান আমাদের কলম্বো নিয়ে যাবে – সেই ফ্লাইট ইউ এল সিক্স জিরো ফোর এখনো কলম্বো থেকে এসে পৌঁছায়নি। মেলবোর্ন এয়ারপোর্টের এরাইভ্যাল শিডিউলে ফ্লাইটটির কোন চিহ্নও নেই। স্কাই স্ক্যানারের পেজে দেখলাম ওই ফ্লাইট মেলবোর্নে এসে পৌঁছাবে সাতটার দিকে। তার মানে সাতটা চল্লিশে ফ্লাইট ছাড়ার কোন সম্ভাবনা নেই।

ক্রাইস্টচার্চের ফ্লাইট চলে যাবার পর পাঁচ নম্বর গেটে কোলাহল আরো বেড়েছে। যাত্রীদের মধ্যে প্রচুর শ্বেতাঙ্গ অস্ট্রেলিয়ান শ্রীলংকা ভ্রমণে যাচ্ছেন। বাকিরা প্রায় সবাই শ্রীলংকান অথবা ভারতীয় বংশোদ্ভূত অস্ট্রেলিয়ান বলে মনে হচ্ছে।

কোভিডের কারণে শ্রীলংকার পর্যটনে ধ্বস নেমেছিল। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ তাদের এতই কমে গিয়েছিল যে মনে হচ্ছিলো তারা দেউলিয়া হয়ে গেছে। অর্থনৈতিক বিপর্যয় থেকে রাজনৈতিক সংঘাতে জড়িয়ে পড়েছিল পুরো জাতি। এখন মনে হচ্ছে তারা ভালোভাবেই তা কাটিয়ে উঠেছে। আবারো পর্যটনের দেশ হয়ে উঠেছে শ্রীলংকা। কিন্তু তাদের রাষ্ট্রীয় এয়ারলাইন্সের অবস্থা তো মনে হচ্ছে আমাদের বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের মতোই। যাত্রীরা অনিশ্চয়তায় হাঁসফাঁস করছে। কিন্তু এয়ারলাইন্সের পক্ষ থেকে কোন আপডেট নেই।

হঠাৎ অনেকে খুশিতে চিৎকার করে হাততালি দিয়ে উঠতেই বাইরে তাকিয়ে দেখলাম শ্রীলংকান এয়ারলাইন্সের বিশাল বিমান পাঁচ নম্বর গেটের দিকে এগিয়ে আসছে। এতক্ষণ সবাই ভয়ে ভয়ে ছিল – যদি ফ্লাইট ক্যানসেল হয়ে যায়। বিকেল চারটায় যে ফ্লাইটের এসে পৌঁছানোর কথা ছিল তা এসে পৌঁছেছে সোয়া সাতটায়।

অবশেষে আরো দুই ঘণ্টা পর রাত সোয়া নটায় প্লেনে উঠলাম। প্লেন ছাড়লো পৌনে দশটায়। চার ঘন্টা বিশ মিনিট লেট। 

No comments:

Post a Comment

Latest Post

নিউক্লিয়ার শক্তির আবিষ্কার ও ম্যানহ্যাটন প্রকল্প

  “পারমাণবিক বোমার ভয়ানক বিধ্বংসী ক্ষমতা জানা সত্ত্বেও আপনি কেন বোমা তৈরিতে সহযোগিতা করেছিলেন?” ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বরে জাপানের ‘কাইজো’ ম্য...

Popular Posts