Friday 26 August 2022

সাম্প্রদায়িকতার শাস্তি

 


ছবির এই মানুষটির নাম ব্রিজিড হেইউড। দু’সপ্তাহ আগেও তিনি অস্ট্রেলিয়ার ইউনিভার্সিটি অব নিউ ইংল্যান্ডের ভাইস চ্যান্সেলর ছিলেন। আগস্টের পাঁচ তারিখ তাঁর চাকরি চলে গেছে। এত বড় পদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করার কিছুটা সম্মানজনক উপায় হলো – পদত্যাগপত্র জমা নেয়া। আগস্টের পাঁচ তারিখ তাঁর পদত্যাগপত্র গৃহীত হয়েছে। তাঁর অপরাধ কী? না, কিছু কিছু দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যদের মতো তিনি কোন দুর্নীতি করেননি, স্বজনপোষণ করে স্ত্রী-পুত্র-কন্যা-জামাতা-ভাইপো-ভাইজিকে নিয়োগ দেননি। তিনি যেটা করেছেন, সেটা আমাদের দেশে হয়তো কোন অপরাধই নয়। তিনি নিজের মুখ থেকে থুতু আঙুলে লাগিয়ে একটি বাদামী মেয়ের কপালে ডলতে ডলতে বলেছিলেন, দ্যাখো তোমার গায়ের চামড়ার রঙ কত ময়লা!

ঘটনাটি ঘটেছিল এবছর ৮ মার্চ – আন্তর্জাতিক নারী দিবসে। আর্মিডেলে – যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়টি অবস্থিত – একটি ক্লাবে আন্তর্জাতিক নারী দিবস পালন করা হচ্ছিলো। ভাইস চ্যান্সেলর প্রফেসর ব্রিজিড হেইউড সেই অনুষ্ঠানে আলোচকদের প্যানেলে ছিলেন। স্থানীয় স্কুলগুলি থেকে অনেক মেয়েকেও আনা হয়েছিল সেই অনুষ্ঠানে। ষোল বছর বয়সী স্কুলছাত্রীটি অভিবাসী মা-বাবার সন্তান, জন্মসূত্রে অস্ট্রেলিয়ান। জন্মসূত্রেই গায়ের বাদামী রঙ পেয়েছে। সেটা তার অপরাধ – শ্বেত চামড়ার অধিকারী ব্রিজিড হেইউইয়ের কাছে? অথচ ব্রিজিডের গায়ের বর্ণ সাদা হবার জন্য তাঁর নিজের কি কোন কৃতিত্ব আছে? বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন ভিসি হবার পরেও তাঁর সেই সামান্য যুক্তিবোধ কাজ করলো না?

তিনি হয়তো ভেবেছিলেন এটা নিয়ে কেউ কোন আপত্তি করবে না। কিন্তু সেই ব্রিটিশ যুগ কি আছে – যেই যুগে ব্রিটিশরা লাথি মারলে ভারতীয়রা জিভ দিয়ে তাদের জুতো পরিষ্কার করে দিতো বাধ্য হয়ে? অস্ট্রেলিয়া শত বছর অস্ট্রেলিয়ান অশ্বেতাঙ্গ আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের চূড়ান্ত করার পর এখন ক্রমশ সভ্য হচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতা প্রদর্শনের বিরুদ্ধে এখানে আইনকানুন খুব কড়া। অভিবাসীরা এসব আইনকানুনের খবর রাখেন, বাধ্য হয়েই রাখেন। মেয়েটির স্কুলেও পড়ানো হয় সব মানুষের সমান অধিকারের কথা। সে চুপ করে রইলো না। সে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ করেছে ভাইস চ্যান্সেলর ব্রিজিড হেইউডের কাছে।

এদেশে যে যত বড় ক্ষমতাশালী – আইনকানুন তাকে তত বেশি মেনে চলতে হয়। মিডিয়াগুলি স্বাধীন। ফলে একজন সাধারণ মানুষ আইন ভাঙলে মিডিয়া দেখেও না দেখার ভান করতে পারে নিউজভ্যালু কম হবার কারণে। কিন্তু একজন প্রভাবশালী যদি আইন ভাঙে – তাহলে আর রক্ষা নেই। সেজন্যই দেখা যায় কোভিড-১৯ এর লকডাউনের সময় মুখে মাস্ক ছাড়া পেট্রোল পাম্প থেকে তেল নেয়ার কারণে উপপ্রধানমন্ত্রীকে ফাইন করা হয়।

