Monday 3 October 2022

বিশ্ববীণা বাজে যেথায় - ৬

 



পরীক্ষার হলে বসে বই দেখে দেখে উত্তর লিখলে সেটাকে কি পরীক্ষা বলা চলে? বাংলাদেশে স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত হিসেব করলে কয়েক শ পরীক্ষা আমাদের দিতে হয়েছে। সেখানের কোন পরীক্ষায় সবচেয়ে সাহসী নকলবাজও প্রকাশ্যে বই খুলে লেখার মতো চরম অপরাধ করার সাহস পায় না। অথচ এখানে মেলবোর্ন ইউনিভার্সিটির ফিজিক্স ডিপার্টমেন্টের সাত তলার এই ছোট্ট পরীক্ষার হলের আটজন পরীক্ষার্থীর সবাই এখন বই খুলে পরীক্ষা দিচ্ছে। এর নাম ওপেন বুক এক্সাম।

ওপেন বুক এক্সাম সম্পর্কে আমার কোন ধারণাই ছিল না। প্রফেসর অ্যালেন যখন বলেছিলেন স্ক্যাটারিং থিওরির পরীক্ষাটি ওপেন বুক এক্সাম হবে – আমি শুরুতে ব্যাপারটা বুঝতে পারিনি। একে ওকে জিজ্ঞেস করে যা জানতে পারলাম তাতে বেশ অবাক হলাম। এখানে কত ধরনের পরীক্ষা যে আছে! ওপেন বুক এক্সামে যত খুশি বই খুলে প্রশ্নের উত্তর লেখা যায়। কিছু কিছু পরীক্ষা নাকি ঘরে বসেও দেয়া যায়। ম্যাথমেটিক্স ডিপার্টমেন্টে নাকি কয়েকটি টুয়েন্টি ফোর আওয়ার এক্সাম আছে -  ডিপার্টমেন্ট থেকে প্রশ্ন আর খাতা নিয়ে যে কোনো জায়গায় বসে চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে প্রশ্নের উত্তর লিখে আবার ডিপার্টমেন্টে জমা দিতে হয়। আমি জানি না এ কেমন ধরনের পরীক্ষা! এরকম পরীক্ষা হলে পরীক্ষার্থী তো মাস্টার ভাড়া করে এনে পরীক্ষা দিতে পারে। কিন্তু ব্যাপারটি যে মোটেও সহজ নয় তা বুঝতে পারলাম ক’দিন পরেই।

ওপেন বুক এক্সাম দিতে এসে যে জিনিসটি আবারো উপলব্ধি করলাম – সেটা অনেকটাই দার্শনিক। দর্শনটা হলো - নিজেকে বুদ্ধিমান ভাবার মধ্যে কোন দোষ নেই, কিন্তু অন্যকে বোকা ভাবা মারাত্মক দূষনীয়। আমি ভেবেছিলাম বই দেখে দেখে যখন লেখা যাবে, তখন পরীক্ষা দেয়া তো কোন ব্যাপারই নয়। কিন্তু এটা ভাবিনি - যে বুড়ো প্রফেসর এই প্রশ্নটি তৈরি করেছেন, তিনিও ভালো করেই জানেন যে প্রশ্নে যা দিয়েছেন তার উত্তর বই দেখে পাওয়া যাবে না।

পরীক্ষার হলে বেশ দূরে দূরে ছোট ছোট টেবিলে আমরা বসেছি। আমি স্ক্যাটারিং থিওরির তিন-চারটি বই নিয়ে এসেছি। অন্যরা দেখলাম ট্রলি ভর্তি করে বই নিয়ে এসেছে। প্রফেসর অ্যালেন এলেন আটটা বাজার ঠিক পাঁচ মিনিট আগে হাতে একগাদা খাতাপত্র নিয়ে।

মাত্র এক পাতার প্রশ্নপত্র। তাতে গুটি গুটি অক্ষরে ছাপানো আপাতনিরীহ স্ক্যাটারিং থিওরির আটটি প্রশ্ন। আটটি প্রশ্নের উত্তর লেখার জন্য মোটা মোটা তিনটি উত্তরপত্র দেয়া হয়েছে, আর সময় দেয়া হয়েছে আট ঘন্টা। সকাল আটটায় শুরু হয়ে এই পরীক্ষা শেষ হবে বিকেল পাঁচটায়। মাঝখানে বারোটা থেকে একটা পর্যন্ত এক ঘন্টার বিরতি।

শুরুতে প্রশ্ন হাতে নিয়ে মনে হয়েছিল – মশা মারতে কামান দাগার কথা। কিন্তু আধঘন্টা পরেও যখন প্রশ্নই বুঝতে পারছিলাম না, মনে হলো কামান কেন, পারমাণবিক বোমা মেরেও স্ক্যাটারিং মশা মারা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।

পরীক্ষা শুরু করে দিয়ে প্রফেসর অ্যালেন চলে গেলেন নিজের অফিসে। আবার আসবেন বারোটায়। পরীক্ষার হলে শিক্ষক না থাকলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই  কথায় কথায় তা বাজার হয়ে যাবার কথা। কিন্তু সেরকম কিছুই হচ্ছে না। বইয়ের পাতা ওল্টানোর খচখচ শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যাচ্ছে না। আমি ঘাড় ঘুরিয়ে মাথা তুলে একে একে সবার দিকে তাকালাম। অন্যরা কেউ কারো দিকে তাকাচ্ছেও না।

স্কুলে থাকতে সব বইয়েরই আবার নোটবই ছিল। সেখানে কোনো কোনো প্রশ্নের উত্তরে লেখা থাকতো – সারমর্ম দেখো। আমার অবস্থা এখন অনেকটাই সেরকম। সব প্রশ্নের উত্তরেই আমাকে বইয়ের চ্যাপ্টার খুলে খুলে সারমর্ম লিখতে হবে। সারমর্ম লিখতে হবে চ্যাপ্টারের মর্ম বুঝতে হবে। কী ঝামেলায় পড়া গেল।

প্রফেসর অ্যালেন ক্লাসে যে নোটগুলি দিয়েছিলেন – সেখান থেকে সরাসরি কোন প্রশ্নই করেননি। আমি যে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পাস করে এসেছি – সেখানে নিয়মই ছিল – যা পড়ানো হবে সেখান থেকেই প্রশ্ন করা হবে। এখানে মনে হয় সেই নিয়ম চলে না। প্রশ্ন কমন না এলে টিচারের রুম ভাঙচুর করার রীতিও সম্ভবত নেই।

পরবর্তী চার ঘন্টা বসে থেকে আর জি নিউটনের স্ক্যাটারিং থিওরি অব ওয়েভস অ্যান্ড পার্টিকলস উল্টাতে উল্টাতে উত্তরপত্রের অনেকগুলি পৃষ্ঠা ভরিয়ে ফেললাম। বারোটায় রুমের দরজা খুলে প্রফেসর অ্যালেন ঢুকলেন।

“ওয়েল গাইস, আই হোপ ইউ আর হ্যাভিং আ গুড টাইম। নাউ টাইম টু হ্যাভ আ ব্রেক।“

একঘন্টার বাধ্যতামূলক বিরতি। খাতাপত্র সবকিছু ভেতরে রেখে আমাদের সবাইকে রুম থেকে বের করে রুমে তালা লাগিয়ে দিলেন প্রফেসর অ্যালেন। একটায় আবার খোলা হবে। এই এক ঘন্টার ভেতর খাওয়া-দাওয়া ইত্যাদি সেরে সময় থাকলে অন্য কারো সাথে আলাপও করা যাবে প্রশ্ন নিয়ে – যদি প্রশ্ন মনে থাকে।

ছয়তলায় নেমে নিজের ডেস্কে এলাম। জিনেট, ক্যামরুন আর নিকোল আড্ডা মারছে। আমাকে ঢুকতে দেখে তিনজনই ফিরে তাকালো। নি্কোল আমার চেয়ার টেনে নিয়ে বসেছিল রুমের মাঝখানে। উঠে দাঁড়িয়ে আমার চেয়ার ঠেলে দিল আমার ডেস্কের দিকে। নিকোল সাধারণত খুবই কম কথা বলে। আড্ডায় সে হচ্ছে একনিষ্ঠ শ্রোতা, আর জিনেট প্রচন্ড রকমের বক্তা। যেকোনো বিষয়েই তার বক্তব্য থাকে।

“পরীক্ষা কেমন হচ্ছে?” – ক্যামরুন জানতে চাইলো।

এই ব্যাটা পরীক্ষার কথা জানলো ক্যামনে? আমি যে পরীক্ষা দিচ্ছি তা তো এদের কারো জানার কথা নয়। হয়তো প্রফেসর অ্যালেনই বলেছেন। এখানে প্রফেসররা  স্টুডেন্টদের সাথে দূরত্ব মেনে চলার নিয়ম জানেন না।