যেহেতু এধরনের সাম্প্রদায়িকতার অভিযোগ আনা হয়েছে ভাইস-চ্যান্সেলরের বিরুদ্ধে, এবং ভিডিও ফুটেজও আছে – শেষ রক্ষা হলো না কোনভাবেই। ভিসি ব্রিজিড হেইউড পদত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন। আদালতের বিচারে তিনি দোষী সাব্যস্ত হতে এখনো অনেক দেরি আছে। কিন্তু ভাইস-চ্যান্সেলরের মতো একটি পদের বিরুদ্ধে এধরনের অভিযোগ উঠলে তা প্রাথমিক তদন্তে যদি দেখা যায় একেবারে ভিত্তিহীন নয়, তখন বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ চুপ করে থাকতে পারে না। এখানে বলে রাখা ভালো, অস্ট্রেলিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়গুলি চলে বিশ্ববিদ্যালয়ের নিজস্ব পরিচালনা বোর্ডের মাধ্যমে। সরকার সেখানে মাথা গলাতে পারে না। সুতরাং এদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসিদের সরকারি লেজুড়বৃত্তি করতে হয় না। আসলে লেজুড়বৃত্তি করে লাভ হলে হয়তো এখানেও করতো।

এরকম শাস্তির নজির থাকলেই কি মানুষের মন থেকে সাম্প্রদায়িক মনোভাব মুছে যাবে? সম্প্রদায়ভুক্ত মানুষ পুরোপুরি সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হতে পারে না। কোনো না কোনোভাবে যত সামান্য পরিমাণেই হোক না কেন তা প্রকাশিত হয়ে পড়ে। সাম্প্রদায়িকতা বলতে যদিও আমরা শুধুমাত্র ধর্মীয় সাম্প্রদায়িকতা বুঝি, কারণ ওটা নিয়েই সবচেয়ে বেশি গন্ডগোল দেখতে আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু বর্ণসাম্প্রদায়িকতা আরো মারাত্মক। বাংলাদেশের কথা যদি ধরি – আমাদের গায়ের বর্ণ মোটামুটিভাবে সবারই একই রকম। সেখানে গাত্রবর্ণ দেখে ধর্মনির্ণয় অসম্ভব। ধর্মীয় পরিচয় আমি ইচ্ছে করলে প্রকাশ নাও করতে পারি। কিন্তু আমার গাত্রবর্ণ লুকানোর তো কোন ব্যবস্থা নেই। আমেরিকায় বর্ণসাম্প্রদায়িকতার ফলে সংঘর্ষ প্রায়ই ঘটে, এই একবিংশ শতাব্দীতে দাঁড়িয়েও। আফ্রিকান-আমেরিকান জাতিগোষ্ঠী কয়েক প্রজন্ম ধরে আমেরিকায় জন্ম নেয়ার পরেও, একজন কৃষ্ণাঙ্গ আটবছর ধরে সেই দেশের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করলেও – বর্ণবিদ্বেষ মুছে যায়নি। বিশ্বায়নের ফলে ভারতীয় উপমহাদেশের বাদামী বর্ণের মানুষগুলি যখন পৃথিবীময় ছড়িয়ে পড়েছে – তখন তাদেরকেও এখন প্রায়ই বর্ণসাম্প্রদায়িকতার কদর্য অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যেতে হচ্ছে। আমেরিকা কানাডা ইওরোপ অস্ট্রেলিয়ার মতো শ্বেতাঙ্গশাসিত দেশে তো বটেই, আফ্রিকার মতো কৃষ্ণাঙ্গ শাসিত দেশেও বাদামীরা বর্ণবাদের শিকার হচ্ছে যথেষ্ট কালো নয় বলে।

আবার বাদামীরা যে নিজেদের ভেতর কী পরিমাণ বর্ণসাম্প্রদায়িক তা আর নতুন করে বলার দরকার আছে বলে মনে হয় না। চট্টগ্রাম কলেজে উচ্চমাধ্যমিক পড়ার সময় একজন প্রভাবশালী স্যার আমাকে প্রত্যেক ক্লাসেই সম্বোধন করতেন “এই কালাইয়া” বলে। অনেক বছর আগের সেই পরিস্থিতির কি এখন কোন উন্নতি হয়েছে?


4 comments:

  1. এই মাসে খুব বেশি লেখা এলো না। আশাকরি খুব তাড়াতাড়ি ব্যস্ততা কাটয়ে উঠে আবার আমাদের নতুন নতুন লেখা উপহার দিবেন।

    ReplyDelete
    Replies
    1. অনেক ধন্যবাদ আজাদ। হ্যাঁ, আমিও আশা করছি।

      Delete
  2. অবস্থার তেমন কোন উন্নতি হয়েছে বলে মনে হয় না।

    ReplyDelete
    Replies
    1. ঠিক বলেছেন। এটা একটা মারাত্মক সমস্যা। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সঞ্চালিত হচ্ছে।

      Delete

Latest Post

Dorothy Crowfoot Hodgkin

  Look closely at the fingers of the person in the picture. Her fingers had not bent in this way due to age; she had been suffering from chr...

Popular Posts