ক্যামেরুনের প্রশ্নের উত্তর দেয়ার আগেই রুমের ফোন বেজে উঠলো। ক্যামেরুন ফোনের সবচেয়ে কাছে ছিল। সে রিসিভার তুলতেই আমি আবার বের হয়ে গেলাম।

কেনের অফিস এখনো বন্ধ। এখনো ফেরেননি ইওরোপ থেকে। ফিরলেই আমাকে নিয়ে বসবেন বলেছেন। বলেছেন যা জানি তার ওপর একটা বক্তৃতা দিতে হবে। নিউক্লিয়ার মডেল সম্পর্কে পরীক্ষায় পাসের জন্য যা পড়েছিলাম তা সব ভুলে গিয়েছি। এখন শুধু এটুকুই বুঝতে পারছি – আমি কিছুই জানি না।

একটায় আবার গেলাম সাততলার পরীক্ষার হলে। আরো চারঘন্টা থাকতে হবে এখানে? পরীক্ষার প্রশ্নগুলি কোনোটাই ঠিক প্রশ্ন নয়। বরং বলা চলে নিউক্লিয়ার স্ক্যাটারিং-এর প্রসঙ্গ এবং প্রাসঙ্গিক সমস্যা। এই সমস্যাগুলির সমাধান খুঁজে বের করতে বলা হয়েছে। সমাধানগুলির বেশিরভাগই গাণিতিক। কোয়ান্টাম মেকানিক্স দিয়ে তার সমাধান করতে হয়। অনার্স ও মাস্টার্স মিলিয়ে দু’বছর কোয়ান্টাম মেকানিক্স পড়ার পরেও এরজন্য যতটুকু গাণিতিক দক্ষতা লাগে  তার কিছুই অর্জন করতে পারিনি। প্রামাণিকস্যার যখন বিভিন্ন গাণিতিক ফাংশান জানার প্রয়োজনীয়তার কথা বলতেন, তখন রাগে গা জ্বলতো। এখন কেন সেই সময় ঠিকমতো শিখিনি বলে নিজের মাথার চুল খাবলে তুলে নিতে ইচ্ছে করছে।

দুটোর দিকে বের হয়ে গেল মার্ক। উত্তরপত্রগুলি সামনের একটি খালি টেবিলে রেখে ট্রলিতে বইপত্র গুছিয়ে ট্রলি ঠেলতে ঠেলতে বের হয়ে গেল। আমার আটটি প্রশ্নের উত্তরই আমি সারমর্ম জাতীয় কিছু লিখে দিয়েছি। এখন আর বসে থাকতে ইচ্ছে করছে না। বের হয়ে যাবার জন্য উশখুশ করছি। অপেক্ষা করছি আরো কেউ বের হয় কি না। দেখলাম মার্ক ফিরে এসেছে আবার। এসেই র‍্যাচেলের টেবিলের কাছে গিয়ে তার বইপত্র গোছাতে শুরু করেছে। র‍্যাচেলকে সে পটানোর চেষ্টা করছে কয়েক বছর থেকে। সম্ভবত কিছুটা পটেছে। খাতাপত্র গুছিয়ে বের হয়ে গেল মার্কের সাথে।

একটু পরে আমিও বের হয়ে গেলাম। মনে হচ্ছে একটা ফাঁড়া কাটলো। এই পরীক্ষাটা আমার না দিলেও চলতো। কেমন পরীক্ষা হয় দেখার কৌতূহল হচ্ছিলো। এখন কৌতূহল মিটে গেছে।

কিন্তু এক সপ্তাহ পরেই বুঝতে পারলাম বইখোলা পরীক্ষার কিছু সুফলও আছে। এধরনের পরীক্ষায় সম্ভবত ফেল করা সম্ভব নয়। সারমর্ম লিখলেও সেগুলি বই থেকে লেখার কারণে কিছুটা শুদ্ধ হয়েছে। অন্যান্যদের সাথে আমিও পাস করে ফেলেছি। প্রফেসর অ্যালেন উত্তরপত্র দিয়ে দিয়েছেন তাঁর মন্তব্যসহ। মনে হচ্ছে এদেশের প্রফেসররাও পুরো উত্তরের একটা নির্দিষ্ট অংশ ছাড়া বাকিটা পড়েনও না। 


No comments:

Post a Comment

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts